বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রবন্ধের বিষয়বৈচিত্র্য ও ভাষাশৈলী
ভূমিকা
বাংলা সাহিত্যে বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী লেখক ও সমালোচক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। বিষয় ও বৈচিত্র্যে এবং উৎকর্ষিত রূপকল্পে বঙ্কিমচন্দ্রের প্রবন্ধ প্রসারিত ও প্রগতিশীল জীবন দৃষ্টির পরিচায়ক। সাহিত্য, শিল্প, ইতিহাস, রাজনীতি, পুরাতত্ত্ব, ধর্মদর্শন, সমাজতত্ত্ব ইত্যাদি মানবজীবনের বিচিত্র বিষয় তার রচনাশৈলীর অন্তর্ভুক্ত। সমকালীন ইউরোপের চিন্তা দর্শনকে আত্মস্থ করে তিনি বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বমানের সাহিত্যে উত্তীর্ণ করেছেন।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রবন্ধের বিষয়বৈচিত্র্য ও ভাষাশৈলী
বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্যবিষয়ক প্রবন্ধসমূহর পৃথক কোনো সংকলন নেই। বঙ্কিমচন্দ্রের 'বিবিধ প্রবন্ধ' গ্রন্থে তার সাহিত্যবিষয়ক প্রবন্ধসমূহর সন্নিবেশিত হয়েছে। তার সাহিত্যবিষয়ক প্রবন্ধসমূহ বিচারবিশ্লেষণ করে মোটামুটি দুভাগে ভাগ করা যায়। যথা : ১. সাহিত্য রূপকল্প এবং ২. সাহিত্য সমালোচনা।
'গীতিকাব্য' বঙ্কিমের সাহিত্য রূপকল্পবিষয়ক রচনা। এ প্রবন্ধে বঙ্কিমচন্দ্র গীতিকাব্যের উদ্দেশ্য ও প্রকৃতি নিয়ে আলোচনাসহ তিন প্রকার গীতিকাব্যের কথা বলেছেন। যথা: ১. দৃশ্য কাব্য, ২. আখ্যান বা মহাকাব্য ও ৩. খণ্ডকাব্য। তিনি এ তিন ধরনের কাব্যের স্বরূপ, বৈশিষ্ট্য ও পার্থক্য আলোচনা করেছেন। তিনি নাটককে দৃশ্যকাব্য বলেছেন। রামায়ণ, মহাভারত, গদ্যকাব্য, জীবনচরিত এবং আধুনিক উপন্যাসকে আখ্যান বা মহাকাব্য বলেছেন। সাহিত্যের বাকি বিষয়সমূহকে তিনি খণ্ডকাব্যের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। তিনি মনে করেন, খণ্ডকাব্য থেকেই আধুনিক কাব্যের উৎপত্তি। তার মতে, স্বরবৈচিত্র্যের নামই সংগীত অর্থযুক্ত বাক্যের সাথে সংগীতের সংযোগ হলেই তা গীত হয়ে - ওঠে। গীতিকাব্য সম্পর্কে বঙ্কিম বলেন- "গীতের যে উদ্দেশ্য, যে কাব্যের সেই উদ্দেশ্য, তাহাই গীতিকাব্য। বস্তার ভাবোচ্ছ্বাসের পরিস্ফুটতামাত্র যাহার উদ্দেশ্য, সেই কাব্যই গীতিকাব্য।"
বিদ্যাপতি, চন্ডীদাস প্রমুখ বৈষ্ণব কবির রচনা, ভারতচন্দ্রের রসমঞ্জরী. মধুসূদনের বজ্রাঙ্গনা কাব্য, হেমচন্দ্রের কবিতাবলিকে বঙ্কিমচন্দ্র বাংলা ভাষার উৎকৃষ্ট গীতিকাব্য বলেছেন।
'বিদ্যাপতি ও জয়দেব' প্রবন্ধে বঙ্কিমচন্দ্র বঙ্গীয় গীতিকাব্য লেখকদের দুভাগে ভাগ করেছেন। একদল বাহ্য প্রকৃতির দিকে তাকান, অন্যদল অন্তর প্রকৃতির দিকে তাকান। প্রথম দলে জয়দেব, ভারতচন্দ্র এবং অপরদলে বিদ্যাপতি, চন্ডীদাস, গোবিন্দদাস প্রমুখ। মধ্যযুগের দুই বিখ্যাত কবির সাহিত্য সম্পদের তুলনামূলক আলোচনা করতে গিয়ে সাহিত্যের সৃষ্টি সম্পর্কে বলেছেন, "সকলই নিয়মের ফল। সাহিত্যও নিয়মের ফল। বিশেষ বিশেষ কারণ হইতে, বিশেষ বিশেষ নিয়মানুসারে, বিশেষ বিশেষ ফলোৎপত্তি হয়।"
বঙ্কিম এ প্রবন্ধে সাহিত্যের একটি সমাজতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি মনে করেন, ভারতীয় আর্য ও অনার্য জাতির বিবাদের ফলে সৃষ্টি হয়েছে রামায়ণ ও মহাভারত। পরবর্তীতে সুখী ও কৃতী ভারতবাসীরা ধর্ম ও দর্শনশাস্ত্রে মনোযোগ দেয়। সেই ধর্মমোহের ফলে পুরাণ সৃষ্টি হয়। তবে ধর্মের স্রোতের পাশাপাশি বিলাসিতার স্রোত এবং এর পাশাপাশি কালিদাসের কাব্য নাটকাদির সৃষ্টি হয়েছে। 'বাঙ্গালা ভাষা' প্রবন্ধে সাহিত্যের ভাষা সম্পর্কে প্রাবন্ধিক বিভিন্ন অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তার মতে, রচনার প্রধান এবং প্রথম গুণ হলো সরলতা এবং প্রাঞ্জলতা। এজন্য তিনি যথোপযুক্ত যেকোনো ভাষা ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, "বলিবার কথাগুলি পরিস্ফুটি করিয়া বলিতে ভাষার শব্দ প্রয়োজন, তাহা গ্রহণ করিবে, অশ্লীল ভিন্ন কাহার্কেও ছাড়িবে না।"
'চিত্তশুদ্ধি' প্রবন্ধে বঙ্কিমচন্দ্র সাহিত্য তত্ত্ব সম্পর্কে বিস্তৃতভাবে আলোচনা করেছেন। তার সাহিত্য তত্ত্বের বিশেষ আদর্শ হলো সৌন্দর্য সৃষ্টি ও মঙ্গল সাধনের সাথে চিত্তশুদ্ধি। আর এ চিত্তকে শুদ্ধ করে সাহিত্য ও সাহিত্যের সৌন্দর্য। সাহিত্য, ধর্ম ও চিত্রশদ্ধি এ তিনটি তিনি পাশাপাশি দাঁড় করেছেন। সাহিত্য ছাড়া যেমন চিত্তশুদ্ধি হয় না, তেমনি ধর্ম ছাড়াও চিত্রশুদ্ধি হয় না। চিত্তশুদ্ধির জন্য উভয়েরই সমান গুরুত্ব রয়েছে। সাহিত্য সৌন্দর্য ও মঙ্গল সৃষ্টির মাধ্যমে মানুষের চিত্তশুদ্ধি করে। তাই সাহিত্যকে তিনি চিত্তশুদ্ধির অন্যতম উপায় বলে মনে করেছেন। তার মতে, সাহিত্যের মধ্যেই সর্বপ্রকার মানবিক উপাদান ও ধর্মের সম্পর্ক থাকে। এজন্য তিনি চিত্তশুদ্ধির জন্য ধর্মকেও প্রাধান্য দিয়েছেন। তিনি বলেন, "যাহার চিত্তশুদ্ধি আছে তাহার আর কোন ধর্মের প্রয়োজন নাই।”
উপসংহার
উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বঙ্কিমচন্দ্রকে সাহিত্য সম্রাট বলা হয়ে থাকে।' তিনি বাংলা সাহিত্যের প্রথম সমালোচক এ সাহিত্য তাত্ত্বিক। তার পূর্বে কিছু সাহিত্য সমালোচনা হলেও মূলত তার মাঝেই যথার্থ সমালোচনার চিন্তাচেতনা, তাত্ত্বিকতা ইত্যাদি দেখা যায়। তার লেখার প্রধান অভিপ্রায় হলো শিল্পসৃষ্টি এবং মানব কল্যাণ। তিনি সাহিত্যকে জীবনের সাথে যুক্ত করতে চেয়েছেন। তার সমগ্র সাহিত্যবিষয়ক প্রবন্ধে এ সমালোচনা কর্মে এ বিষয়টি বা সাহিত্য ভাবনাটি বিশেষভাবে লক্ষণীয়।