বনলতা সেন কাব্যে জীবনানন্দ দাশের প্রেম ও প্রকৃতিচেতনার সাথে বিরহচেতহনার রূপটি কীভাবে প্রতিফলিত হয়েছে তা নিরূপণ কর

জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪) প্রকৃতির কবি একথা প্রথম বলেছিলেন বুদ্ধদেব বসু। বাসভূমির সাথে পারিপার্শ্বিকের যে সম্পর্ক মানবমনের সাথে প্রকৃতিরও সে সম্পর্ক। এক অর্থে সকল কবির কাব্যেই প্রকৃতি উপস্থিত কি প্রত্যক্ষে কি পরোক্ষে কবি আবহমান মানবসমাজকে প্রকৃতি ও সময়ের পটভূমিকায় দেখে তার মধ্য থেকে 'উৎসনিরুক্তি' খুঁজে পান। জীবনানন্দ কখনো কখনো কোনো কিছুকে 'চরম' মনে করে নেন, সে এক বিশুদ্ধ কবিজগৎ সৃষ্টির প্রয়াসে- সেখানে আত্মচেতনার 'শুদ্ধ মুকুরে' বাস্তবকে ফলিয়ে দেখা যায়। প্রকৃতি, সমাজ ও সময় অনুধ্যান, এই ত্রিভুবনচারী লিরিক কবির কাব্যসৃষ্টির কোনো কোনো অধ্যায়ে কোনো একটি 'ভুবন' প্রধান হয়ে ওঠে। কাব্য রচনার প্রথম পর্যায়ে জীবনানন্দের কাছে যে 'ভুবন' চরম হয়ে উঠেছিল তা প্রকৃতি ভুবন যা নিসর্গের এক প্রশান্তি আশ্রয়। জীবনানন্দের কাব্যে প্রকৃতি প্রথম থেকেই এক উল্লেখযোগ্য অস্তিত্ব।

জীবনানন্দ দাশ

জীবনানন্দের প্রকৃতিজগৎ প্রচলিত চিন্তাময় প্রভাবিত বর্ণনা অনুষত্তোর কোনো জগৎ নয় তা স্বস্কৃতিতে উজ্জ্বল, স্বকীয় নির্মাণে বিশিষ্ট, জীবনানন্দীয় প্রকৃতিভুবন প্রথমাবধিই তার কাব্যে এক অপরিবর্তনীয় অস্তিত্বের মতো উপস্থিত নয়। কাব্যরচনার বিভিন্ন পর্যায়ে কবিচেতনার ভিন্ন ভিন্ন মগ্নতার রঙে ও সুরে এই প্রকৃতিজগতের নব নব মূল্যায়ন ঘটেছে তার কাজের প্রবহমান বিকাশে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও তার মূল্যবিনাশী অন্ধকার এমনই সমাচ্ছন্ন করেছিল কবির চেতনা যে প্রকৃতির প্রশান্তির আশ্বাস ও আশ্রয়বিচ্যুত দিশাহীনতায় এক সময়কার বহু কবিতাই প্রতিকূল পরিবেশের বিষয় আঘাত বহন করেছে। তার কাব্যে প্রকৃতির অনিঃশেষ প্রশান্তির উজ্জ্বল উল্লেখ এমনই অপ্রতিরোধ্য শিল্প-সুষমায় মণ্ডিত যে মনে হয় শেষ পর্যায়ের এসব কবিতাবলিতে কবির চেতনা বলয়িত হয়ে স্থিত হয়েছে বিশ্বাসের নতুন ভূমিতে। তার কবিতায় প্রকৃতি 'হেমন্তময়' বলে দায়মুক্ত হওয়া যায় না; তার প্রকৃতিচেতনায় পরিবর্তনগুলো লক্ষ করা প্রয়োজন, কীট্‌ট্সীয় ইন্দ্রিয়বেদ্য রূপাবিষ্টতা থেকে প্রকৃতিভুবনে প্রশান্তির সন্ধান পাওয়া এবং প্রকৃতিলীন জীবনযাপনের ধারণা থেকে প্রকৃতি ও হৃদয়ের সমাহারে মর্মরিত হরিৎ আলো পৃথিবীর চেতনায় উত্তরণ।


বনলতা সেন কাব্যে লক্ষ করা যায় কবির প্রকৃতিলীনতার প্রবল আসক্তি। এ কাব্যের প্রকৃতি দূরস্থ আশ্রয়ী জগৎ নয়, কোনো কাম্য অগ্রণ্য স্বপ্নের ভুবন নয়, কবির চেতনায় আরো নিকটবর্তী, শুধু ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য রূপানুভূতির অধিগত নয়, প্রশান্তি ও স্থিরতার এমন এক জগৎ যেখানে কবিচিত্ত আশ্রয় পায়, দীর্ঘ অন্বেষার পর, এক সচেতন আত্ম অবলোপী নিমজ্জনে। বনলতা সেন কাব্যের প্রকৃতি শুন অনেক বড় এবং তার গভীর চেতনার আয়তনে নবমূল্যায়িত। নিসর্গ এ কালের কাব্যে মানব অস্তিত্বের মূলধার, প্রকৃতিলীন এক সত্তার নবায়মানতায় উদ্ভাসিত, এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় আমি  যদি হতাম ও ঘাস কবিতা দুটির কথা। আমি যদি হতাম কবিতাটিতে দিগন্তের জলসিঁড়ি নদীর ঝাউয়ের শাখা, নিম্নভূমির জলের গন্ধ, শিরীষ বনের সবুজ রোমশ নীড় রচনা করেছে নৈসর্গিক অস্তিত্বের প্রায় রূপকথা গন্ধী এক আবহ, যেখানে রক্তের স্পন্দন অনুভব করে হংসমিথুন, সে জীবনেও আছে মৃত্যু- গুলির শব্দ এসে ভেঙে দেয় রতিবিহারের রম্যতা। পাখায় পিস্টনের উল্লাসে নিম্নভূমির জলের গন্ধ ছেড়ে বুনোহাঁস পাড়ি দিতে চায় উত্তরে; কিন্তু শিকারির গুলির আঘাতে এসে পড়ে প্রাণোচ্ছল জীবনে একটি ই ছেদ- 'আমাদের স্তব্ধতা, আমাদের শান্তি'। তবু কবি চান এই জৈব নৈসর্গিক জীবনের পূর্ণ সচ্ছলতা ও শান্তি, আর ব্যর্থ পরাহত উ • মানবিক অস্তিত্বের অবলোপ; বন না আমি যদি বনহংস হতাম বনহংসী হতে তুমি; তাহলে থাকত না আজকের জীবনের টুকরো টুকরো মৃত্যু টুকরো সাধের ব্যর্থতা ও অন্ধকার। ঘাস কবিতাটিতেও নৈসর্গিক নিমজ্জনের প্রবল আকাঙ্ক্ষা লক্ষ করা যায়। যখন  লেবুপাতার মতো নরম সবুজ আলোয় পৃথিবী ভরে গিয়েছে ভোরের বেলা, তখন সমস্ত কবিচেতনা অনুরণিত হয়ে উঠেছে এই প্রাকৃতিক প্রাণপ্রবাহের অবিনাশী প্লাবনে নিজেকে ডুবিয়ে দিতে- "ঘাসের ভিতর ঘাস হয়ে জন্মাই কোনো এক নিবিড় ঘাস-মাতার শরীরের সুস্বাদ অন্ধকার থেকে নেমে।" প্রাকৃতিক জীবনের স্বপ্রাণতা, জৈব নির্লিপ্তি ও নিশ্চিন্ত শান্তির মধ্যে আত্ম-অবলোকের এই সচেতনতা বনলতা সেন কাব্যগ্রন্থে জীবনানন্দের প্রকৃতিচেতনায় শুধু নতুন স্বাদ আনেনি, তার সাথে যোগ করেছে মননঋদ্ধ এক নিসর্গ অনুধ্যান।


বনলতা সেন কবিতায় কবি যখন বলে ওঠেন, হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি, সেই মুহূর্তেই ব্যক্তি অস্তিত্বের পরিধি অতিক্রম করে তিনি একাত্ম হয়ে ওঠেন নবসভ্যতায় উত্তরণের যাত্রী মানবাত্মার সাথে। তার পরেই পরাজিত নাবিকের চিত্রকল্পটি 'সবুজ ঘাসের দেশে' ও দারুচিনি দ্বীপের অনুষঙ্গে নিয়ে আসে প্রকৃতির অপরাজেয় ঐশ্বর্য ও প্রশান্তির অবিচল জগতের ইঙ্গিতে সেখানেই; কবি আবিষ্কার করেন বনলতা সেনকে তার নীড়ের আশ্বাসবহ চোখ তুলে যে প্রতীক্ষারত। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের গভীর যোগ থাকা সত্ত্বেও মানুষ শান্তি ও সৌন্দর্যের ব্যর্থ সন্ধানে ঘুরেছে দীর্ঘ ইতিহাস বিকীর্ণ পথে পথে; শেষ পর্যন্ত দিশাহীনতার অন্ধকারে আকস্মিক সাক্ষাতে আবিষ্কার করেছে প্রকৃতির পরম প্রত্ন আশ্রয়। হাজার বছরের পরিক্রমার পর ইতিহাসের বিকীর্ণ জগৎ থেকে কবি ফিরে আসেন অন্বেষায় ক্লান্ত নাবিকের মতো দ্বীপের আশ্রয়ে সে দ্বীপ বনলতা সেন, নিসর্গের অপরাজেয় শান্তির আশ্রয়- "থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।” শেষ চরণের অন্ধকার শব্দটি গূঢ় অর্থময়। এই অন্ধকার সবুজ ঘাসের দেশ আর দারুচিনি দ্বীপের নিসর্গভূগোলের আবহে উদ্‌গত হয়ে ঘনবনানীর নিবিড় শান্তির কথা বলে। প্রকৃতি পৃথিবীর অপরাহত প্রশান্তির আশ্রয় চিরকালই মানবাত্মার অপেক্ষায় রয়েছে; হাল ভেঙে যে নাবিক হারিয়েছে দিশা শেষপর্যন্ত সৈকতের সত্যের মতো প্রকৃতির সবুজ ঘাসের দেশেই পেয়েছে তার অভিসার নীড়।


জীবনানন্দ দাশের অনেক কবিতায় প্রেম ও প্রকৃতির প্রেক্ষিত নিয়ে অর্থের গভীরতা পেয়েছে। এরকম দুটি কবিতা হলো সুররিয়ালিস্ট মন্ডবালায় সমৃদ্ধ-বনোহাঁস ও হরিণেরা। মগ্ন চৈতন্যের জলামাঠ ছেড়ে বাধাবন্ধনহীন যে বুনোহাঁস উড়ে যায় রাত্রির কিনার দিয়ে ইঞ্জিনের মতো শব্দে কোনো নক্ষত্রলোকের দিকে, তার সাথে একীভূত হয়ে যায় কবির কল্পনার নির্বাধ উল্লাস। কল্পনার হাঁস সব এই উল্লেখটি পাঠকের হাতে তুলে দেয় অর্থরহস্যের চাবিকাঠি 'পৃথিবীর সব ধ্বনি ও রং' মুছে গেলে, অর্থাৎ বাস্তব বা ইন্দ্রিয়সংবেদী পৃথিবীর সব সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে, এসব 'কল্পনার হাঁস' তাদের অপার উল্লাসে উড়ে বেড়ায় 'হৃদয়ের শব্দহীন জ্যোৎস্নার' ভিতর। বুনোহাঁস কবিতাটিতে কবির কল্পনায় অরুণিমা সান্যালের মুখ ভুবন হিসেবে গ্রহণ করেছে নিসর্গ পৃথিবীর প্রত্নরূপ। হরিণেরা কবিতাটিতে মুক্তির উল্লাসে ভরা এক অপরূপ নিসর্গলোক নির্মিত হয়েছে, যেখানে ফাল্গুনের জ্যোৎস্নায় পলাশের বনে রুপালি চাঁদের হাত থেকে মুক্তা ঝরে পড়ে শিশিরের পাতায় আর "হরিণেরা খেলা করে হাওয়া আর হীরার আলোকে।" এ কবিতার শুরুতে কবি যখন পাঠকের হাতে তুলে দেন সংকেত 'স্বপ্নের ভিতরে বুঝি' তখন সন্দেহ থাকে না তার চেতনায় স্বপ্নের জগৎ আর ফাল্গুনের জ্যোৎস্নার নিসর্গজগৎ অভেদাত্ম হয়ে গেছে কল্পনা প্রতিভার সংশ্লেষী ধর্মে।


জীবনানন্দের কবিতায় সেই নারী হয়ে উঠেছে অরুণিমা, শেফালিকা, রূপকথার কন্যা শঙ্খমালা। জীবনানন্দের কাছে পৃথিবীর রাঙা, রূপসি। কন্যাদের মধ্যে সে অন্যতম নারী। যে নারীকে কবি দেখেছিলেন অঘ্রাণের অন্ধকারে, ধানসিঁড়িতে,


"কড়ির মতন শাদা মুখ তার;

দুইখানা হাত তার হিম;

চোখে তার হিজল কাঠের রক্তিম

চিতা জ্বলে: দক্ষিণের শিয়রে মাথা শঙ্খমালা যেন পুড়ে যায়

সে আগুনে হায়।” (শঙ্খমালা)


জীবনানন্দের আগের কাব্যগুলোতে প্রেমের অভিসার- অভিযানের বহু বর্ণনা থাকলেও প্রেমিকার সুস্পষ্ট নাম ও শারীরিক উপস্থিতি লক্ষ করা যায়নি। কবিতায় প্রেমিকা নারীর এই শারীরিক উপস্থিতি কবির লেখনী শক্তির বিমূর্ত প্রতীক হয়ে উঠেছে। প্রেমচেতনায় পরিপূর্ণ বনলতা সেনের কবিতাগুলোতে প্রকৃতিলীন ঋতুময় আমেজ বিরাজ করেছে। ঋতুর সমাবেশে চিত্ররূপময় প্রকৃতিকে 'তাকিয়ে দেখার আনন্দ' শুধু নয়, মানবিক অনুভূতি নিয়ে উপস্থিত হয়েছে সুরঞ্জনা, সুদর্শনা, শ্যামলী, অরুণিমা, বনলতা, শেফালিকা, সবিতারা। কবির প্রেমজগতের প্রেয়সী ও শ্রেয়সী নারী এরা। এই নারীরা প্রেমের শাশ্বতবোধে উন্নীত। তাই পৃথিবীর বয়সিনী নারী সুরঞ্জনাকেও তিনি সসম্মানে কবিতায় বরণ করতে পেরেছেন। প্রেমের শাশ্বতবোধ থেকেই তিনি বহু বছর পর এসব নারীদেরকে কবিতার বিষয় করে তুলতে পেরেছেন। হেমন্ত ঋতুর আগমন যেমন কবির হৃদয়ের প্রেমের চেতনাকে দলিতমথিত করেছে, তেমনি বহুদিন পর পুরানো স্মৃতিকে জাগিয়ে তুলতে পেরেছেন কবি। কুড়ি বছর পরে, দুজন এবং অঘ্রাণ প্রান্তরে, কবিতাগুলোতে দেখা যায় হৈমন্তিক বিষণ্নতায় প্রেমবিবশ কবি অনুভব করেছেন অঘ্রাণ এসেছে আজ পৃথিবীর বনে;


"সে সবের ঢের আগে আমাদের দুজনের মনে

হেমন্ত এসেছে তবু;"(অঘ্রাণ প্রান্তরে)


'দুজন' কবিতায় প্রেমিক তার প্রেমিকাকে খুঁজে পেয়েছে হেমন্তের মাঠে। এ কবিতার বিষয় হলো প্রেম, আর উদ্দীপন বিভাব হলো হেমন্ত ঋতু। এখানে প্রকৃতি জগতে ঋতুর আগমনের সঙ্গে সঙ্গে নায়ক-নায়িকাদের মননেও হেমন্ত ঋতুর উপস্থিতি ঘটেছে,


"আজ এই মাঠে সূর্য সহধর্মী অঘ্রাণ কার্তিকে

প্রাণ তার ভরে গেছে।...

সেই ব্যাপ্ত প্রান্তরে দুজন; চারিদিকে ঝাউ আম নিম নাগেশ্বরে

হেমন্ত আসিয়া গেছে;-"(দুজন)


বনলতা সেন কাব্যের কুড়ি বছর পরে কবিতায় নায়ক কার্তিকের ধানখেতে নায়িকাকে ফিরে পাওয়ার বাসনা প্রকাশ করেছেন। হেমন্ত ঋতুই যেন নায়কের মনে জাগিয়ে তুলেছে অতীত প্রিয়ার স্মৃতি।

পরাবাস্তব সৌন্দর্যের ধ্যান ও অন্বেষণ করেছেন কবি জীবনানন্দ। নগ্ন নির্জন হাত কবিতায় পরাবাস্তব ভাবনা রয়েছে। ফাল্গুন মাসের আকাশে রহস্যময়ী হয়ে উঠেছে আলো ও অন্ধকার। ফাল্গুন মাস মধুমাস, তাই ফাল্গুনের নিবিড় অন্ধকারে মিলনের অনুষঙ্গ এসেছে। কবি বলেছেন, “যে আমাকে চিরদিন ভালোবেসেছে/ অথচ যার মুখ আমি কোনোদিন দেখিনি,/ সেই নারীর মতো/ ফাল্গুন আকাশে অন্ধকার নিবিড় হয়ে উঠেছে।" যে নারীর অনুভূতি কবির সমস্ত সত্তা জুড়ে, সেই নারীর মুখ কবির কোনো দিন দেখা হয়ে ওঠেনি। কেবল দেখেছেন, নগ্ন দুটি হাত, সেই নগ্ন দুটি হাতের কাছাকাছি রয়েছে গ্লাস ভর্তি মদ। ন্যাচারাল- সুপারন্যাচারালিজম্ এ কবিতায় রয়েছে। কবিতায় ফুটে উঠেছে অতীত দিনে প্রাসাদের কোনো বাইজি বা নর্তকী নারীর দৃশ্য-

"আজ নেই, কোন এক নগরী ছিল একদিন,

কোন এক প্রাসাদ ছিল:

মূল্যবান আসবাবে ভরা এক প্রাসাদ;"

পারস্য গালিচা, কাশ্মিরি শাল, বেরিন তরঙ্গের নিটোল মুক্তা প্রবাল, আমার বিলুপ্ত হৃদয়, আমার মৃত চোখ, আমার বিলীন স্বপ্ন আকাঙ্ক্ষা;

"আর তুমি নারী-

এই সব ছিল সেই জগতে একদিন।"(নগ্ন নির্জন হাত)


ফাল্গুনের অন্ধকার সমুদ্রপারের সেই অতীত কাহিনিকে মনে করিয়ে দেয়নি- রামধনু রঙের কাঁচের জানালা এবং ময়ূরের পেখমের মতো রঙিন পর্দায় নর্তকী নারীমূর্তির প্রতি গভীর আকর্ষণ ছিল পুরুষের। পুরুষ হৃদয়ের উষ্ণ রক্তক্ষরণ, গ্লাসে তরমুজের মতো রক্তিম রঙের পাশে নগ্ন হাত, উপরন্তু সময়টা হলো ফাল্গুনের অন্ধকার- এসব অনুভবের মধ্যে কবি পেয়েছেন অপ্রাপণীয়া প্রেমিকার কল্পমূর্তি। নগ্ন নির্জন হাত কবিতার রহস্য, বিশ্বাস- অবিশ্বাসের পরিবেশকে কবি ফাল্গুনের অন্ধকারময় পটভূমিতে তুলে ধরেছেন। পরিবেশন করেছেন এক সমুদ্র পারের কাহিনি। কবিতায় তিনি জানিয়েছেন সুন্দর, দামি আসবাবপত্র, কমলারঙের রোদ্দুরের স্মৃতি, সবকিছুই মূল্যহীন হয়ে যেতে পারে যদি বাসনার নারীমুখ উপস্থিত না হয়। এর থেকে পরিষ্কার বুঝা যায় যে, রহস্যময়ী নারীর মতোই ' বসন্তের প্রকৃতিও কবিকে ছলনা করে গেছে। যেহেতু সেদিন নারী ও প্রকৃতি পাশাপাশি অবস্থান করেছিল-


"অনেক কাকাতুয়া পায়রা ছিল, মেহগনির ছায়াঘন পল্লব ছিল অনেক; অনেক কমলা রঙের রোদ ছিল; অনেক কমলা রঙের রোদ;

আর তুমি ছিলে;" (নগ্ন নির্জন হাত)


বেড়াল কবিতায় জীবনানন্দ মায়াবী জগৎ রচনা করেছেন। একটি বিড়াল কেমন করে হেমন্তের সন্ধ্যাতে জাফরান রঙের নরম সূর্যের সাদা থাবা বুলিয়ে দিল, সূর্যের মধ্য থেকে অন্ধকারের ছোট ছোট বলকে সারা পৃথিবীর ভিতর ছড়িয়ে দিল, তাই কবি লক্ষ করেছেন, অতিলৌকিক কর্ম সম্পাদনকারী এই বিড়ালটি কবির  বাস্তব জগৎ থেকে যেন হারিয়ে গেছে। কবি বিড়ালটিকে সারাদিন বিভিন্ন সময়ে ঘুরে ফিরে লক্ষ করেছেন। বিড়ালকে গাছের ছায়ায়, রোধের ভিতরে, বাদামি পাতার উপর চলাফেরা করতে দেখেছেন। কয়েক টুকরো মাছের কাঁটা পেয়েই সে যেন খুশি, নিজেকে সফল এ মনে করেছে। সফলতার পরেই সাদা মাটির কঙ্কালটি কৃষ্ণচূড়া গাছের গায়ে নখ দিয়ে আঁচড় কেটেছে। জীবনানন্দের মনসৃষ্ট বিড়ালটি হেমন্তের কোনো এক দিনে স্বাভাবিক ও অস্বাভাবিক নানা কার্যকলাপে এভাবেই মত্ত থেকেছে।


জীবনানন্দের কাব্যে সূর্য চেতনার, রোধের প্রতীকও। চৈতন্য বিযুক্ত বিড়াল তাই চৈতন্যরূপ সূর্যের পিছনে ছুটে। দুর্লভের স্বপ্নে সে বিভোর। কিন্তু পাওয়া যায় না; বরং এক ছলনার শিকার হয় সে। হৈমন্তিক সন্ধ্যায় সূর্যাস্ত 'জাফরান রঙের সূর্যের নরম শরীরে' সে থাবা বুলায়। সূর্য নয়, সূর্যের ছায়াকে নিয়ে সে প্রাপ্তির আনন্দে খেলা করে। তারপর ভয়ংকর সত্য উদ্‌ঘাটিত হয়। ঠিক যেভাবে রক্তকরবীর রাজা জানতে পারেন মরা যৌবনের অভিশাপ তার গায়ে লেগেছে; তিনি প্রতারিত। তখনই শুরু হয় চরম ভাঙনের খেলা। গ্যেটের মেফিস্টোফেলিসও জ্ঞানের আলোক থেকে বঞ্চিত হয়ে কামলোভের অন্ধকারে রাজা হয়। সেই অন্ধকার রাজত্বে ফাউস্টকেও সে টেনে আনে। ব্যর্থ বঞ্চিত মানুষ মাত্রই প্রতিশোধপরায়ণ, বিড়ালও তার ব্যতিক্রম নয়। তাই নিজে যে আলো থেকে সে বঞ্চিত অন্যদের সে সেই আলোর মুখ দেখতে দিতে চায় না। তাই রাশি রাশি অন্ধকার সে ছড়িয়ে দেয়। ঈর্ষাকাতর, হীনচেতা মানুষেরা যেমন বসন্তের কোকিল, তেমনি বিড়ালও হতে পারে। কবি তেমনই বিড়ালের দেখা পান বারবার, ঘুরে ফিরে। বিড়াল যে মুহূর্তে জানে, তার জন্য কোনো সূর্য নেই, তখনই সে ফিরে যায় তার আদিমতার অন্ধকারে। তারপর অন্ধকারকে ছোট ছোট বলের মতো থাবা দিয়ে লুফে আনল সে, সমস্ত পৃথিবীর ভিতর ছড়িয়ে দিল।


জীবনানন্দ জীবনের প্রতি তীব্র ঘৃণা প্রকাশ করেছেন অন্ধকার কবিতায়। অন্ধকারে কবি চিরকাল ঘুটিয়ে থাকতে চান। যেমন- 

"ধানসিড়ি নদীর কিনারে আমি শুয়েছিলাম-পউষের রাতে-

কোনোদিন আর জাগবোনা জেনে

কোনোদিন জাগবো না আমি-কোনোদিন জাগবোনা আর"- (অন্ধকার) 


পৌষের রাতে কবি জীবনের মিথ্যা প্রবঞ্চনা থেকে নিজেকে সরিয়ে চির ঘুমের মধ্যে নিবিষ্ট হতে চেয়ছেন। স্বপ্ন, উদ্যম, দিনের আলোর মধ্যে কোনোরকম আর আকর্ষণ বোধ করেননি। মৃত্যুর মধ্যে শান্তি ও শীতলতাকে উপলব্ধি করেছেন তিনি। প্রবহমান জীবনকে যন্ত্রণার প্রদাহ বলে মনে হয়েছে কবির। তিনি দেখেছেন পৃথিবীতে চলছে ভয়ংকর জীবনযাত্রার চলমান প্রবাহ।


"শত শত শূকরের চিৎকার সেখানে,

শত শত শূকরীর প্রসববেদনার আড়ম্বর;

এইসব ভয়াবহ আরতি!” (অন্ধকার) 


এই ঘুম থেকে হিম হাওয়ার শেলসম স্পর্শে কিংবা মাঘনিশীত কোকিলের ডাকে কবি জেগে উঠতে চান না। তিনি নিজেকে পৃথিবীর জীব বলে মনে করেছেন। সমস্ত ঘৃণা, বেদনা, আক্রে অনন্ত মৃত্যুর মতো অন্ধকারের মধ্যে তিনি মিশে থাকতে চেয়েছে শীতের রাতে কোনো এক পরিচিত মুমূর্ষুর বিছানার কিনারে একটা ি কমলালেবু হাতে শুশ্রুষায় নিযুক্ত হয়েছে কল্যাণীয়া নারী। মঙ্গলময়ী নারীর স্পর্শ পাওয়ার বাসনায় নায়ক আশা করেছেন, "আবার ফিরে আসব না আমি পৃথিবীতে? আবার যেন ফিরে আসি যখন নায়ক তার অপ্রাপণীয়াকে পাবেন-


"কোনো এক শীতের রাতে

একটা হিম কমলালেবুর করুণ মাংস নিয়ে

কোনো এক পরিচিত মুমূর্ষুর বিছানার কিনারে।” (কমলালেবু) 


তখন নতুন জীবনের আনন্দে মেতে উঠবেন।

প্রেমের এই শাশ্বতবোধ থেকেই স্বপ্নের ধ্বনিরা এসে বলে যায়,

"নিস্তব্ধ শীতের রাতে দীপ জ্বেলে অথবা নিভায়ে দীপ বিছানায় শুয়ে

শীতের রাতে সোনালি জরির কাজ ফেলে

প্রদীপ নিভায়ে রবো বিছানায় শুয়ে;" (স্বপ্নের ধ্বনিরা)


উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বনলতা সেন কাব্যগ্রন্থটি জীবনানন্দের ক্রমপরিণতিশীল প্রকৃতিচেতনার এক মনঋদ্ধ অনুধ্যান যা প্রতীকে প্রোথিত হলেও গভীর ব্যঞ্জনাধর্মী। ইন্দ্রিয়-সংবেদী চৈতন্যে নিসর্গানুভূতির মদিরাচ্ছন্নতাকে অতিক্রম করে জীবনানন্দের মানস ভূমি বারবার আবেগময়তায় সুন্দিত হয়েছে। শুধু স্বপ্ন ও স্মৃতির অনুষত্তাবাহী হয়ে নিসর্গ তার কাছে কোনো দূর ঐশ্বর্যময় কল্পলোক নয়; বরং তার চেতনার এমন এক জগৎ যার সাথে একাত্মীকরণ বলেই মনে হয়েছে কবির কাছে।

আপনারঅদৃশ্যমন্তব্য
Cancel