'বনলতা সেন' ও 'হাজার বছর শুধু খেলা করে' কবিতা দুটির শিল্প সৌন্দর্য বিশ্লেষণ কর।
আধুনিক বাংলা কবিতায় জীবনানন্দ দাশের (১৮৯৯-১৯৫৪) সফল সৃষ্টি বনলতা সেন কাব্যগ্রন্থটি। এ কাব্যের নাম কবিতা বনলতা সেন। এ গ্রন্থটিতে মোট ত্রিশটি কবিতা রয়েছে। বনলতা সেন ও হাজার বছর শুধু খেলা করে এ গ্রন্থের শিল্পসফল কবিতা। বিশ শতকের গোধূলি বেলায় পৃথিবী যখন দ্রুত পরিবর্তিত হয়ে চলেছে, মানুষের ইতিহাসের দ্রুত উত্থানপতন হয়ে চলেছে তখনও জীবনানন্দ দাশের কবিতা শিল্প - সত্তাকে হারায়নি। প্রাতিষ্ঠানিক জীবনবোধ, মধ্যবিত্ত ভন্ডামিকে রেয়াত করেননি তিনি। চেয়েছেন চেতনার প্রকৃত আলোকে মানুষকে জাগিয়ে তুলতে। এ প্রভাব তার আলোচ্য কবিতা দুটি সম্পর্কেও সত্য।
জীবনানন্দ দাশ ছিলেন সুররিয়ালিস্ট কবি। ড. দিপ্তী ত্রিপাঠী তার 'আধুনিক বাংলা কাব্য পরিচয়' গ্রন্থে লিখেছেন, জীবনানন্দকে বাংলা কাব্যে সুররিয়ালিস্ট কবিতার প্রবর্তক বলা যেতে পারে। অর্থাৎ কবি বাস্তব জীবনের গভীর অনুভূতিকে তুলে ধরেন এবং তাকে ব্যাখ্যা করেন কঠিন বাস্তবের আলোকে। কবি কোনো যুক্তিতর্ককে মানেন না, অবচেতন মনকে প্রাধান্য দিয়ে কবি বাস্তবের বহু উর্ধ্বে অবস্থান করেন। কল্পনার সাথে যার গায়ে জড়িয়ে থাকে স্বপ্ন সেখানেই থাকে Super reallity তথা পরাবাস্তব।
জীবনানন্দ দাশের কবিতা একদিক থেকে পরম বিস্ময়কর কথাচিত্র কিন্তু অধিবাস্তব চেতনার ফসল বলে idea-র দিক থেকে এটি সামঞ্জস্যপূর্ণ সম্পূর্ণতা লাভ করে না। মনে হয় বাস্তবের কতকগুলো টুকরো টুকরো ছবিকে কবি একত্রে জুড়ে দিয়েছেন। সেগুলোকে স্বতন্ত্র আকারে দেখা যায়, কিন্তু তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক কী, কবি নিজেও যেন তা জানেন না। শেষ পর্যন্ত তিনি আমাদের হাত ধরে এক রহস্যময় মায়াপুরীতে প্রবেশ করেন, সে মায়াপুরীর অবস্থান এক বাস্তবাতীত জগতে। তাকে যেন আমরা কোনোদিন স্বপ্নে দেখে থাকব। কবির চোখে এই যে বাস্তবাতীত স্বপ্নলোক, তাকে রূপ দিতে গিয়ে কবি যে ভাষা ব্যবহার করেন, তাও বাস্তবের খুব কাছাকাছি, কিন্তু সে ভাষার ব্যবহারে তিনি যে চিত্রকল্প তৈরি করেন তার মধ্যে এক অপরূপ জাদু আছে, তাই তার কাব্যের সম্মোহনী প্রভাব থেকে আমরা মুক্ত হতে পারি না। যেন এক মুঠো তাজা সুকোমল অনুভূতি কবিতার ভিতর দিয়ে আমাদের মন স্পর্শ করে। কবি যখন বনলতা সেন কবিতায়
বলেন "শিশিরের শব্দের মতন সন্ধ্যা আসে" তখন শব্দের স্পন্দন
আমাদের কানে রেশ না তুললেও শিশিরের শব্দকে কখনোই
আমাদের কাছে অসম্ভব বা অবাস্তব বলে মনে হয় না। এই বিশেষ
কাব্য দ্যোতনাকে শুধু অনুভবই করা যায় না। এ ইন্দ্রিয়াতীত
ব্যঞ্জনাকে আমরা যেন আমাদের সম্পূর্ণ ইন্দ্রিয় দিয়েই স্পর্শ
করি। জীবননান্দ দাশের কবিতায় চিত্রকল্প যতই পরস্পর বিচ্ছিন্ন
হোক তার মধ্যে একটা পরস্পর যোগসূত্র থাকে, এ যোগসূত্র
ধরে যখন তার কবিতা পাঠ করা হয় তখন তাকে কিছুতেই অসম্ভব
কবি বলে মনে হয় না। কবিতার আন্দোলনে সুররিয়ালিজনের এ
অভাবনীয় অবদানই প্রকৃতপক্ষে 'Renascence of Wonder'।
বনলতা সেন কবিতায় আছে মোট তিনটি স্তবক। প্রথম স্তবকের
'আমি' আসলে কবি। প্রথম চরণ "হাজার বছর ধরে আমি পথ
হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে" গদ্য ধরনের বাক্য/প্রথম বাক্যটির
হাজার বছর বলতে চতুর্থ শতাব্দীর মাঝামাঝি বা দীর্ঘ সময়ের
দ্যোতনাকে বুঝানো হতে পারে। সিংহল সমুদ্র থেকে মালয় সাগরে-
এই পরিক্রমা খ্রিস্ট্রীয় শতাব্দীর পূর্বে বস্তুত কোনো ভারতবাসীর পক্ষে
সম্ভব ছিল না। তাই হয়তোবা হাজার বছরের উল্লেখ করেন
কবি। এই দীর্ঘ পথ চলায় কবি ছিলেন নিশীথের অন্ধকারে এবং
তিনি ছিলেন বিম্বিসার আশোকের ধূসর জগতে। সময়ের দীর্ঘ
ব্যবধানে কবির ভ্রমণ একাকী আবার জগতটিও ছিল অন্ধকার ও
ধূসর। অন্ধকার শব্দটি কবিতায় পাঁচবার ব্যবহার হয়ে পাঠকের
মনে নির্জন ক্লান্তির চেতনা আনে। "চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন"- শেষ দুটি শব্দে 'স' পরপর থাকায় জীবনের চঞ্চলতা
আভাসিত হয়, কিন্তু পূর্বের ঐ ক্লান্তিকে না ভেঙেই। কবিতাটির
দ্বিতীয় স্তবকে বনলতা সেন সম্পর্কে বলা হয়েছে। বনলতা সেন
নামটি এজন্য তাৎপর্যপূর্ণ যে এতে আছে ইতিহাস ও প্রকৃতির
অনুষঙ্গ। বিদিশার নিশা ও শ্রাবস্তীর কারুকার্য বনলতার চুল ও
মুখের উপমা- চিত্রকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বিদিশা ও শ্রাবস্তী
এ দুটি নগরীই রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ, বৌদ্ধগ্রন্থে
উল্লিখিত। দুটি নগরীই বণিকদের কেন্দ্রস্থল, বৌদ্ধ পরম্পরার
সাথে যুক্ত। বনলতা ইতিহাসের পর্যায়ে পর্যায়ে প্রসারিত- সময়ের
উৎক্ষেপ তার চুলে ও মুখে। সিংহল সমুদ্র, মালয় সাগর,
বিদিশা, শ্রাবস্তীর উল্লেখে আমি বা কবিকে শুধু ক্লান্ত পথিক মনে
হয় না, মনে হয় সমুদ্রযাত্রী বণিক। আর এতে প্রচ্ছন্ন উপমা
স্পষ্ট হয়ে ওঠে এই চিত্রকল্পে-
"অতিদূর সমুদ্রের পর হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে:"
এখানে নাবিকের উপমাটি, দারুচিনি দ্বীপের উল্লেখে সমুদ্র অভিযানকারী প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিপর্যন্ত এক বণিকের চিত্রকল্প নিয়ে আসে। সর্বিক এক সর্বনাশের ইঙ্গিত সর্বনাশের হতাশা, ক্লান্তির, অন্তহীন ক্রদ্ধ জলরাশির পর সবুজ ঘাসের মতো বনলতা সেনকে মনে হয়েছিল। বনলতা সেনের চোখের উপমায় কবি প্রকৃতিকে ব্যবহার করেছেন। পাখির নীড় উপমায় নীড় শব্দটি বিপর্যন্ত অভিযানকারীর কাছে আশ্রয় ও শান্তির ইঙ্গিত।
কবিতাটির তৃতীয় স্তবকে কবি বনলতা সেনের পরিচয়ের পরে একটি সংবাদ জানিয়েছেন। কবি জানিয়েছেন বনলতা সেন নাটোর নামক একটি বিশেষ স্থানের। বিদিশা- বিদর্ভ- শ্রাবস্তীর বিপরীতে নাটোর, একেবারেই বর্তমান ও প্রাত্যহিক। কিন্তু বনলতা, প্রকৃতির মতোই অম্লান- ইতিহাসের ক্লান্ত প্রাণের নীড়ের আশ্রয়, দূরগামী নানা ঝড়ঝঞ্ঝায় বিপর্যস্ত পাখির প্রত্যাবর্তনের, বাঁচবার স্থল। কবি বা আমি এখানে প্রচ্ছন্নভাবে ঐ পাখির মতো।
বনলতা সেন কবিতার শিল্পশৈলী রোমান্টিকতা থেকে বাস্তববাদের মধ্য দিয়ে প্রতীকীবাদের অভিমুখী হয়েছে। বলা যেতে পারে রূপক থেকে লক্ষণার, আবার রূপকে ফিরে আসার এক প্রক্রিয়া লক্ষণীয়। ডেভিড লজ মনে করেন, আধুনিকতাবাদ ও প্রতীকীবাদ মূলত রূপালংকারী, আর আধুনিক বিরোধীই বাস্তববাদী ও লক্ষণাত্মক। বনলতা সেনের রূপ প্রতীকী উন্মোচনে এটাই লক্ষ করা যায়। বনলতা সেন কবিতাটি প্রকাশিত হয় ১৩৪২ এর পৌষে। ১৩৪২ এর আশ্বিনে প্রকাশিত।
হাজার বছর শুধু খেলা করে কবিতায় বনলতা সেন আবার ফিরে
আসে। কবিতা দুটির মধ্যে সাদৃশ্য লক্ষণীয়। বনলতা সেন কবিতায়
কবি হাজার বছর পথ হেঁটেছেন আর হাজার বছর শুধু খেলা
করে কবিতায় হাজার বছর অন্ধকারে জোনাকির মতো খেলা
করেছেন। মানুষের জীবনের অতিক্রান্ত অতীত কখনোই সম্পূর্ণ
লুপ্ত হয়ে যায় না, পরিকীর্ণ ধ্বংসস্তূপের মতো রয়ে যায়, অন্ধকারে
যেমন অপ্রতাপ জোনাকি ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে, আমাদের
বহুমুখী- কর্মোদ্যমের ধ্বংসরাশির উপরে রাত্রির বাৎসল্য ছড়িয়ে
থাকে, বালির উপরে জ্যোৎস্নার ব্যঞ্জনার মতো। দেবদারু গাছের
ছায়াগুলো মনে হয় বিশাল প্রাসাদের রণধ্বস্ত স্তম্ভ। কুরুক্ষেত্রের
যুদ্ধের শেষে কৃষ্ণ ফিরেছিলেন দ্বারকায়। এই দ্বারকাই একদিন
সমুদ্রে বিলীন হয়ে গিয়েছে। কবিতাটিতে দ্বারকা কৃতকর্মা পুরুষের
প্রতিষ্ঠাভূমির প্রতীক। একদিন যে কৃতী পুরুষের সকল প্রস্তুতি-
শ্রম- স্থাপত্য নিরর্থক হয়ে যায় জীবনানন্দের অনেক কবিতায়
তার ইঙ্গিত আছে। এখানে দ্বারকা প্রতিষ্ঠা, পরিণতি ও সংহার
পরিণামের দ্যোতনাবাহী শব্দ। জীবনানন্দ এ কবিতায় দেবদারু
শব্দের অনুষঙ্গে অকস্মাৎ দ্বারকার শব্দটি ব্যবহার করেছেন এবং
এর ফলে চতুর্থ পঙ্ক্তিতে এসে কবিতাটি অতর্কিতে পৌরাণিক
পূর্বসূত্রের উল্লেখে অপরিমেয় ঐশ্বর্য লাভ করেছে। জাগ্রতাবস্থায়
সূচিত ও সাধিত সমস্ত কর্মের আপাত সার্থকতার আড়ালে
লুকানো অকৃতার্থতা ও অন্তিম অবসাদে নেমে আসে ঘুম।
জীবনানন্দ দাশের কবিতা অনেক সময় জটিল, প্রকৃতির মতো রহস্যময়ী, নদীর মতো গহন এবং গভীর। কিন্তু এসব কিছুর আবরণ সরিয়ে ফেললে তার কবিতায় গভীর মনস্তত্ত্বের পরিচয় পাওয়া যায়। সবকিছুর পরেও তার কবিতা শিল্পমাত্রাকে অতিক্রম করে যায় না। বনলতা সেন ও হাজার বছর শুধু খেলা করে কবিতা দুটিতে কবির শিল্পচেতনা বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে উন্মোচিত হয়েছে।