'হাওয়ার রাত' ও 'হরিণেরা' কবিতা দুটির শিল্পসৌন্দর্য বিচার কর।
জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯ - ১৯৫৪) বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান আধুনিক বাংলা কবি। তাকে বাংলা ভাষার 'শুদ্ধতম কবি' বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তিনি বাংলা কাব্যে আধুনিকতার পথিকৃৎদের মধ্যে অন্যতম। তিনি প্রধানত কবি হলেও বেশকিছু প্রবন্ধনিবন্ধ রচনা ও প্রকাশ করেছেন। তার জীবন কেটেছে চরম দারিদ্র্যের মধ্যে। রবীন্দ্র- পরবর্তীকালে বাংলা ভাষার প্রধান কবি হিসেবে তিনি সর্বসাধারণ্যে স্বীকৃত। বুদ্ধদেব বসু তাকে 'নির্জনতার কবি' বলে আখ্যায়িত করেছেন।
হাওয়ার রাত ও হরিণেরা কবিতা দুটি জীবনানন্দ দাশের তৃতীয় ও বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ বনলতা সেন এর অন্তর্ভুক্ত। হাওয়ার রাত কবিতায় নক্ষত্রখচিত জ্বলজ্বলে একরাতের অসামান্য নৈসর্গিক পটভূমিতে তিনি নির্মাণ করেন ততোধিক অসামান্য কবিতাটি। রাত যে কেবল তারকাখচিত তা নয়, নয় কেবল প্রবল হাওয়ার রাত, সে রাতের বিশাল ক্যানভাসে বর্তমানের নত্রনিচয় শুধু নয়, হাজার বছর আগে মরে যাওয়া অজস্র নত্ররা জেগে উঠেছিল। এই আশ্চর্য রাতের প্রেক্ষাপটে কবি উপস্থাপন করেন মৃত সব রূপসীদের মুখ যারা দীর্ঘ বর্শা হাতে কাতারে কাতারে দাঁড়িয়ে গেছেন মৃত্যুকে দলিত করার জন্য, প্রেমের ভয়াবহ স্তম্ভ তুলবার জন্য। ঐ অতিলৌকিক দৃশ্য অবলোকনে কবি বিস্মিত বিমূঢ়, ঐ মহাজাগতিক আহ্বানে মর্ত্যের কবি প্রবল আন্দোলিত। তার হৃদয় ভরে গিয়েছে বিস্তীর্ণ ফেন্টের সবুজ ঘাসের গন্ধে, অবশেষে পৃথিবী ছেড়ে এক স্ফীত, মাতাল বেলুনের মতো তার হৃদয় মহাকাশে, নত্রজগতে উড়ে যায়। কবিতা যে শিল্পের উত্তুঙ্গ চূড়া স্পর্শ করতে পারে- এ কবিতা তার সাক্ষ্য দেয়, এমন চিত্রকল্প ভরপুর, উপমা-উৎপ্রেক্ষা। চিত্রকল্প বলতে বোঝায় চিত্রসদৃশ বা চিত্রের মতো। চিত্র বা চোখে দেখার সামগ্রী, কিন্তু আমাদের ইন্দ্রিয় সংবেদনে, যেখানে শুধু চোখে দেখার অভিজ্ঞতা নয়; ধ্বনি, স্পর্শ, ঘ্রাণ, রসনার আস্বাদন ইত্যাদি নানা ইন্দ্রিয় স্বাদ মিলিত হয়ে থাকে সেসব ক্ষেত্রে কবির চিত্রকল্পের সুদক্ষ প্রয়োগে নিজেদের প্রতিভার স্বাক্ষর। এতে একএকটি সম্পূর্ণ অভিজ্ঞতা ধরা দেয়। জীবনানন্দের বিভিন্ন কাব্যকে পূর্ণ অবয়ব দান করেছে তার চিত্রকল্প। রস, রূপের মতো তার কবিতায় আছে স্পর্শ, গন্ধ বা ঘ্রাণ প্রসঙ্গ।
সমালোচক বুদ্ধদেব বসুর মন্তব্য, “ছবি আঁকতে জীবনানন্দের নিপুণতা অসাধারণ, তার উপর ছবিগুলো শুধু দৃশ্যের নয়, গন্ধের ও স্পর্শেরও বটে। রসনার স্বাদ বাদ পড়েনি। বিভিন্ন বিভিন্ন ইন্দ্রিয়ের বিশিষ্ট অনুভূতিগুলো আবার মিশ্রিত হয়ে বা পরস্পর স্থান বদল করে ইন্দ্রিয় স্বাদের মধ্যে এক নতুন গভীরতা এসেছে।" [জীবনানন্দ দাশ: কালের পুতুল
জীবনানন্দের শিল্পসৌন্দর্যের চিত্রকল্পের লক্ষণ পঞ্চেন্দ্রিয় গ্রাহ্য- অনুভূতি।
নিম্নে বর্ণিত:
১. বাতাসের তেজ বোঝাতে কবি বলেছেন, সিংহের হুংকারে উৎক্ষিপ্ত হরিৎ প্রান্তরের জেব্রার মতো। [হাওয়ার রাত।
২. একটা প্রবল জন্তুর সঙ্গে অন্ধকারের সাযুজ্য বোঝাতে কবি যে শিল্প-সৌন্দর্যের চিত্রকল্প এঁকেছেন-
মিলনোন্মত্ত বাঘিনীর গর্জনের মতো অন্ধকারের চঞ্চল বিরাট
সজীব উচ্ছ্বাসে, জীবনের দুর্দান্ত নীল মমতায়- [হাওয়ার রাত।
হাওয়ার রাত কবিতাটি জীবনানন্দের কবিপ্রতিভার নিদর্শন। সাধারণ কবিগণ হাজার বছর ধরে সহস্র পঙ্ক্তি লিখে গেলেও এমনি একটি মুক্তো কবিতা লিখতে পারবেন না, ঐ বিদ্যুৎস্পর্শ তাদের অধরাই থেকে যাবে। কবিতাটি মনে হয় দৈবপ্রেরিত, কবি নামক নবির মধ্য দিয়ে নাজিল হওয়া দৈববাণী, যার সঙ্গে মিশে আছে কবির অসামান্য রূপসৌন্দর্য ও চিত্রময়তা। অসাধারণ সব শিল্পসৌন্দর্যে ঠাসা এ কবিতা, মশারিটা ফুলে উঠেছে কখনো মৌসুমী সমুদ্রের পেটের মতো, (হাওয়ার রাত]
আবার,
অন্ধকার রাতে অশ্বত্থের চূড়ায় প্রেমিক চিলপুরুষের শিশির ভেজা চোখের মত ঝলমল করেছিল সমস্ত নত্রেরা। [হাওয়ার রাত]
সমগ্র বাংলা সাহিত্যেই দুর্লভ এমনি রূপসৌন্দর্য, তাও জড়ো হয়েছে একটি ভেতর-ভাবাই যায় না। এসব রূপসৌন্দর্যের পরতে পরতে মৌলিক ও কবিপ্রতিভার স্মারক। এ কবিতায় বিজ্ঞানের সত্যের সাথে অঙ্গীভূত হয়ে আছে ইতিহাস চেতনা, আর এর সাথে এসে মিশেছে কবির কল্পনা, অধিবিদ্যা ও দর্শন 'যে নক্ষত্রেরা আকাশের বুকে হাজার হাজার বছর আগে মরে গিয়েছে।' এ পঙ্ক্তি বিজ্ঞানের সত্যকে ধারণ করে, কিন্তু এরপরই কবি' লিখেন 'তারাও কাল জানালার ভিতর দিয়ে অসংখ্য মৃত আকাশ সঙ্গে করে এনেছে'। এটা কবির কল্পনা, বিজ্ঞানের সত্য ছাড়িয়ে কাব্যিক সত্য, যার ভেতর রয়েছে ইতিহাস চেতনা।
এ কবিতায় আছে গতি, কবিতাটি কোথাও থেমে নেই, এগিয়ে চলা বরং বলা ভালো, উড়ে চলাই এর বৈশিষ্ট্য। 'মশারিটা বিছানা ছেড়ে নত্রের দিকে উড়ে যেতে চেয়েছে' 'শাদা বকের মত নীল সমুদ্রে উড়ছে', 'উত্তুঙ্গ জানালার ভেতর দিয়ে শাঁই শাঁই করে নেমে এসেছে', হৃদয় পৃথিবী ছেড়ে উড়ে গেছে স্ফীত মাতাল বেলুনের মতো, এমনি আশ্চর্য ছন্দ গতিময় সকল পঙ্ক্তি এ কবিতার চাকায় জুড়ে আছে। প্রকৃতির বিরল সৌন্দর্য কবিকে যেমন সম্মোহিত করেছে তেমনি লাইনের পর লাইন জুড়ে প্রবল কাব্যিক সৌন্দর্য পাঠকদেরও আড়ষ্ট অভিভূত করে রেখেছে। কেবল রৌদ্রের আঘ্রাণ নয়, তিনি সে রৌদ্রকে দেখেছেন বলীয়ান রূপে। এভাবে পরাবাস্তরে বিমূঢ় দরজা খুলে দিয়েছেন জীবনানন্দ দাশ। বিস্ময়ের পর বিস্ময় অপো করে আছে এ কবিতায়। জীবনানন্দের এ কবিতায় আছে জঙ্গলের রূপময় অথচ হিংস্র প্রাণীদের আনাগোনা, তাদের উপমা ও শিল্পসৌন্দর্যে এ কবিতার চিড়িয়াখানাটি বর্ণিল ভরে উঠেছে। আছে 'চিতার উজ্জ্বল চামড়া', 'প্রেমিক চিল পুরুষ', 'সাদা বক', 'হুঙ্কারত সিংহ', 'প্রান্তরে উৎপ্তি জেব্রা', 'মিলনোন্মত্ত বাঘিনী' ও 'দুরন্ত শকুন।' লক্ষণীয় প্রতিটি বিশেষ্যের সাথে চমৎকার সব বিশেষণ তিনি জুড়ে দিয়েছেন; তার কবিতার যে বৈশিষ্ট্য তাতে রূপসৌন্দর্যতা ফুটে উঠেছে।
জীবনানন্দের হরিণেরা কবিতায় কবির কল্পনা এবং চেতনায় নিসর্গ শুধু সৌন্দর্যের জগৎ নয় তা শান্তি ও নিশ্চিতির এক আশ্রয়ভূমি। পরিবর্তিত চেতনাভূমির ওপরই কবি জীবনানন্দের প্রেম-ভাবনা নবাঙ্কুরিত হয়েছে মননোজ্বালায় এবং ইতিহাসবেদী বিশ্বাসে। চারপাশের বিরূপ বাস্তব, খণ্ড চৈতন্যের গ্লানি ও অপূর্ণতা থেকে প্রেম এক পূর্ণতর জীবন অভিজ্ঞতার আস্বাদ ও আশ্রয় খুঁজেছে নিসর্গের জৈব প্রাণরসে। মানবের ইহজাগতিক অস্তিত্বে নিসর্গের নবমূল্যায়িত মহিমায় প্রেম সৌন্দর্যের আবির্ভাব ঘটেছে উজ্জ্বলভাবে। এ প্রেম চেতনার মধ্য দিয়ে হরিণ হয়ে উঠেছে পূর্ণতর জীবনবাসনার প্রতীক। ব্যবহারিক জীবনের অবলেপে দমিত প্রেমবাসনার ক্ষণজীবী মুক্তির উল্লাসের সাক্ষ্য বহণ করে কবির হরিণেরা কবিতাটি। আমরা জানি হরিণ শুধু তার লোকপ্রসিদ্ধ সৌন্দর্যের জন্য নয়, প্রেম ও অপ্রাপনীয়ের প্রতীক হিসেবে ও আবহমান মানবচেতনায় সুপ্রতিষ্ঠিত। আবার, দ্রুতচারী এই প্রাণীটি মুক্তির দ্যোতনাও বহন করে তার উল্লাসপৃষ্ঠ গতির ইঙ্গিতে। হরিণেরা কবিতাটি কবি অবচেতন মনে প্রবেশ করেছেন ফাল্গুনের জ্যোৎস্নায় পলাশের বনে। কবি হরিণদের খেলা করতে দেখেন রূপালি চাঁদের হাত ধরে শিশিরের পাতায় পাতায়, হরিণেরা খেলার সময় যখন বনের মধ্যে বাতাস প্রবাহিত হয় তখন গাছের পাতা থেকে শিশির ঝরে পড়ে যাকে দেখা যায় মুক্তার মতো। মনে হয় বাতাসের সাথে যেন মুক্তাই ঝরে পড়ছে। পল্লবের ফাঁকে ফাঁকে বনে বনে হরিণেরা খেরা করে হাওয়া আর মুক্তার আলোকে। চারদিকের এ ধরনের নিসর্গ মাধুরী যার মধ্যে ক্রীড়াচঞ্চল হরিণদের নির্বাধ উল্লাস কবির চেতনায় জাগিয়ে তুলছে হারানো প্রেমের আর্তি। কবির সৌন্দর্যপ্রেম ফুটে উঠেছে অত্যন্ত নিগূঢ়ভাবে কেননা শেফালিকা বোসের হাসি কবির কাছে ভালো লেগেছে। হিজল ডালের পিছে অগণন বনের আকাশে হীরার প্রদীপ জ্বালিয়ে শেফালিকা বোসরা হেসে যায়। এ হাসি প্রেমিক কবিমাত্রই বুঝতে পারে। প্রকৃতপক্ষে ভালোবাসা বা ব্যর্থবাসনার বিষাদভার যে জগতে মুক্তি খুঁজছে তা প্রাত্যহিকতায় অবলীন আমাদের পরিচিত পৃথিবী নয়। আসলে হরিণেরা কবিতায় কবি রূপসৌন্দর্য ও শিল্পসৌন্দর্য যেখানে মনে হবে এ এক কল্পজগৎ যেখানে আছে পরিপূর্ণ প্রাণপ্রবাহ কিন্তু তা প্রাণতাড়িত নয়। নিসর্গ শিল্পসৌন্দর্যের ক্ষণজীবী রমণীয়তায় কবি অনুভব করেছিলেন বিষাদ আর তারই সাথে মিলিয়ে নিয়েছেন ভালোবাসার নশ্বরতার বেদনা। উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, হাওয়ার রাত ও হরিণেরা কবিতা দুটি সমগ্র বাংলা কবিতার প্রেক্ষাপটেই নিঃসন্দেহে শ্রেষ্ঠ কীর্তি। এ কবিতাগুলোর পাঠ নিতে গেলে তাই বারংবার বিস্মিত হতে হয়।