কঙ্কাবতী কাব্যের শিল্পরূপ বিশ্লেষণ কর। অথবা, বুদ্ধদেব বসুর কঙ্কাবতী কাব্যের শিল্প-প্রকরণ বিশ্লেষণ কর।
প্রত্যেক ভাষার সৌন্দর্য কাঠামো, নান্দনিকতা, কাব্যরীতি ও শব্দ প্রয়োগের বৈশিষ্ট্য বর্তমান। বাংলা ভাষায়ও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। বুদ্ধদেব বসু বাংলা কবিতার প্রকরণকলা ও রীতি ঐতিহ্যকে স্বীকরণ করেছেন।
কবিতায় ব্যবহৃত শব্দাবলিতে কবি সঞ্চার করেন সংগীত গুণ। অলংকার শাস্ত্রানুযায়ী কবিতার সাংগীতিক ধ্বনি-বিন্যাস কখনো অনুপ্রাস আকারে রূপলাভ করে। বাংলা কবিতায় অনুপ্রাস ব্যবহারের জন্য ভারতচন্দ্র এবং ঈশ্বর গুপ্ত খ্যাতিমান। কিন্তু শব্দালংকার ব্যবহারে তাদের সাড়ম্বর-আতিশয্য পরবর্তী কবিরা তেমন প্রশ্রয় দেননি। শব্দের ধ্বনিগত বিন্যাস ও সংগীত গুণ বাংলা কবিতায় রবীন্দ্রনাথের হাতেই শিখরস্পর্শী সমৃদ্ধি অর্জন করেছে। ত্রিশোত্তর কবিরা শব্দের ধ্বনিবিন্যাসের জন্য শুধু অনুপ্রাসের ওপর ভরসা করেননি। এক্ষেত্রে তারা পাঠ নিয়েছেন রবীন্দ্রনাথের কাছেই। বুদ্ধদেব বসুর কবিতার প্রথম পর্যায়ে অনুপ্রাসের ব্যবহার পরবর্তী দুই পর্যায়ের চেয়ে পরিমাণগতভাবে বেশি। কিন্তু সম্পূর্ণ রচনা পর্যায়ে তিনি অনুপ্রাসনির্ভর ধ্বনিবিন্যাস বেশি করেননি। তার প্রথম পর্যায়ের কবিতায় ব্যবহৃত কয়েকটি অনুপ্রাস উল্লেখ করা হলো,
১. ঘুম নেমে এলো মেদুর আকাশে, মধুর মেঘে, [সেরেনাদ]
২. হাহাকার করে বেহায়া হাওয়ার বেহালাখানি, [সেরেনাদ]
৭-সংখ্যক অনুপ্রাসেও 'ঘুম'-শব্দের বিসংগত ব্যবহার কাব্যিক অভিঘাত সৃষ্টি করেছে এবং 'ম'-এর কোমল ধ্বনিটি 'কানে আর প্রাণে গানের মতো' বেজে উঠেছে।
বুদ্ধদেব বসু মধ্যমিলের ক্ষেত্রেও সাংগীতিক ধ্বনিতরঙ্গ সৃষ্টিতে সক্ষম হয়েছেন। ফরাসি প্রতীকী কাব্য আন্দোলনের একটি বৈশিষ্ট্য, কবিতার সাংগীতিক ধ্বনিব্যঞ্জনা সৃষ্টি, জন্ম নিয়েছিল উনিশ শতকের শেষ দশকগুলোতে। ইংরেজি কবিতায় এ রীতি বিশ শতকের আগে শুরু হয়নি। বর্তমান শতাব্দীর প্রথমদিকে পাশ্চাত্য কবিকূল কবিতায় সাংগীতিক ধ্বনিমাধুর্য ও সাংগীতিক গুণ আরোপের চেষ্টা করেছেন। ফরাসি কবি মালার্মে এবং ভালেরি এ সম্পর্কে সোচ্চার ছিলেন। সংগীত ও সাহিত্যের পারস্পরিক সম্পর্ক বিষয়ে মালার্মে লিখেছেন,
"...সঙ্গীত ও সাহিত্য হচ্ছে সেই একক, সনাতন বস্তুর প্রতিমান রূপ যাকে আমি বলেছি ভাব বা আইডিয়া। এই মিলিত রূপটি আপন সচলতায় কখনো বিলীন হয় অন্ধকারের বুকে, কখনো বা প্রোজ্জ্বল হয় অপরাজিতের মতো। এদের [সাহিত্য ও সঙ্গীত] একটি অপরটির দিকে প্রত্যাশায় নুয়ে পড়ে, অপরটির অন্তরে ডুব দিয়ে গহীন অতলে ছড়ানো মুক্তো আহরণ ক'রে ফিরে আসার জন্যে। আর এভাবেই সমগ্র বৃত্তটি সম্পূর্ণ হয়।"
'বস্তু-নিরপেক্ষ অতীন্দ্রিয় ভাবই আনন্দ লাভের একমাত্র উপায়' -মালার্মে কথিত এ উক্তি থেকে উপলব্ধি করা সম্ভব যে ইন্দ্রিয়াতীত অরূপকেই তিনি রূপায়িত করতে চেয়েছেন শব্দের মাধ্যমে। বুদ্ধদেব বসুর কবিতায় অবশ্য এই অতীন্দ্রিয় সাংগীতিক অরূপকে রূপায়িত করার চেষ্টা নেই। তার কবিতায় শব্দের ধ্বনিতরঙ্গ সৃষ্টির মধ্যেই সাংগীতিক ধ্বনিব্যঞ্জনার সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। ভালেরি যেমন ভাষার অন্তর্শরীর থেকে সংগীত ছেঁকে নিতে চান, বুদ্ধদেব বসুর অভিপ্রায় সেরকম না হলেও শব্দে ও ছন্দে ধ্বনিমাধুর্য সৃষ্টির চেষ্টা তার ছিল। সংগীতধর্মী কবিতায় রয়েছে সংগীতের ধ্বনিময়তা এবং সংগীতের মতো শব্দের গৌণ অর্থময়তা- এ দুয়ের একীভূত অবস্থাই সংগীতধর্মী কবিতায় ধরা দেয়। বুদ্ধদেব বসুর প্রথম পর্যায়ের কিছু রচনার মধ্যে সাংগীতিক ধ্বনিময়তার সাক্ষাৎ পাওয়া যায়, যেখানে শব্দের অর্থ গৌণ। কঙ্কাবতীর নাম কবিতা, সেরেনাদ ও শেষের রাত্রি এ ধরনের কবিতা। রবীন্দ্রনাথ কবিতার অন্তর্গভীরে সাংগীতিক ধ্বনিময়তার অপূর্ব প্রকাশরূপ দিয়েছেন। ত্রিশোত্তর কবিগোষ্ঠী কবিতায় কমবেশি সাংগীতিক ধ্বনিময়তা সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু এ বিষয়ে তারা ফরাসি কবিদের মতো কবিতাকে নৈর্ব্যক্তিক অতীন্দ্রিয়তার দিকে ঠেলে দেননি। বুদ্ধদেব বসুর কবিতায় সংগীতেই সম্মোহনজাল আছে, তবে তা শব্দের পূর্ণ অর্থ বিপর্যয় সৃষ্টি করেনি। 'কঙ্কাবতী' কাব্যগ্রন্থে 'কঙ্কাবতী' নামক কবিতা থেকে এর উদাহরণ দেওয়া যায়,
ক. তোমার নামের শব্দ আমার কানে আর প্রাণে গানের মতো- মর্মের মাঝে মর্মরি' বাজে, 'কঙ্কা! কঙ্কা! কঙ্কাবতী!'
আঁকাবাঁকা মেঘ, একা বাঁকা চাঁদ, বাঁকারেখা চাঁদ জলের নিচে,
আঁকাবাঁকা জলে, একা বাঁকা চাঁদ, আকাশ ফাঁকা।
সাপের মতন জড়ানো মেঘের বুকে জেগে ওঠে সাপের মতন
দ্রুত বিদ্যুৎ,
লাল বিদ্যুৎ, দ্রুত বিদ্যুৎ তোমার নামে শব্দ জাগে;
আকাশ ফাটায়ে লাল বিদ্যুৎ বজ্র বাজায়- 'কঙ্কা! কঙ্কা! কঙ্কাবতী!
[কঙ্কাবতী।
'উপমাই কবিত্ব' জীবনানন্দ দাশের এই মন্তব্য এখন বাংলা সমালোচনা সাহিত্যের ঐতিহ্যের অন্তর্গত। উপমাকে ব্যাপক অর্থে গ্রহণ করে ঐ সমালোচনায় সায় দিয়েছেন বুদ্ধদেব বসু। তার মতে, উপমাকে বাদ দিলে ভাষার প্রকাশশক্তি খর্ব হয়। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কবি প্রকাশকলার কোনো কোনো রীতির ওপর জোর দিয়েছেন। এজরা পাউন্ডের প্রবর্তনায় আধুনিক কবিরা প্রকাশকলায় চিত্রকল্পের অপরিসীম গুরুত্ব স্বীকার করেন। চিত্রকল্পবাদী কবিরা বলেন যে, চিত্রকল্পই কবিতা। কবি তার বিমূর্ত ভাবনাকে সামগ্রিক প্রকাশরূপে দেবার জন্য যে প্রকরণকলার আশ্রয় নেন, উপমা তার অন্যতম। তবে ভাষার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হলেও শুধু উপমার চমৎকারিত্ব থাকলেই কবিতা সম্পূর্ণ হয় না। কবিতার সামগ্রিক ভাবনা উপস্থাপনে সহায়ক বলেই উপমা অনস্বীকার্য।
একে অপরের সম্পর্কহীন বস্তুরাশির অন্তর্গত লুকোনো শাশ্বত সম্বন্ধই উপমায় আবিষ্কৃত হয়। আবেগের অন্তরঙ্গ মুহূর্তে কবি আবিষ্কার করেন আপাত দূরবর্তী বস্তুসমূহের মধ্যে সাদৃশ্য ও সামঞ্জস্য। এই সাদৃশ্য ও সামঞ্জস্যের পুনরাবিষ্কারই কবিতায় উপমারূপে রূপায়িত হয়। রোমান্টিক কবিতার আবিষ্কারপ্রবণ ও সন্ধানধর্মী চরিত্র-
বিষয়ে বুদ্ধদেব বসু লিখেছেন,
রোমান্টিকতার দাবি এই যে কবিতা হবে সন্ধানধর্মী, আবিষ্কারপ্রবণ, বিশ্বের আপাতবিদৃশ্য বস্তুরাশি- আমাদের ব্যবহারিক জীবনে চিরকাল যারা পরস্পরের সুদূর ও অপরিচিত হয়ে থাকে- তাদের মধ্যে স্থাপন করবে একটি ইঙ্গিতময় ও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সম্বন্ধ।
এ মন্তব্যের মধ্যে উপমার চরিত্র লুকিয়ে আছে। পরস্পর সুদূর ও অপরিচিত বস্তুরাশির মধ্যে ইঙ্গিতময় ও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অনুভবনির্ভর সম্পর্ক নিয়েই উপমার কাজ। উপমা আমাদের অনুভব ও আবেগের মধ্যে সঞ্চার করে বর্তমান বিস্ময়, অভাবিত সম্পর্কের প্রদীপ্ত ইঙ্গিত। কবিতার কাছে সানুপুঙ্খ সামঞ্জস্য এবং সামগ্রিক অসামঞ্জস্যতা কাম্য নয়। উপমার কাছেও আমরা তা চাই না। উপমায় থাকবে বিসদৃশ বস্তুরাশির মধ্যে রহস্যময় ও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সম্পর্কের ইঙ্গিত। উপমেয়- উপমানের মধ্যে রহস্যময় গোপন ইঙ্গিতের অভিঘাতে উপমা পাঠকচেতনায় স্বপ্ন, স্মৃতি, অনুষঙ্গ ও অন্তরঙ্গ সংবেদনা জাগায়। নতুন ও অপ্রত্যাশিত ইঙ্গিতের উদ্ভাসই আধুনিক উপমার প্রাণ। ত্রিশোত্তর কবিগোষ্ঠী অজস্র উপমার চমৎকারিত্বে অভিষিক্ত করেছেন বাংলা কবিতা। জীবনানন্দ দাশ ছাড়া অন্য পারঙ্গম উপমা- রচয়িতাদের মধ্যে বুদ্ধদেব বসুও অন্যতম। কবিজীবনের প্রথম পর্যায় থেকেই তিনি কবিতাশরীরের অপরিহার্য অঙ্গরূপে উপমা-
| উৎপ্রেক্ষা নির্মাণ করেছেন।
কবির রোমান্টিক চৈতন্য ও পর্যায়ে উপমা-উৎপ্রেক্ষার উৎস সন্ধান করেছে রোমান্টিক কাব্য ঐতিহ্য এবং রোমান্টিক উপাদান থেকে। আকাশ, নক্ষত্র, মেঘ, আলো-অন্ধকার, রাত্রি, মৃত্যু, চুল, চোখ- এসব রোমান্টিক উপাদান এবং প্রকৃতির অন্য সব উপকরণ থেকে তিনি উপকরণ সংগ্রহ করে নির্মাণ করেছেন সাদৃশ্য শিল্প। তার অভিজ্ঞতার জগৎ অন্তভূমির গাঢ় চেতনার স্পর্শে অভিষিক্ত হয়নি বলেই প্রথম পর্যায়ের রচনায় স্মরণীয় উপমার সাক্ষাৎ কমই পাওয়া যায়। এ পর্যায়ের উপমা হলো,
"কঙ্কা, আমার স্বপ্নের 'পরে বন্যার মতো তোমার চুল" [রূপকথা]
প্রথম পর্যাযের উপর্যুক্ত উপমা আমাদের সেই প্রত্যাশ্যা পূরণ করেনি। কিন্তু প্রথম পর্যায়ের রচনায় সফল উপমা রচিত হয়নি, এমন নয়। কয়েকটি কাব্যসফল উপমার উদাহরণ:
"ঢালো উজ্জ্বল বিশাল বন্যা তীব্র তোমার কেশের তম, আদিম রাতের বেণীতে জড়ানো মরণের মতো এ- আঁকাবাঁকা।" [শেষের রাত্রি]
ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে আধুনিক কবি হতে শব্দ প্রয়োগে বাহুল্যবর্জন এবং আবেগের সংযত প্রকাশ তার অমঙ্গল ঘটায়। প্রকাশকলায় নৈপুণ্য অর্জন করতে হলে প্রথাবদ্ধ ভাষা প্রয়োগরীতি অতিক্রম করা ছাড়া কবির বিকল্প নেই। আধুনিক কবির ভাষা প্রয়োগরীতি প্রথাগত কাব্যভাষাকে বারবার অতিক্রম করে যায়। প্রচলিত প্রকাশ-পদ্ধতি ও কাব্যভাষা অতিক্রম করতে গিয়ে কবি কখনো নতুন শব্দ সৃষ্টি করেন, কখনো কাব্যে প্রচলিত শব্দের নতুন প্রয়োগরীতি উদ্ভাবন করেন, কখনো কবিতার ভাষাকে করেন রূপকাশ্রিত। রূপক অলংকার [Metaphor] কবিকে ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে যথাযথ হতে সহায়তা করে। হার্বার্ট রিড রূপক রচনার শক্তি ও মৌলিকত্বের মানদণ্ডে কবির প্রতিভা বিচার করতে চান।
বুদ্ধদেব বসুর কবিতায় রূপক-অলংকারের সুপ্রচুর ব্যবহার বর্তমান। মূর্ত বস্তু বা বিমূর্ত ভাবকে তিনি পরিয়ে দিয়েছেন অন্য একটি মূর্ত বস্তু বা বিমূর্তভাবের ঘেরাটোপ। একের সৌন্দর্য তিনি সঞ্চারিত করেন অন্যের দেহে। রূপকে ব্যবহৃত উপমেয়- উপমানের পারস্পরিক সম্মিলন ঘটিয়ে বুদ্ধদেব বসু অজস্র শিল্প সফল কাব্যপঙ্ক্তির জন্ম দিয়েছেন। দু-একটি উদাহরণ দিয়ে বুদ্ধদেব বসুর কবিতায় রূপকের সন্ধান শুরু করা যেতে পারে,
উপমার মধ্যে উপমেয়-উপমান সম্মিলন লাভ করে না যা রূপকের একমাত্র লক্ষ্য। রূপকে উপমেয়-উপমানের অভেদ ঘটে। বুদ্ধদেব বসুর কবিতায় উপমেয়-উপমান-সংযুক্ত রূপকই বেশি রচিত
হয়েছে। উপমান-উপমেয়যুক্ত কিছু রূপকের উদ্ধৃতি দেওয়া হলো:
"মাঝরাতে দেখি আকাশের বুকে ঝকঝকে তারা- আলোর পোকা," [কঙ্কাবতী]
সমাসোক্তি
বুদ্ধদেব বসুর কবিতায় বেশকিছু সমাসোক্তি অলংকারের উদাহরণ
পাওয়া যাবে। যেমন,
১. গোধূলি রয়েছে শুয়ে পশ্চিমের গোলাপি বালিশে; [কখনো]
২. যে-পথ মেখেছে ওরা আলগোছে লাল আলতায়, ঝিমায় সে ঝাঁ-ঝাঁ জোছনায়। [মেয়েরা।
প্রথম পর্যায়ের রচনায় ব্যবহৃত হয়েছে আরো বেশকিছু সমাসোক্তি। বর্ণনাপ্রধান কবিতায় সমাসোক্তি অনেকটা বর্ণনা সংকোচনের কাজ করেছে। তাছাড়া অচেতন ও বিমূর্ত যখন চেতনের ক্রিয়ার সঙ্গে নিজেকে জড়ায়, তখন নতুন অভিঘাত ও ঝোঁক পড়ে বিমূর্ত ও অচেতনের ওপর। উদ্ধৃত কয়েকটি সমাসোক্তি শিল্প-সাফল্যে উজ্জ্বল। কবিতার শব্দাবলি প্রায়শ আনে চিত্রের আভাস ও চিত্রের দ্যুতি। উদ্ধৃতি ১-এ গোধূলির পশ্চিম আকাশ মূর্ত হয়ে উঠছে মানুষের শয়ন ক্রিয়ার চিত্রে।
অন্যাসক্ত
সমাসোক্তিতে জড়বস্তু বা বিমূর্তের ওপর আরোপিত হয় সপ্রাণ চেতনের ব্যবহার বা ক্রিয়া। অন্যাসক্ত [Transferred Epithet] অলংকার জড় বা বিমূর্তের ওপর সপ্রাণ চেতনের বিশেষণ বা গুণবাচক শব্দ আরোপিত হয়। আধুনিক কবিতায় অন্যাসক্ত অলংকারের প্রচুর ব্যবহার ঘটেছে। বুদ্ধদেব বসুর কবিতায়ও এর অনেক উদাহরণ পাওয়া যাবে। অন্যাসক্ত অলংকারের উদ্ধৃতি দেওয়া হলো:
বিশাল সাগর পার হ'য়ে এসে বাতাস পাগল,
... ... .. ... ...
সারা পৃথিবীরে ঘুরে-ঘুরে যাবে বাতাস পাগল, [কবিতা]
দিগন্তে ক্লান্ত শশাঙ্ক, - [কোনো বিদেশিনীর প্রতি।
'কঙ্কাবতী' কাব্যে মাত্রাবৃত্ত ছন্দে বুদ্ধদেব বসু অধিকতর সাফল্য অর্জন করেছেন। আরশি, সেরেনাদ এবং শেষের রাত্রি কবিতার ৬। ৬। ৫ মাত্রার পঙক্তিগুলোয় সঞ্চারিত হয়েছে ছন্দস্পন্দের গভীর আবেগ। এসব কবিতা দেহে ব্যবহৃত ক্রিয়াপদও অনেকক্ষেত্রে চলিত। মুক্তবর্ণের পরিমিত অভিঘাত এবং শব্দ ও পঙ্ক্তির পুনরাবৃত্তির কৌশল প্রয়োগ করায় বুদ্ধদেব বসুর এসব কবিতায় সঞ্চারিত সাংগীতিক সম্মোহনজাল বিস্তৃত হয়ে আছে। যেমন-
তোমার চুলের/মনোহীন তম/আকাশে-আকাশে/চলেছে উড়ে/
= ৬+৬+৬+৫
আদিম রাতের/আঁধার-বেণীতে/জড়ানো মরণ/পুঞ্জে ফুঁড়ে/
= ৬+৬+৬+৫
সময় ছাড়ায়ে/মরণ-মারায়ে/বিদ্যুৎত্ময়/দীপ্ত ফাঁকা/
= ৬+৬+৬+৫
এসো, চলে এসো/যেখানে সময়/সীমানাহীন/
= ৬+৬+৫
[শেষের রাত্রি]