'কঙ্কাবতী' কাব্যের আলোকে বুদ্ধদেব বসুর কবি-মানস আলোচনা কর। অথবা, বুদ্ধদেব বসুর 'কঙ্কাবতী' কাব্যের বিষয় ভাবনার পরিচয় দাও।
বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮-১৯৭৪) আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব। তার কবিতার বিষয় ও শিল্পপ্রকরণ বিবেচনার জন্য প্রয়োজন তার চেতনালোকের আবেগ, সংবেদনা, স্বভাব, বৈশিষ্ট্য ও অভিজ্ঞতা উপলব্ধির উৎস সন্ধান। এ কারণে বুদ্ধদেব বসুর আত্মচরিতের গঠনপর্যায় ও তার সমকালীন পরিপ্রেক্ষিতে বিবেচনা ভিন্ন বিকল্প নেই।
বুদ্ধদেব বসুর প্রেমের কবিতার পরিপ্রেক্ষিতভূমির পরিবর্তন ঘটেছে কঙ্কাবতী কাব্যে। বাংলার প্রাচীন লোকনায়িকা কঙ্কাবতীর প্রতি অন্তরঙ্গ আকর্ষণ কবি বহন করেন প্রত্নপ্রজ্ঞায়। ব্যক্তিগত প্রেম অভিজ্ঞতাকে চিরায়ত করার জন্য তিনি লোকপুরাণের আশ্রয় নিয়েছেন। তার রোমান্টিক আবেগ ও সংবেদনা লোকপুরাণের রোমান্টিক নায়িকার প্রেমাবেগের আধারে রূপায়িত। রোমান্টিক বাক্তিপ্রতিভা অনুভব করে সুদূরের প্রতি আকর্ষণ, অপ্রাপণীয়ের - প্রতি দুর্বার আবেগ। লোকনায়িকা কেশবতী কঙ্কাবতী বর্তমান যুগ = ও কালপ্রেক্ষিতে দূর অতীতের স্বপ্ন জাগিয়ে তোলে। প্রেমের কবিতার রোমান্টিক উপাদানকে চিরায়ত লোকপুরাণের সঙ্গে অন্বত করার আকাঙ্ক্ষা থেকেও এ কাব্যে লোকপুরাণ ব্যবহৃত হয়েছে। পুরাণ প্রসঙ্গে বুদ্ধদেব বসু লিখেছেন,
"পুরাণ-কথার ধর্মই এই যে তা একই বীজ থেকে- শতাব্দীর পর শতাব্দী পেরিয়ে, ভৌগোলিক সীমান্ত ছাড়িয়ে- বহু বিভিন্ন ফুল ফোটায়, অনেক চিব-চির ফল ফলিয়ে তোলে।"
বহু শতাব্দীর অন্ধকার পেরিয়ে বাংলার লোকপুরাণের নায়িকা কলাবতী আধুনিক কবি বুদ্ধদেব বসুর কবিতার রোমান্টিক আবেগকে প্রোজ্জ্বল করে তুলেছে।
প্রথমেই লক্ষ করা যাক কঙ্কাবতী কাব্যে কঙ্কাবতী বিষয়ক প্রেমের কবিতার সংবেদন বৈচিত্র্য।
'কঙ্কাবতী' নামশব্দ প্রথমবার ব্যবহৃত হয়েছে বন্দীর বন্দনার 'প্রেমিক' কবিতায়। কঙ্কাবতীর আরশি, সেরেনাদ, কঙ্কাবতী, রূপকথা এবং শেষের রাত্রি কবিতায় কঙ্কাবতীর নাম ব্যবহৃত হয়েছে। আরশি কবিতায় একাদশীর রাঙা ভাঙা আকাশের মায়াবী আলোয় জানালার পাশে মগ্নঘুমে ঢলে পড়া তার রূপ বর্ণিত হয়েছে। কঙ্কাবতী বাঙালির শাশ্বত লোকনায়িকার নাম হলেও এ কবিতায় প্রযুক্ত আপেল, লাল, শুকনো, লাল চুল, হালকা, হলুদ- লালচে চুল ইত্যাদি শব্দ চুলের বর্ণনা থেকে সিদ্ধান্ত করা যায় যে এ নায়িকার রূপসৌন্দর্য বিদেশাগত। কবিতার আবহে বাংলাদেশের লোকনায়িকার মিথ প্রয়োগ স্পষ্ট, কিন্তু তার সৌন্দর্য বর্ণনায় বৈদেশি আবহ উপস্থিত। কঙ্কাবতীর চুল আজানুলম্বিত, মেঘবরণ ও তৈলসিক্ত হবার কথা; তার স্পর্শ ও রূপের অতল প্রাচ্য সৌন্দর্য আরশির কঙ্কাবতীতে নেই। বুদ্ধদেব বসু লোকপুরাণের কঙ্কাবতীর প্রাচ্য সৌন্দর্যের সঙ্গে মিশ্রিত করেছেন আধুনিক বিদেশি নাগরিক নায়িকার রূপসৌন্দর্য। কঙ্কাবতীর রূপরাশি যে বিদেশি রোমান্টিক কাব্যের ভাবরূপ থেকে আহৃত তার ইঙ্গিত আছে বন্যা কবিতায় :
"যেখানে তোমার স্রোত অন্তিম সমুদ্রে এসে মেশে
সুদূর দিগন্ত-' পরে, সে সঙ্গম থেকে নিয়ে এলে
আশ্চর্য সিন্ধুর ফুল, বহুবর্ণী বিচিত্র উদ্ভিদ,
আনিলে সমুদ্র স্বাদ, ধারালো লবণ-গন্ধ তার।
দিগন্তের অন্তরালে অজ্ঞাত, অদৃশ্য, সে-অসীম
ওগো মোর কঙ্কাবতী, তার স্পর্শ নিয়ে তুমি এলে।
সুখান্বেষী পশুধর্ম নহে আমাদের।"
কামনাসর্বস্ব স্থূল নারীও তার কাম্য নয়। তার রোমান্টিক কবি প্রাণ কামনা করেছে রোমান্টিক সাহিত্যের চিরন্তনীকে, কল্পনার স্বর্গে যার বসবাস। আবেলাদ প্রিয়া হেলয়েস বা ব্রাউনিং প্রিয়া প্রেরণা সঞ্চারী ব্যারেট দূর অতীতবর্তী বাস্তব বিশ্বে তারা অপ্রাপণীয়। রবীন্দ্রনাথের সুচরিতা বা লাবণ্য কল্পনার স্বর্গ থেকে নেমে এসেছে গ্রন্থে।
প্রেমিক কবিতায় উদ্ঘাটিত হয়েছে আধুনিক কবির নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ও মানসবৈশিষ্ট্যের স্বরূপ। বুদ্ধদেব বসুর নতুন সৌন্দর্যতত্ত্বও যুক্ত হয়েছে এ কবিতায়, যাকে বোদলেয়ারের দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার করে দেখা যেতে পারে। বোদলেয়ারের নন্দনতত্ত্বে যা কিছু বিকৃত নয় তার বোধগম্য আবেদন নেই। তার কাছে অস্বাভাবিকতা, অপ্রত্যাশিত ও বিস্ময়ের অভিঘাত সৌন্দর্যের অঙ্গ। বুদ্ধদেব বসুর প্রেমিক কবিতায় বোদলেয়ারের নান্দনিক ভাবনার বিচূর্ণিত ও বিকৃত মূল্যবোধের পরিচয় প্রথম পরিস্ফুটিত হয়ে উঠলো। নারীর দেবীরূপ অবিকৃত থাকলো না। তার সৌন্দর্য ও লাবণ্যরাশির অন্তরালে বুদ্ধদেব বসু লক্ষ করলেন মৃত পীত, বিচূর্ণ, রুক্ষ সাদা অস্থিশ্রেণি: লাবণ্যতনুর অন্তরালবর্তী কুৎসিত কঙ্কাল।
'কঙ্কাবতী' নামশব্দ ও কবিতায়ই বুদ্ধদেব বসু প্রথম ব্যবহার করেছেন। বাংলার লোকনায়িকা কঙ্কাবতীকে তিনি পাশ্চাত্য সাহিত্যের নারীর রূপসৌন্দর্যের সংমিশ্রণে আধুনিক করে নিয়েছেন। শাশ্বত প্রেমিকার প্রতীক কঙ্কাবতীর প্রেমের সমস্ত রহস্যজাল আজ উদ্ঘাটিত হয়েছে কবির কাছে। আধুনিক বিজ্ঞান ও মনস্তত্ত্ব প্রেমের অতীন্দ্রিয় ইন্দ্রজাল ও শাশ্বত প্রেমে বিশ্বাস ভেঙে দিয়েছে। আধুনিক মানসের কাছে যদি দেহবাদই মুখ্য হতো, যদি কামনাই হতো দেহবাদী চেতনার শেষ কথা, তাহলে কামনা থেকে প্রেমে উত্তরণের বুদ্ধদেবীয় ভাবনা হতো তাৎপর্যহীন। ক্ষণিক কামনা পরিতৃপ্তি শেষে তাহলে পরস্পরকে ভুলে যাওয়াই হতো স্বাভাবিক। কিন্তু লক্ষযোগ্য যে নম্বর ও বিনষ্টিপ্রবণ জানা সত্ত্বেও বুদ্ধদেব বসু ভালোবাসার ব্যাকুলতা ও সৌন্দর্য-স্পৃহা অস্বীকার করতে পারছেন না।
কঙ্কাবতী কাব্যপর্যায় সম্পর্কে বুদ্ধদেব বসু লিখেছেন,
"আমাদের পাঠক্রমে প্রধান কবি অ্যালফ্রেড টেনিসন তার মরু প্রতিম নাটকগুলোও ডিঙোতে হয়েছিল আমাকে কিন্তু আমাকে আঁকড়ে ধরেছিলেন ব্রাউনিং তার এবড়োখেবড়ো ছন্দ আর ইতালির গালগল্প নিয়ে, একটি উন্মাদনা ছিলেন সুইনবার্ন, একটি প্রণয় প্রির্যাফেলাইট গোষ্ঠী এবং চিত্রকলায় আমার প্রথম প্রবেশের সরু রাস্তাটিও তারাই। আমার এই তখনকার প্রিয় কবিদের কাছে আমি যে কিছু শিখেওছিলাম, আমার কঙ্কাবতী বইটিতে তার নিদর্শন আছে।"
আবেগ সপ্তারের জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন কবিকর্ম থেকে সৌন্দর্য প্রেরণা আহরণ করেছেন বুদ্ধদেব বসু। কঙ্কাবতী বিষয়ক এ কাব্যের প্রেমের কবিতাগুলো ১৯৩০ এর মধ্যে রচিত এবং কবি তখন ঢাকাবাসী। ঢাকা ১৯০০-এ এমনভাবে আধুনিকায়িত ও যন্ত্রায়িত হয়নি, যাতে একজন মধ্যবিত কবি শুধু যন্ত্রায়নের কারণে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় আশ্রয় খুঁজতে চাইবেন অতীত পৃথিবীর বৈদেশি কন্ধন। স্বর্গে। যন্ত্রযুগের নয়; বরং বিশ্বযুদ্ধোত্তর ঔপনিবেশিক ভারজে ' 'আর্থ-বাণিজ্যিক সংকটের বিরূপ অভিঘাত স্পষ্ট, অভিযোক্ত। সামর্থ্যহীন মধ্যবিত্তের হতাশা, ক্লান্তি, নৈরাশ্য এবং ক্রুর সদ
- -
থেকে মুক্তিপ্রত্যাশী কবিচিত্র রোমান্টিক বিশ্ব কাব্য ঐতিহ্যে আগ্রা নিয়েছে। বিরূপ বিশ্ব ও পরিপার্শ্ব, বৈরী সময় ও সময়ঘটিত জটিলত স্পৃষ্ট কবিচিত্ত আশ্রয় নিয়েছে স্বস্তিকর রোমান্টিক ভুবনে। ব্রাউনিং। প্রির্যাফেলাইট গোষ্ঠীর কাব্যভুবনে আশ্রয় নেবার কারণ বুদ্ধদে বসুর রোমান্টিক মনোলোক ও রোমান্টিক স্বপ্নমাধুরীর প্রতি জা পাঠ মুগ্ধতাজনিত আকর্ষণ। সুইনবার্ন ও প্রির্যাফেলাইটনে প্রসঙ্গে তিনি যে দুটি শব্দ ব্যবহার করেছেন, 'উন্মাদনা' ও 'প্রণয়' তাতেও তার পাঠ মুগ্ধতার পরিচয় সুপরিস্ফুট।
বাস্তব পরিপ্রেক্ষিত কিন্তু তা খুব বাস্তব রূপ পায়নি। কঙ্কাবতীর নাম কবির মর্মে সাংগীতিক অনুরণন তোলে, প্রাণে আনে প্রক ঝড়ের আবেগদোলা। তার ঘুমের গহনে, স্বপ্নে, দিনের কা কোলাহলে সারাক্ষণ ঢেউ তোলে প্রিয় নাম কঙ্কাবতী। মন্দিরে। ঘণ্টাধ্বনির মতো তার নামের ঘণ্টা বাজে মনমন্দিরে, তার আকো অনুরণন ছড়িয়ে পড়ে হাওয়ায় হাওয়ায়। বাস্তব পৃথিবীর হাজারে কাজের মাঝে, যন্ত্রবিশ্বের বিচিত্র শব্দনাদ অতিক্রম করে কবি প্রিয়নাম শুনতে পান। প্রকৃতির নানা বস্তুতে যেন কঙ্কা নামই উচ্চারিত। 'উর্বশী' কবিতায় রবীন্দ্রনাথ সর্বভূতে উর্বশীর রূপের প্রতিফলন দেখেছেন, বুদ্ধদেব সর্বভূতে প্রিয়নাম উচ্চারিত হতে শুনেছেন। অপরূপ প্রেমাবেগে প্রোজ্জ্বল কঙ্কাবতীর নাম। শব্দও বাক্যবন্ধের পৌনঃপুনিক প্রয়োগ, চিত্র ও চিত্রকল্পের পারস্পরিক অবলুপ্তি ও পুনর্জাগরণ এবং কাব্যকলার সাংগীতিক প্রকাশরীতি কঙ্কাবতীকে মহিমান্বিত করেছে। রোমান্টিক প্রেমস্বপ্নের প্রবল আবেগে কবি আপ্লুত করেন পাঠক-হৃদয়:
তোমার নামের শব্দ আমার কানে আর প্রাণে গানের মতো
মর্মের মাঝে মর্মরি' বাজে, 'কঙ্কা! কঙ্কা! কঙ্কাবতী!'-
(কঙ্কাবতী গো।)
... ... .. ... ...
আমার বুকের হৃদয়ের রোলে, রক্তের তোড়ে, কানে আর
প্রাণে শুনি-
(কঙ্কাবতী)
হৃৎশব্দের তালে তালে রেখে টিপ টিপ টিপ গান গেয়ে যায়
'কঙ্কা- কঙ্কা- কঙ্কাবতী-
কঙ্কাবতী গো।'
... ... .. ... ...
আকাশের বুকে ফুটেছে তোমার নামের শব্দ একশো কোটি,
তোমার নামের শব্দ আমার মনের আকাশে তারার মতো
ফুটেছে তোমার নামের শব্দ তারার মতন একশো কোটি-
কঙ্কাবতী গো। কঙ্কাবতী গো। কঙ্কাবতী।
তারার মতন একশো কোটি। [কঙ্কাবতী।
রবীন্দ্রনাথের উর্বশী' কবিতার উৎস ভারতীয় মিখ, বুদ্ধদেব বসুর কঙ্কাবতী'র উৎস বাংলার লোকপুরাণ। উর্বশীর মতোই কঙ্কাবতী রুখদেব বসুর স্বনির্মিত সৌন্দর্য প্রতিমা। কঙ্কাবতীর আরশি, সেরেনাদ ও কঙ্কাবতী কবিতা বিষয়ে জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন,
"... এ কবিভাগুলোর সৌন্দর্য এদের ব্যাপ্ত প্রসারের সমগ্রতার ভিতর, স্বপ্নের ভিতর, আবেগের ভিতর: এবং এরকম আবেগীয় রূপসী রূপ এর নিজের আঘ্রাণ নিয়ে বাংলা কবিতায় অনন্যসাধারণ। এসব কবিতা বাংলা কাবাকে অনেক সমৃদ্ধ করেছে। এগুলো বুদ্ধদেবের পুরোনো সৃষ্টি; কিন্তু অনাসৃষ্টির নিষ্পেষণ নেই বলে নতুনের আস্বাদ এদের দেহ থেকে বঝ'রে পড়বে না কোনোদিন।... এগুলো যেন কোনো কুহকময় অফুরন্ত প্রেমের জয়জয়ন্তী।'
কনকাবতীর শেষের রাত্রি কোনো প্রত্যক্ষ বিশ্ব পরিপার্শ্বকে চিহ্নিত করে না। এ কবিতা ক্রুর, কাল-পরিপ্রেক্ষিত থেকে উধাও নিঃসীমে রোমান্টিক যাত্রার ইঙ্গিতবাহী। প্রত্যক্ষের অতীত এক অন্ধকার, যোজন-যোজন বিশাল আঁধারে ঢাকা রহস্যময় জগতে কবি আহ্বান করেন তার প্রিয়া কঙ্কাকে। প্রকরণগত বিচারে প্রির্যাফেলাইট চিত্রবীতিকেই অঙ্গে ধারণ করে আছে শেষের রাত্রি। এই চিত্রাবলির মুখ্য উপাদান এক গতিশীল সজীব অন্ধকার, যা প্রায় তৃতীয় মাত্রা পেয়েছে। প্রতিটি স্তবকের দুটি অংশের প্রথমটিতে বাস্তব ধূসর পৃথিবী, ধূসর জীবন ও ক্রুর কাল সম্পর্কে কবির সচেতন দৃষ্টিভঙ্গি সুস্পষ্টরূপে প্রকাশিত। স্তবকের দ্বিতীয়াংশে ঐ ধূসর পৃথিবী, ধূসর জীবন ও কৃর সময়কে অতিক্রম করার সংকল্প ঘোষণা করে কবি কঙ্কাকে আহ্বান করেন এক সজীব অন্ধকারে, স্বপ্নপ্রেমের রোমান্টিক ব্যাপ্ত পরিসরে:
"তোমার চুলের মনোহীন তম আকশে-আকাশে চলেছে উড়েআদি রাতের আঁধার-বেণীতে জড়ানো মরণ-পুঞ্জে ফুঁড়ে;-সময় ছাড়ায়ে, মরণ মাড়ায়ে-বিদ্যুৎময় দীপ্ত ফাঁকা।এসো, চ'লে এসো, যেখানে সময় সীমানাহীন,সময়-ছিন্ন বিরহে কাঁপে না রাত্রিদিন।সেখানে মোদের প্রেমের সময় সময়হীন-কঙ্কা, শঙ্কা কোরো না।" [শেষের রাত্রি]।
মরণ বাসনা, বিদ্যুৎ, সাপ, আদিম রাত, অ্যাবস্ট্রাক্ট অন্ধকার ও সময় এসব বোমান্টিক উপাদানসমৃদ্ধ শব্দ ও শব্দবন্ধ পাঠককে আবিষ্ট করে রাখলেও পৌনঃপুনিক ব্যবহৃত সময় ও সময়হীন শব্দদ্বয় কবিতায় তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আমরা লক্ষ না করে পারি না যে, এ কবিতায় পুনরাবৃত হয়েছে সময়কে অতিক্রমণের সংকল্প। যেখানে থেকেই একথা আসুক, এ সংকল্পের ভারতীয় দেশকালগত তাৎপর্যটি ভুল করার নয়। যখন কবিতাটি কবির কাছে এসেছে তখন মন্দা-মন্দর সময়স্রোত, বন্ধ্যা চতুস্পর্শ্ব ছিল এক শ্বাসরোধী দুর্বহ অনড়তার উপমেয়। সময়ের হাতেই ক্ষয় এই যোধ তখন তীব্রতা
পেয়েছে নানাভাবে। কাজেই সময়কে ছাড়িয়ে যেতেই হবে তখনই প্রাসঙ্গিক, যখন সময়ের হাত ছাড়ানো বড়ো কঠিন।... প্রথম মহাযুদ্ধোত্তর বিশ্বব্যাপী মন্দা ও ক্ষয়ঙ্কর মন্দ মন্থর কালস্রোতে কবি বুদ্ধদেব প্রেমকেই কালের প্রতিযোগী, প্রতিদ্বন্দ্বী বলে ধরেছেন। কঙ্কাবতী পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা শেষের রাত্রি। আধুনিক বাংলা কাব্যে বুদ্ধদেব যে একজন প্রথম শ্রেণির কবি একমাত্র এই কবিতাটির ওপরেও সে সত্য নির্ভর করতে পারতো। আবেগ-কল্পনা, গাঢ়তর রোমান্টিক সংবেদনা ও অনুভূতিপুঞ্জের স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ শেষের রাত্রিকে মহিমান্বিত করেছে।
বুদ্ধদেব বসুর বন্দীর বন্দনা মূলত আত্মা-মীমাংসারই কাব্য। উপর্যুক্ত কবিতাবলিতে কামনা ও মার্জিত মানসের দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে তার পক্ষে শুদ্ধ প্রেমে উত্তরণ সম্ভব হয়েছে। উদ্ধৃত শেষ পঙক্তির 'স্বর্গরেণু' শব্দবন্ধটি প্রেমের প্রতীক এবং 'রক্তের আঁধারে' শব্দদ্বয় কামনার দ্যোতক। কামনার অন্ধকার থেকেই প্রেমের জন্ম। কামনার মধ্য দিয়েই প্রেমের কাছে যেতে হবে। বুদ্ধদেব বসু এই অনুসিদ্ধান্তে পৌঁছেই দ্বন্দ্বোত্তীর্ণ হয়েছেন। এই বিশ্বাস দৃঢ়তা অর্জনের ফলে অপসারিত হয়েছে কামনা-সম্পৃক্ত দ্বিধাদ্বন্দ্ব।
বন্দীর বন্দনা প্রেমের কবিতায় একটি নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে, আর তা হচ্ছে সৃষ্টিশীলতা সম্পর্কে কবির আত্যন্তিক সচেতনতা। বিধাতার মতো তিনিও যে সৃষ্টিক্ষম এই বোধ উচ্চারিত হয়েছে বারবার। প্রেমের ক্ষেত্রে প্রবৃত্তির পঙ্কে, জৈব কামনার বেড়াজালে তিনি বন্দি থাকতে চাননি। তার আবাল্য মার্জিত মানস বারবার মুক্তিস্পৃহা ঘোষণা করেছে,
“কৃপণের কামার্ত গধুতামোরা ঘৃণা করি। ঘৃণা করি সুমসৃণ আরামেরতৈলাক্ত বিক্লব তৃপ্তি। ইন্দ্রিয়ের ক্ষণিক প্রসাদ,”