"সব পাখি ঘরে আসে-সব নদী-ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন; থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।"- ব্যাখ্যা কর।

সব পাখি ঘরে আসে-সব নদী-ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন; থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।- ব্যাখ্যা কর।
বনলতা সেন কবিতাটির রচয়িতা বিংশ শতাব্দীর আধুনিক বাঙালি কবি জীবনানন্দ দাশ। এ কবিতার শেষ স্তবকে দেখা যায়, সব পাখি সন্ধ্যেবেলা ঘরে আসে, নদী তার গন্তব্য সমুদ্রে যায়- যেরকম জীবন শেষে মানুষ তার শেষ গন্তব্য মৃত্যুর কাছে যায়। জীবনের সব লেনদেন ফুরিয়ে গেলে মৃত্যুর ঘনঘোর অন্ধকারের মধ্যে জ্বলতে-নিভতে থাকে জীবনের কিছু মধুর স্মৃতি ও গল্প।
তিরিশের কবিদের মধ্যে সর্বজনবিদিত কবি জীবনানন্দ দাশ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রোমান্টিকতার পথে যাত্রা করেননি; বরং মৃত্যুর দুর্বিষহ রূপটিকে হৃদয় বিদারিত সুরে বর্ণনা করেছেন। যেখানে মৃত্যু তার কণ্ঠে অন্ধকার আত্মার প্রতিধ্বনি হিসেবে ধরা দিয়েছে। তাই মুখোমুখি বসলে কেবল মৃত্যুর অন্ধকার কবির সামনে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে, যে মৃত্যু কবির বর্তমান সময়ের প্রেরণাকে গ্রাস করে, পরিসমাপ্তি ঘটে, শেষ হয় জীবনের সব দেনা-পাওনা। আবার সব নদীই একসময় বিলীন হয়ে যায়। অতীত ঐতিহ্য ও ইতিহাসও তেমনি জীবনের লেনাদেনা শেষ করে প্রকৃতিতে আশ্রয় নিয়েছে, বিস্মৃত হয়ে পড়েছে জগতের সীমা থেকে। এ বিস্মৃতি সূচিত হয়েছে অন্ধকারের হাত ধরে। জীবনানন্দ দাশের এ 'অন্ধকার' রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের "মরণ রে তুহু মম শ্যাম সমান" এর শ্যাম বা কৃষ্ণ রূপটিকেই প্রতিকায়িত করে। সন্ধ্যা আসে অন্ধকার নিয়ে, চিল তার ডানা থেকে রোদ মুছে ফেলে। একই সঙ্গে কবিতার পঙ্ক্তির সাধারণ অর্থ ছাপিয়ে ওঠছে তার প্রতীকী ও গূঢ় অর্থ-ব্যঞ্জনা। শিশিরের মতো নিঃশব্দে নামে বাংলার শান্ত কোমল সন্ধ্যা। সন্ধ্যা যদি মৃত্যুর প্রতীক হয় তবে সমস্ত জীবনের শেষে ঘনিয়ে আসে মৃত্যু। চিলের ডানার রোদের গন্ধ মুছে যাবার মতো যৌবনের রক্তরাগও ফুরিয়ে আসে মানুষের। পৃথিবীর সব - রঙ-রেখা-মেঘ-আকাশ-পৃথিবী সবটাই কবির চেতনায় গাঢ়তর - বেদনার ছায়া ফেলে- ঘনিয়ে তোলে অন্ধকারকে। কিন্তু পূর্ণ অন্ধকার ঘনাবার আগেই জ্বলে ওঠে জোনাকি এবং তা ঝিলমিলও করে। একে মৃত্যুমুহূর্তে জীবনের শেষবার জ্বলে ওঠার ইঙ্গিত হিসেবে চিহ্নিত করায়। তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল করে। জীবনের শেষ প্রান্তে-একেবারে মৃত্যুর আগে সত্যি জোনাকির মতো ঝিলমিলে কিছু মধুর স্মৃতি মৃত্যুর ঘন অন্ধকারের পরিপ্রেক্ষিতে জ্বলতে-নিভতে থাকে। শুরু হয় জীবনের পাণ্ডুলিপি রচনার সব আয়োজন, তখন মগ্ন চৈতন্যে ডুব দেওয়ার জন্য নাটোরের বনলতা সেনই হয়ে ওঠেন একমাত্র আশ্রয়।
অন্ধকারের রহস্যময় ঘনত্ব যখন সমস্ত পরিমণ্ডল গ্রাস করে তখন নির্ভরতার আশ্রয় খোঁজে কবিহৃদয় ক্ষণিক শান্তির অবকাশে। আবার সবকিছুর অবসানে অমানিশার অনিবার্যতায় অন্তত মুখোমুখি বসে থাকার সমাহিত আশ্বাস। কারণ লৌকিক জীবনকে ছুঁয়ে থেকেই জীবনানন্দ দাশ রোমান্টিক স্বপ্নময়তার সুগভীর নির্জনতায় মহাপৃথিবীকে আস্বাদন করতে চেয়েছেন তার নিজস্ব প্রকৃতি অনুযায়ী।
আপনারঅদৃশ্যমন্তব্য
Cancel