ডাকের বচন কী? উদাহরণসহ ডাকের বচনে মানবচরিত্রের উন্নতির বিধানমূলক ভূমিকা বিচার কর। অথবা, ডাকের বচনের বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধর।
লোকসাহিত্যের একটি জনপ্রিয় শাখা ডাকের বচন। ডাকের বচনে প্রাত্যহিক জীবনের মূল্যবান নীতিমালা ও নির্দেশনা পাওয়া যায়। এককালে বাংলাদেশে ডাকের বচন প্রচলিত ছিল। কৃষক ও বউ-ঝিরা এ বচনগুলোকে কণ্ঠস্থ করে রাখতেন। ডাকের বচনের স্বতন্ত্র একটা প্রকৃতি, কাব্যরস ও গীতিধর্মিতা আছে। ডাকের বচনে মাঝে মাঝে ভণিতা আছে, যা লোকসাহিত্যের অন্য শাখায় সচরাচর লক্ষ করা যায় না।
ড. দীনেশচন্দ্র সেনের মতে, ""ডাক' কোনো ব্যক্তিবিশেষের নাম নাও হতে পারে।” হয়তো একাধিক ব্যক্তি কালক্রমে বিশেষ জ্ঞানের যে পদগুলো রচনা করেছেন তাকেই ডাকের বচন বলা হয়। ডাক শব্দটি ডাকিনী শব্দের পুংলিঙ্গ হতে পারে। মধ্যযুগে বা প্রাচীন যুগে জ্ঞানী ব্যক্তিরা আধিভৌতিক শক্তির অধিকারী ছিলেন বলে অনেকে মনে করেন। চলিত কথা অর্থেও ডাকের বচন কথাটি প্রযুক্ত হতে পারে। দীনেশচন্দ্র সেন অবশ্য ডাককে বঙ্গের সক্রেটিস বলেছেন। খনা কৃষক ও গ্রহনক্ষত্র বিষয়ে পণ্ডিত ছিলেন। তার বচনগুলোর বেশিরভাগ কৃষিকাজ ও ভাগ্যগণনা সম্পর্কিত। কিন্তু ডাকের বচন কিছুটা ভিন্নরকম। এখানে মানব চরিত্রের বিভিন্ন দিককে কখনো নির্মোহ কখনোবা সরাসরি ব্যাখ্যা করা হয়েছে। মানবজীবনের সারৎসার ডাকের বচনগুলোর অন্যতম আলোচ্য বিষয়। ধারণা করা হয়, ডাকের বচনগুলো ৮০০-১২০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে রচিত হয়েছিল। ডাকের বচন সম্পর্কে সৈয়দ আলী আহসান যেসব সিদ্ধান্তমূলক মতামত প্রদান করেছেন তা হলো:
- ডাক কোনো ব্যক্তিবিশেষের নাম নয়। ডাকের অর্থ হচ্ছে বুদ্ধিবস্তু জ্ঞানগর্ভ ভাষণ।
- ডাকের বচনের প্রথম, শৃঙ্খলিত সংকলন 'ডাকার্ণবে' পাওয়া যায় যা সম্ভবত অষ্টম শতকের।
- চারণকবিদের দ্বারা গীত হয়ে এসব বচন বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়েছে এবং ক্রমান্বয়ে বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় এগুলোর রূপান্তর ঘটেছে।
- ডাকের বচনের প্রধান বিষয় কৃষি। অবশ্য কৃষি ছাড়াও সেখানে বিবাহ, সামাজিক সম্বন্ধ ইত্যাকার অনুষ্ঠানের সময় নির্ধারণ বিষয়ে বক্তব্য আছে। কথায় প্রাচীন বঙ্গ এবং অসমিয়া সমাজের সামাজিক, আর্থিক এবং বুদ্ধিগত উপলব্ধির চিত্রাঙ্কন আছে।
- ডাকের বচনের মধ্যে কখনো কখনো বৌদ্ধ আচার এবং নৈতিকতার সিদ্ধান্ত প্রতিবিম্বিত হয়েছে। এর ফলে পাল রাজত্বকালেই এগুলোর উদ্ভব ঘটেছিল।
- ডাকের বচনের মধ্যে বৌদ্ধ সিদ্ধান্ত যেমন এসেছে তেমনি আবার ইসলামের প্রভাবে আরবিফারসি শব্দও এসেছে।
- জ্যোতির্বিদ্যা, শুভঅশুভ গণন, আচার এবং ব্রতের প্রশ্রয়ের বিরুদ্ধে সরহপা তার দোহাকোষে অনেক কথা বলেছেন। তিনি তার সময়কালের বিবিধ কুসংস্কারের বিরুদ্ধে মন্তব্য রেখেছেন। এসব কুসংস্কারের সমর্থন ডাকের বচনে পাওয়া যায়।
খনার বচন অধিকাংশই চাষের কথা। কিন্তু ডাকের বচন শুধু জ্যোতিষ ও চাষবাস নিয়ে নয়, এতে আরও অনেক কথা আছে। সংসার সম্বন্ধীয়, ইষ্টলাভ রীতি, বাক্যালাপ রীতি, স্বাস্থ্যবিধি, কৃষকের মূল্য, গৃহনির্মাণ রীতি, সন্তান পালন, নারীর রূপ, ব্যর্থ পুরুষ, গৃহিণীর দোষ-গুণ, সতীর-অসতীর লক্ষণ, কুলক্ষণযুক্ত পুরুষ, গর্ভস্থ সন্তানের লিঙ্গ গণনা, ব্যঞ্জন (তরকারি) রান্না এবং আরও
অনেক কিছু। যেমন-
সুলক্ষণা নারী :
"মিঠা বোল শ্বাশুড়ি পূজে।
আপন ধন আপন বুঝে;
স্বামী সেবা, সাঁজে বাতি।
ডাক বলে লক্ষ্মীর রীতি।"
কুলক্ষণা নারী :
"নিয়ড় পোখরি দূরে যায়।
পথিক দেখিয়া আউড়ে চায়।
হাসিয়া চাহে আড় দৃষ্টি।
ডাক বলে সেই নারী নষ্টী।।"
তিব্বতি ভাষায় ডাক শব্দের অর্থ প্রজ্ঞাবান। নেপালে প্রাপ্ত বজ্রডাকতন্ত্রে বাংলা ডাকের বচনের মতো অনেকগুলো বচন রয়েছে। আবার নেপালের ডাকার্ণব তন্ত্রের বচনের সাথে বাংলা ডাকের বচনের ভাষাগত বিশেষ সাদৃশ্য আছে। তিব্বতি ভাষায় ডাকার্ণব মানে জ্ঞানসাগর। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ও দীনেশচন্দ্র সেনের মতে ডাকার্ণব বাংলা ভাষার আদিগ্রন্থ। এটি কৃষি, জ্যোতিষশাস্ত্র, গণস্বাস্থ্য ও প্রাত্যহিক জীবন সংক্রান্ত প্রজ্ঞাবচনের সমাহার। ডাকের কথা সমসাময়িক জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার অভিযোজন। ডাকের বচনগুলো লোকাচারভিত্তিক। যেমন-
ডাকের বচন :
১।
পূর্বে হাঁস, পশ্চিমে বাঁশ,
উত্তরে বেড়ে, দক্ষিণে ছেড়ে,
কর গ্রহস্থ গৃহবাস।।
২।আতে তিতা দাঁতে নুন,
পেট ভরিও তিন কোণ;
কানে কচু চোখে তেল,
বৈদ্য বাড়ি নাহি গেল।।
ডাকের বচন 'ডাকের কথা' বা 'ডাক পুরুষের কথা' নামেও পরিচিত। ডাক তার বচনকে 'ডাকর কথা' বলেছেন, চাকমা ভাষায় যা 'দাগর কধা' নামে পরিচিত। তবে ডাক নামে কোনো ব্যক্তি ছিল কি না, তা জানা যায় না। তাই বলা যায়, ডাক সাধারণ মানুষের সৃষ্টি। ডাক কিংবা খনার বচনের কোনোটিরই লিখিত রূপ নেই। এগুলো লোকমুখেই প্রচলিত। অসমিয়া ডাক ভণিতায় ডাকের কথার ১১টি প্রকরণের কথা বলা হয়েছে। যথা: জন্মপ্রকরণ, রন্ধনপ্রকরণ, নীতিপ্রকরণ, বৃষলক্ষণ, গৃহিণীলক্ষণ, কৃষিলক্ষণ, জ্যোতিষপ্রকরণ, বর্ষালক্ষণ ইত্যাদি।