'কঙ্কাবতী' কাব্যের প্রেমের স্বরূপ আলোচনা কর। অথবা, কঙ্কাবতী কাব্য অবলম্বনে বুদ্ধদেব বসুর প্রেমচেতনা সম্পর্কে আলোচনা কর।
কঙ্কাবতী কাব্যে বুদ্ধদেব বসুর প্রেমের কবিতার পরিপ্রেক্ষিতভূমির পরিবর্তন ঘটেছে। প্রাচীন লোকনায়িকা কঙ্কাবতীর প্রতি একান্ত আকর্ষণ কবি বহন করেন প্রত্নপ্রজ্ঞায়। ব্যক্তিগত প্রেম অভিজ্ঞতাকে চিরায়ত করার জন্য তিনি লোকপুরাণের আশ্রয় নিয়েছেন।. রোমান্টিক আবেগ সংবেদনা লোকপুরাণের রোমান্টিক নায়িকার প্রেমাবেগের আধারে রূপায়িত। আধুনিক ব্যক্তিপ্রতিভা অনুভব করে সুদূরের প্রতি আকর্ষণ, অপ্রাপণীয়ের প্রতি দুর্বার আবেগ। কালপ্রেক্ষিতে দূর-অতীতের স্বপ্ন জাগিয়ে তোলে লোকনায়িকা কেশবতী কঙ্কাবতী। ভালোবাসার কবিতার রোমান্টিক উপাদানকে চিরায়ত লোকপুরাণের সঙ্গে অন্বিত করার ইচ্ছা থেকে এ কাব্যে লোকপুরাণ ব্যবহৃত হয়েছে। পুরাণ প্রসঙ্গে বুদ্ধদেব বসু লিখেছেন, "পুরাণ-কথার ধর্মই এই যে তা একই বীজ থেকে- শতাব্দীর পর শতাব্দী পেরিয়ে, ভৌগোলিক সীমান্ত ছাড়িয়ে- বহু বিভিন্ন ফুল ফোটায়, অনেক ভিন্ন-ভিন্ন ফল ফলিয়ে তোলে।"
বহু শতাব্দীর অন্ধকার পেরিয়ে বাংলার লোকপুরাণের নায়িকা কঙ্কাবতী আধুনিক কবি বুদ্ধদেব বসুর কবিতার রোমান্টিক ভালোবাসাকে প্রোজ্জ্বল করে তুলেছে। বন্দীর বন্দনার 'প্রেমিক' কবিতায় 'কঙ্কাবতী' নামশব্দ প্রথমবার ব্যবহৃত হয়েছে। কঙ্কাবতী কাব্যের আরশি, সেরেনাদ, কঙ্কাবতী, রূপকথা এবং শেষের রাত্রি কবিতায় কঙ্কাবতীর নাম ব্যবহৃত হয়েছে। আরশি কবিতায় একাদশীর রাঙা ভাঙা আকাশের মায়াবী আলোয় জানালার পাশে অচেতন ঘুমে ঢলে পড়ার সৌন্দর্য বর্ণিত হয়েছে। কঙ্কাবতী বাঙালির চিরচেনা লোকনায়িকার নাম হলেও এ কবিতায় প্রযুক্ত আপেল, লাল, শুকনো, লাল চুল, হালকা, হলুদ-লালচে চুল প্রভৃতি শব্দ ও চুলের বর্ণনা থেকে বলা যায় যে এ নায়িকার রূপসৌন্দর্য বিদেশাগত। কবিতার আবহে বাংলাদেশের লোকনায়িকার মিথ প্রয়োগ স্পষ্ট, কিন্তু তার সৌন্দর্য বর্ণনায় বৈদেশি আবহ সুস্পষ্ট। কঙ্কাবতীর চুল আজানুলম্বিত, মেঘবরণ ও তৈলসিক্ত হবার কথা; তার স্পর্শ ও রূপের অতল প্রাচ্য সৌন্দর্য আরশির কঙ্কাবতীতে ছিল না। বুদ্ধদেব বসু লোকপুরাণের কঙ্কাবতীর প্রাচীন সৌন্দর্যের সঙ্গে মিশ্রিত করেছেন আধুনিক বিদেশি নাগরিক নায়িকার রূপসৌন্দর্য। কঙ্কাবতীর রূপরাশি যে বিদেশি রোমান্টিক কাব্যের ভাবরূপ থেকে আহৃত তার ইঙ্গিত আছে বন্যা কবিতায়,
"যেখানে তোমার স্রোত অন্তিম সমুদ্রে এসে মেশেসুদূর দিগন্ত' পরে, সে সঙ্গম থেকে নিয়ে এলেআশ্চর্য সিন্দুর ফুল, বহুবর্ণী বিচিত্র উদ্ভিদ,আনিলে সমুদ্র-স্বাদ, ধারালো লবণ-গন্ধ তার।দিগন্তের অন্তরালে অজ্ঞাত, অদৃশ্য, সে-অসীমওগো মোর কঙ্কাবতী, তার স্পর্শ নিয়ে তুমি এলে।”
কঙ্কাবতীর রূপসৌন্দর্য বিনির্মাণে বুদ্ধদেব বসুর অবলম্বন ছিল প্রির্যাফেলাইট কবিদের স্বপ্নমধুর মধ্যযুগীয় ভুবন জুড়ে। রসেটি, মরিস প্রভৃতি প্রির্যাফেলাইট চিত্রশিল্পী ও কবিরা রাফায়েল- পূর্ববর্তী ভুবনে আশ্রয় নিয়ে যন্ত্রযুগের বিবর্ধমান চাপ ও আধুনিক জীবনের শ্রীহীনতা ভুলতে চেয়েছেন। বুদ্ধদেব বসু আধুনিক জটিল জীবন, ক্রুর-বাস্তব ও সময়কে অতিক্রম করে প্রাচ্য লোকপুরাণ ও প্রির্যাফেলাইটদের কাব্যভুবনে আশ্রয় নিয়ে নির্মাণ করে নিয়েছেন রোমান্টিক প্রেম-কবিতার কঙ্কাবতীকে। আধুনিক কবির সৌন্দর্য- মূর্তি কঙ্কাবতী। দীপ্তি ত্রিপাঠী লিখেছেন, "যন্ত্রযুগের চাপে শ্বাসরুদ্ধেক সংকীর্ণ মধ্যবিত্ত জীবনে এমন-কোনো যাদু নেই যে শুধু তার প্রয়োগেই নব-নব আবেগ সঞ্চারিত হবে। সাম্প্রতিক ও স্বদেশি কবিপ্রসিদ্ধিও অতিব্যবহারে কার্যকারিতা হারিয়েছিলো, তার দ্বারাও আবেগ সঞ্জাত হবে না। অতএব আবেগ সঞ্চারের জন্য যেতে হবে পৃথিবী পরিক্রমায়- বর্তমান থেকে সুদূর অতীতে-
বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন কবিকর্ম থেকে তিলেতিলে সৌন্দর্য প্রেরণা আহরণ করে গড়তে হবে আধুনিক কাব্যের তিলোত্তমা। এই তিলোত্তমা হলো কঙ্কাবতী।" আবেগ সঞ্চারের জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন কবিকর্ম থেকে সৌন্দর্য-প্রেরণা আহরণ করেছেন বুদ্ধদের বসু, দীপ্তি ত্রিপাঠীর এ মতের সঙ্গে একমত হওয়া সম্ভব। কিন্তু তার পরবর্তী বক্তব্যের সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত হওয়া সম্ভব হয়নি। কঙ্কাবতীবিষয়ক এ কাব্যের প্রেমের কবিতাগুলো ১৯৩০-এর মধ্যে রচিত এবং কবি তখন ঢাকাবাসী। ঢাকা ১৯৩০-এ এমনভাবে আধুনিকায়িত ও যন্ত্রায়িত হয়নি, যাতে একজন মধ্যবিত্ত কৰি শুধুমাত্র যন্ত্রায়নের কারণে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় আশ্রয় খুঁজতে চাইবেন অতীত পৃথিবীর বৈদেশি কল্পনার স্বর্গে। যন্ত্রযুগের নয় বরং বিশ্বযুদ্ধোত্তর ঔপনিবেশিক ভারতের আর্থ- বাণিজ্যিক সংকটের বিরূপ অভিঘাত স্পৃষ্ট, অভিযোজন সামর্থ্যহীন মধ্যবিত্তের হতাশা ক্লান্তি নৈরাশ্য এবং ক্রুর সময় থেকে মুক্তিপ্রত্যাশী কবিচিত্ত রোমান্টিক বিশ্ব কাব্য ঐতিহ্যে আশ্রয় নিয়েছে। বিরূপ বিশ্ব ও পরিপার্শ্ব, বৈরী সময় ও সময়ঘটিত জটিলতাস্পৃষ্ট কবিচিত্ত আশ্রয় নিয়েছে স্বস্তিকর রোমান্টিক ভুবনে। ব্রাউনিং ও প্রির্যাফেলাইট গোষ্ঠীর কাব্যভুবনে আশ্রয় নেবার কারণে বুদ্ধদেব বসুর রোমান্টিক মনোলোক ও রোমান্টিক স্বপ্নমাধুরীর প্রতি তার পাঠ-মুগ্ধতাজনিত আকর্ষণ। সুইনবার্ন ও প্রির্যাফেলাইটদের প্রসঙ্গে তিনি যে দুটি শব্দ ব্যবহার করেছেন, 'উন্মাদনা' ও 'প্রণয়', তাতেও তার পাঠে মুগ্ধতার পরিচয় সুপরিস্ফুট। এ কবিতায় পুনরাবৃত্ত হয়েছে সময়কে অতিক্রমণের সংকল্প। যেখান থেকেই একথা আসুক, এ দৃঢ়চিত্তে ভারতীয় দেশকালগত তাৎপর্যটি ভুল করার নয়। যখন কবিতাটি কবির কাছে এসেছে তখন মন্দা মঞ্জুর সময়স্রোত, বন্ধ্যা চতুষ্পার্শ্ব ছিল এক শ্বাসরোধী দুর্বহ অনড়তার উপমেয়। সময়ের হাতেই ক্ষয়-এ বোধ তখন তীব্রতা পেয়েছে বিভিন্নভাবে কাজেই সময়কে ছাড়িয়ে, যেতেই হবে তখনই প্রাসঙ্গিক, যখন সময়ের হাত ছাড়ানো বড় কঠিন। প্রথম মহাযুদ্ধোত্তর বিশ্বব্যাপী মন্দা ও ভয়ংকর মন্দা মন্টুর কালস্রোতে কবি বুদ্ধদেব প্রেমকেই কালের প্রতিযোগী, প্রতিদ্বন্দ্বী বলে ধরেছেন। কঙ্কাবতী পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা শেষের রাত্রি। আধুনিক বাংলা কাব্যে বুদ্ধদেব যে একজন প্রথম শ্রেণির কবি একমাত্র এই কবিতাটির ওপরেও সে সত্য নির্ভর করতে পারত। আবেগ-কল্পনা, গাঢ়তর রোমান্টিক সমবেদনা ও অনুভূতিপুঞ্জের স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ শেষের রাত্রিকে মহিমান্বিত করেছে।
কঙ্কাবতীর কয়েকটি কবিতায় বুদ্ধদেব বসু আন্তর্জাতিক রোমান্টিক কাব্যের উপকরণ ব্যবহার করেছেন। এদের মধ্যে আরশি, সেরেনাদ ও কবিতা উল্লেখযোগ্য। সেরেনাদ কবিতার পারিপার্শ্বিক আবহ বিদেশি, এর প্রেমাদর্শও তাই।
বুদ্ধদেব বসুর বক্তব্যানুযায়ী এটি
তার ব্রাউনিং ও রসেটির কাব্যপাঠের ফসল। মধ্যযুগের ইতালির প্রেমিক-প্রেমিকারা জানালার নিচে বেহালা বাজিয়ে প্রেমগান করতো, বর্তমান কবিতায় এই আবহ ব্যবহৃত। প্রেমিকার 'কঙ্কাবতী' নাম ব্যবহারের ফলে বাঙালি লোকসুন্দরীর সঙ্গে পাঠক-কল্পনার যোগ স্থাপিত হলেও, কবিতায় প্রবিষ্ট হওয়ামাত্র এর বৈদেশি আবহ অনুভূত হবে। বাদ্যযন্ত্রটি বিদেশি বেহালা। জানালার কাচে জ্বলছে রাঙা ভাঙা চাঁদ, চারদিকে জ্যোৎস্নাজড়ানো হালকা হাওয়ার চঞ্চলতা। শুয়ে আছে কঙ্কাবতীর দেহ। কবির মন মাতাল হাওয়ায় উধাও। বিস্ময় রোমান্টিক আবহ যেন মধ্যযুগীর কোনো ভিনদেশি শহরের মধ্যরাত থেকে নেমে এসেছে পাঠকের কল্পনায়,
"জানালার কাচ জ্বলেছে তোমার- জ্যোছনা-কণা,
কঙ্কাবতী!
রাঙা ভাঙা চাঁদ- খানিকটা তামা, খানিক সোনা,
কঙ্কাবতী!
জানালার নিচে ধূ-ধূ শাদা পথ, আধো-আঁধার,
ধবধবে পথ- শুধু ধূ-ধূ বালি, শাদা ধুলার;
কঙ্কা, শোনো!
... ... ...
হাহাকার করে বেহায়া হাওয়ার বেহালাখানি, কঙ্কাবতী!
জানালার কাচে হানা দেয় তার অঝোর বাণী,
কঙ্কাবতী!
কোন কথা কয়? তুমি কি শুনবে? শুনবে না কি?
আধো বিস্ময় আধো সংশয়ে মেলবে আঁখি?
কঙ্কা, জাগো।"
[সেরেনাদ]
কঙ্কাবতীর শেষ কটি প্রেমের কবিতায় আবেগ অল্প সংবৃত, কিন্তু কবির বাসনাব্যাকুল প্রেমচেতনা আবার ফিরে এসেছে। বুদ্ধদেব বসু দেহোত্তীর্ণ প্রেমে স্থিত হতে চেয়েছেন ইন্দ্রিয়বাসনার প্রত্যক্ষ বাস্তবকে অবলম্বন করেই। কিছুই প্রেমের মতো নয় কবিতায় তিনি দেহোত্তীর্ণ প্রেমের ব্যাখ্যাকার। যে দেহমিলনের সঙ্গে হৃদয়ের যোগ নেই, 'আত্মার তন্তুর' বেষ্টন নেই, তা কাম্য নয়;
"... শোণিতের অস্থির আগ্রহে,হৃদয়ের আন্দোলনে, আত্মার তন্তুর আবেষ্টনেযেই প্রেম- তার মতো, তার মতো আর- কিছু? বলো!"
[কিছুই প্রেমের মতো নয়।
বাসনা-বিদ্যুতের সঙ্গে হৃদয়জড়ানো ভালোবাসার সন্নিপাতেই জেগে ওঠে শাশ্বত প্রেম। উপর্যুক্ত পঙ্ক্তি কটির সঙ্গে সুধীন্দ্রনাথ দত্তের শাশ্বতীর কয়েকটি পঙ্ক্তির ভাব-সাদৃশ্য বর্তমান। যেমন,
"একটি কথার দ্বিধাথরথর চূড়েভর করেছিল সাতটি অমরাবতী;একটি নিমেষ দাঁড়াল সরণি জুড়েথামিল কালের চিরচঞ্চল গতি;"
[শাশ্বতী, সুধীন্দ্রনাথ দত্তা]
ভালোবাসি এরকম একটি অস্ফুট কথার অনুচ্চারিত আবেগ দুটি কবিতাতেই সঞ্চার করেছে প্রেমোত্তাপ। কিন্তু শাশ্বতীর সাফল্য বুদ্ধদেবের কবিতায় অনুপস্থিত। শাশ্বতী বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রেমের কবিতা। পক্ষান্তরে, বুদ্ধদেব বসু এখানে প্রেমের ব্যাখ্যাকার মাত্র। প্রেমের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে বুদ্ধদেব বসু স্পষ্টত প্রেমের প্রতি পক্ষপাত দেখিয়েছেন। দেহমিলনে পরম পরিতৃপ্তি নেই- অপার তৃষ্ণা থেকে যায় প্রেম ও সৌন্দর্যের জন্য:
"অসীম বাসনা কাঁধে শরীরের সংকীর্ণ সীমায়,
এক হ'য়ে মিশে যায় আত্মা আর রক্তের পিপাসা,"
[হে ঈশ্বর এ কী অপরূপ]
বুদ্ধদেব বসু প্রেমের পরিণামে অমৃত স্পর্শই কামনা করেন: 'তোমার অমৃত-স্পর্শ দাও তার অসুস্থ আত্মায়' [ক্ষমাপ্রার্থনা]। বিবাহ কবিতায় সঞ্চারিত হয়েছে প্রেম-সম্ভোগের কঠিন আবেগোত্তাপ। কবি তার কামনা-স্পন্দিত চুম্বন পরিয়ে দিয়েছেন প্রিয়ার গলে, কালো চুলে, ললাটে-করতলে, জঙ্ঘায়, উরুতে-পদতলে; কিন্তু পরম পরিতৃপ্তি আসেনি। কবিতার শেষে উচ্চারিত হয়েছে দেহাতিরিক্ত প্রেমের প্রতি পক্ষপাত। বাসনা বিশ্বপ্লাবী, কিন্তু দেহ ক্ষুদ্র ও সীমাবদ্ধ। এজন্যেই কবি প্রিয়তমাকে অনিঃশেষ প্রেমের মালা পরাতে চান।
বুদ্ধদেব বসুর কঙ্কাবতীর প্রেমের কবিতার বিষয়, সৌন্দর্য ও আন্তর্জাতিক উপকরণ-উৎস সম্পর্কে উপর্যুক্ত আলোচনার পর লক্ষ করা যেতে পারে এর প্রথম দিকের কিছু রচনার সংবেদন-বৈচিত্র্য। প্রথম পর্যায়ের রচনায় রোমান্টিক অতিকথন ও আনন্দের পশ্চাদ্ধাবন সত্ত্বেও বুদ্ধদেব বসু তার প্রেমের কবিতাকে কাল-পরিপ্রেক্ষিতহীন অপার্থিব করে তুলেননি। তার এ পর্যায়ের রোমান্টিক কবিতাও, দু-একটি ক্ষেত্র বাদ দিলে, প্রায় কখনোই ভূমা-স্পর্শ বঞ্চিত হয়নি। কঙ্কাবতীর প্রথম পর্যায়ের রচনায় পারিপার্শ্বিক হিসেবে স্থান পেয়েছে আধুনিক নগর ও বাস্তব পৃথিবী। পাত্রপাত্রীকে তিনি সচল নাগরিক জীবন ও বাস্তব পৃথিবীর সঙ্গে যুক্ত করেছেন।
প্রেমের কবিতায় বুদ্ধদেব বসু বিশুদ্ধ অনুভূতির রূপকার হলেও তার কবিতায় আবেষ্টনী-চেতনার প্রকাশ সুস্পষ্ট। কঙ্কাবতী থেকেই এই আবেষ্টনী চেতনার সুস্পষ্ট প্রকাশ ঘটেছে। জীবনানন্দ দাশ প্রেমের কবিতার সঙ্গে ইতিহাসবোধ ও বিষ্ণু দে রাজনৈতিক চেতনার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। বুদ্ধদেবের প্রেমের কবিতায় দুয়ের কোনোটিই নেই, তবু পবিত্র অনুভূতির বিনির্মাণ হতে গিয়ে বুদ্ধদেব তার প্রেমের কবিতাকে অযৌক্তিক করে তুলেননি। আধুনিক বাস্তব পৃথিবীর শক্ত কংক্রিটের যন্ত্রায়িত নগরে নায়ক-নায়িকাকে তিনি স্থাপন করেছেন। তার পাত্রপাত্রীরাও বাস্তব, তারা পৃথিবী- পরিপ্রেক্ষিত ভুলে যায় না। কঙ্কাবতীর কয়েকটি কবিতায় অবশ্য এর অপপ্রয়োগ ঘটেছে। তবে গাঢ়তর অনুভূতি ও তীব্রতর আবেগ তার পাত্রপাত্রীকে যে আনন্দিত করে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। কঙ্কাবতীর প্রথম কবিতার মধ্যেই নায়িকার জন্যে অপেক্ষা-বিরহ প্রেমিকের উদ্বেল হৃদয়-স্পন্দন অনুভব করা যাবে, সাক্ষাৎ পাওয়া যাবে নাগরিক পরিপ্রেক্ষিত। চিঠি এবং হাতের লেখার মতো তুচ্ছ তথ্যও প্রেমের কবিতায় মহান হয়ে উঠেছে। যেমন,
"রাস্তায় গাড়ির শব্দ, তার পরে চাবুকের শিস,মুহূর্তের নীরবতা- আবার সে-চাকার ঘর্ঘর,ঘোড়ার খুরের খটখট।তার চেয়ে স্পষ্ট তার পদধ্বনি কাঠের সিঁড়িতে,আরো স্পষ্ট- আরো স্পষ্ট- দ্রুত শব্দ, দ্রুত পদক্ষেপ;উৎসুক ফুলের গন্ধ- বায়ু তারে করিছে লেহন,আবার চুলের গন্ধ- বাতাস কি এখনো বহিছে? [কাল]
চলচ্চিত্রের দৃশ্য-পরম্পরার মতো নায়িকার জন্য অপেক্ষাতুর নায়কের ঔৎসুক্য ও দ্রুততর হৃৎস্পন্দন পাঠক অনুভব করেন। বর্তমান শতাব্দীর তিনের দশকে, আধা-মফস্বল ঢাকার পুরানা পল্টনের পটভূমিকায়, কিশোর-প্রেমের নস্টালজিক আবেগ দানা বেঁধেছে তার কয়েকটি কবিতায়। এদের মধ্যে কোনো মেয়ের প্রতি এবং অন্য কোনো মেয়ের প্রতি কবিতায় কিশোর প্রেমের সহজ সাধারণ আবেগ ও প্রেমিকাদেহের প্রতি আকর্ষণ সৌন্দর্য পেয়েছে। একটি ভালোবাসায় সিক্ত প্রেমের কবিতা একখানা হাত। ঘরে ফেরার পথে একা ক্লান্ত কবির চোখে মধ্যরাতের ঘুমন্ত শহরের এক দু'তলার জানালায়, ঝলসে উঠেছিলো হীরের আংটি ও মণিবন্ধে বুলিসহ একটি সাদা হাত। মেয়েটির মুখ দেখা গেল না। স্মৃতিতে উজ্জ্বল করতে থাকলো একটি অনিন্দ্য সুন্দর হাত। বাড়ি ফিরে নিদ্রাহীন কবি জ্বলতে থাকল অনির্দিষ্ট রোমান্টিক বেদনায়,
"বিছানায় শুয়ে আছি, ঘুম হারায়েছে;না জানি এখন কত রাত;কখনো সে-হাত যদি ছুঁই, জানিবো না,এ-ই সেই হাত।" [একখানা হাত]
একজন সমালোচক জীবনানন্দ দাশের ধূসর পাণ্ডুলিপির পাখিরা কবিতার সঙ্গে একখানা হাতের কয়েকটি পঙ্ক্তির সাদৃশ্য খুঁজে পেয়ে মন্তব্য করেছেন যে বুদ্ধদেব বসু আসলে তিরিশের যুগের সাম্প্রতিক কবিমাত্র। জীবনানন্দ দাশের কবিতার বক্তব্যের সঙ্গে বুদ্ধদেবের কবিতাটির বক্তব্যগত কোনো সাদৃশ্য নেই। ধূসর পান্ডুলিপির প্রকাশকাল ১৯৩৬, বুদ্ধদেবের একখানা হাত কবিতার রচনাকাল যেমন, ১৯৩০। প্রকাশকাল সম্পর্কে সুস্পষ্ট তথ্য এবং দুটি কবিতার তুলনামূলক আলোচনা উপস্থাপন না করে একজন কবি সম্পর্কে সরলীকৃত মন্তব্য করা অনুচিত। একখানা হাত সম্পর্কে জীবনানন্দ দাশের মন্তব্য,
“এই কবিতাটি বাস্তবিক যা নয়- লঘু মুহূর্তে একে সেই তুচ্ছ জিনিস বলে মনে হতে পারে। কিন্তু কবিতা তো লঘু মুহূর্ত নিয়ে নয়। যেই আবহাওয়ার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এসে আমরা পরিচিত মুখকে পরিচিত মুখ বলে চিনি, সেই স্বপ্নের ধ্যান আবার যদি আমাদের চোখে জ'মে ওঠে তাহলে একখানা অচিহ্নিতপূর্ব্ব, অপরিচিত শাদা হাত, যা চিরকাল অপরিচিত থাকবে, তা আমাদের স্বাভাবিক জগতের ঘুমকে বিদীর্ণ ক'রে দিয়ে চ'লে যেতে পারে।"
উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বুদ্ধদেব বসুর এ পর্যায়ের প্রেমের কবিতায় ইন্দ্রিয়প্রত্যক্ষ রোমান্টিক উপকরণ-বৈচিত্র্য বিচার করে দেখা প্রয়োজন। প্রেমের কবিতা বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, আবেগের আতিশয্য সত্ত্বেও তার নায়ক-নায়িকারা আধুনিক পৃথিবীরই প্রতিনিধি, এবং তারা এমন সব ঈর্ষা, দ্বন্দ্ব ও বাসনা বহন করে যে তাদের অতি-মর্ত্য মনে হয় না।