বাংলা কথাসাহিত্যে ছোটগল্পের ধারায় সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর অবদান নির্ণয় কর। অথবা, "সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ছোটগল্পে বহির্বাস্তবতার তুলনায় মনোজগৎই বেশি প্রাধান্য পেয়েছে।"-আলোচনা কর।
বাংলা ছোটগল্পে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ হলেন এমনই স্থপতি, যার স্থাপত্যকর্ম যেমন দৃষ্টিনন্দন, তেমনই স্থাপন প্রক্রিয়াটিও উপভোগ্য, দাবি করে মনোযোগ। কোনো একটিকে বাদ দিলে ঠিক আস্বাদ মেলে না। তাই ওয়ালীউল্লাহর গল্পের পুনঃকথন সম্ভব হয় না। তার গল্প সংক্ষিপ্তভাবে পড়া যায় না, প্রতিটি শব্দ পড়তে হয়। গল্পের ভেতরের মূল অংশকে তেমন করে আলাদা করা যায় না। আবার নির্মাণভঙ্গিমাটিকে আলাদাভাবে দেখতে চাইলেও গল্পের প্রাণটি নষ্ট হয়। ওয়ালীউল্লাহর গল্প মানে তাই আগাগোড়া সচেতন পাঠ।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ মানবতাবাদী আধুনিক শিল্পী। তার সাহিত্যে অশিক্ষিত গেঁয়ো মানুষের কুসংস্কারাচ্ছন্ন জীবন ফুটে ওঠে। আবার মধ্যবিত্ত সমাজের ভেতরের অন্তর্জড়তা, দৈন্য ও কুপ্রীতা নগ্নভাবে প্রকাশ পায়। জীবনের অনেক বাস্তবতাই তার আদর্শবাদী মনকে কঠিনভাবে আঘাত করেছে। তার স্বাক্ষর উপন্যাস ও ছোটগল্পসমূহ। শুধু শিল্প হিসেবেও নয়, বাংলাদেশ ও বাঙালির বাইরের এবং অন্তর জীবনকে জানার জন্যে বাংলা ছোটগল্প একটি অপরিহার্য মাধ্যম। তার ছোটগল্পে ব্যক্তি ও সমাজ ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। তার অনেক গল্পের পটভূমি ছিল সমাজ। সমাজের সমস্যার মতোই বাক্তির অন্তর্জগতের সমস্যাও উপেক্ষণীয় নয়। ওয়ালীউল্লাহ ব্যক্তির সেই অন্তঃপুরের ছবি আঁকতে চেয়েছেন উপন্যাসের মতো ছোটগল্পেও।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর সাহিত্য জীবনের প্রথম দেড় দশকই মূলত তার গল্প লেখার কাল। পরে ক্রমে মগ্ন হয়েছেন উপন্যাসে। শেষ আবিষ্কৃত গল্পের হিসাবে সব মিলিয়ে ৫৩টি গল্প লিখেছেন। জীবনের প্রথম গ্রন্থটিই গল্পগ্রন্থ 'নয়নচারা' আর লেখকের দ্বিতীয় ও শেষ গল্পগ্রন্থ 'দুই তীর ও অন্যান্য গল্প'। দুটি গল্পগ্রন্থে সংকলিত গল্পের সংখ্যা ৮ ও ৯ মিলিয়ে মোট ১৭টি। অবশিষ্ট সব গল্পই অগ্রন্থিত থেকে যায় দীর্ঘকাল। ১৯৮৭ সালে বাংলা একাডেমি প্রকাশ করে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর গ্রন্থাবলি। পূর্ববর্তী ১৭টি গল্প ছাড়াও এ গ্রন্থাবলিতে আরও ৩২টি গল্প সংকলিত হয়। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত আরও ৪টি গল্প পরে পাওয়া যায়। সব মিলিয়ে গল্পসমগ্র আপাতত সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর গল্পের এক পূর্ণাঙ্গ সংকলন বলা যায়।
ওয়ালীউল্লাহর প্রথম গল্প 'নয়নচারা' প্রকাশিত হয় পূর্বাশা পত্রিকায়। সেসময় (১৯৪৩-৪৫) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও পঞ্চাশের মন্বন্তরের কালো ছায়া বাংলাজুড়ে। যুদ্ধ, অনাহার ও মৃত্যুর পটভূমিকায় 'নয়নচারা' ছাড়াও তিনি পরপর লিখেছেন 'মৃত্যু-যাত্রা', 'রক্ত'।. সমকালীন পটভূমিতে' তরুণ ওয়ালীউল্লাহর অন্তরস্থ রক্তক্ষরণই অনুভবে দরদে প্রকাশিত হয়েছে। যুদ্ধ-মন্বন্তর শুধু যে খিদে বাড়িয়ে দেয় তা নয়, লুটেপুটে নেয় আবাল্য স্নেহের কৈশোর ভূমিটুকুও। ভিটেছাড়া ঘরছাড়া মানুষের বুকের ভেতরের সবটুকু জমিন কেড়ে নিয়ে তাকে হাভাতে ভিখারি করে তোলে। আর কিছু নয়, চেয়েচিন্তে যে কোনোভাবে উদরপূর্তিই যার একমাত্র চাহিদা বলে সাধারণের বিশ্বাস, সেখানে ওয়ালীউল্লাহ শুরু করেন এভাবে, "ঘনায়মান কালো রাতে জনশূন্য প্রশস্ত রাস্তাটাকে ময়ূরাক্ষী নদী বলে কল্পনা করতে বেশ লাগে।" খিদে নয়, খিদের তাড়নে হা-অন্ন মানুষটির অন্তর্দেশ জুড়ে হারানো মাটি হারানো জীবনের হাহাকার। এও এক খিদে, যার তৃপ্তি নেই দু'মুঠো ভাতে। ফ্যানভাতের সন্ধানী মানুষটির সতৃষ্ণ আকাঙ্ক্ষা আসলে সেই মাটি এবং মা-টি। খিদে নয়, তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় স্মৃতি। খিদের মুখে দাঁড়িয়ে শুধু ভাত নয়, মনের ভেতর জুড়ে অন্য এক অনুসন্ধান প্রক্রিয়া নিয়ত ক্রিয়াশীল। 'নয়নচারা'য় যে সূচনা পরবর্তী তিন দশকের লেখালেখিতে সেই অনর্গল খোঁড়াখুঁড়ি। বহির্বাস্তব পরিবেশ পরিস্থিতি সময়ের সঙ্গে পা ফেলে ওয়ালীউল্লাহ আসলে খনন করে চলেন মানবমন, মানবভূমি, বহির্বাস্তবকে ছাপিয়ে যায় মনোবাস্তব।
সমাজচেতনা ও অন্তশ্চেতনার মিশেলে বাংলা গল্পভুবনের রূপমাধুর্য প্রকৃত অর্থেই বৈচিত্র্যময় হয়ে উঠতে থাকে। বাংলা ছোটগল্পে উঠে আসতে থাকে সাধারণ প্রান্তিক মানুষ ও তার মানসভূমি। এই অনুসন্ধানেই নিয়োজিত হন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ। তবে তিনি গল্প-লেখক নন, গল্পনির্মাতা। স্থাপত্য নির্মাণের পরও যেমন ধারাবাহিক ঘষামাজা চলতেই থাকে, তেমনই আপন সৃষ্টির প্রতি দরদ লক্ষ করা যায় এ লেখকের মধ্যেও। তার গল্প যেন তার আত্মজ। প্রকাশের পরও চলতে থাকে অদলবদল, পুনর্লিখন। লেখার প্রতি এ দরদ ও নিষ্ঠাই লেখক ওয়ালীউল্লাহর প্রাণবস্তু। লেখক নিজেই তার গল্পের পাঠক, নির্মম বিচারক।
প্রথম গল্পগ্রন্থ প্রকাশের প্রায় দু-দশক পরে সংকলিত হয় দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ 'দুই তীর ও অন্যান্য গল্প' (১৯৬৫)। এ গ্রন্থের ভূমিকাতেই প্রকাশিত হয় নিজস্ব গল্প নিয়ে লেখকের অতৃপ্তি ও পরিচর্যার দৃষ্টিভঙ্গি: "পূর্ব-প্রকাশিত গল্পগুলি এ সঙ্কলনের জন্য ঘষামাজা করেছি, নাম বদলেছি, স্থানে স্থানে লেখকের অধিকার সূত্রে বেশ অদল-বদলও করেছি।" দু-দশক আগে প্রকাশিত গল্প সংকলিত করবার আগে আগাগোড়া পরিমার্জন, নাম বদল (যেমন 'দুই তীর' গল্পের পূর্বনাম ছিল 'কালো বোরখা') করার মতো ধৈর্য শ্রম শুধু ওয়ালীউল্লাহর মতো গল্পনির্মাতারাই পারেন। তার অধিকাংশে গল্পেই লেখকের উপস্থিতি লক্ষণীয়। কারণ গল্পের চরিত্র, কাহিনির চেয়েও বড় হয়ে উঠেছে গল্পের নির্মাণশৈলী। শব্দবন্ধে কীভাবে বুনে চলেছেন গল্পের অবয়ব, তা অনেক বেশি মনোযোগ আকর্ষণ করে।
গল্পকথক থেকে গল্পনির্মাতা হয়ে ওঠা ওয়ালীউল্লাহর একটি বড় বৈশিষ্ট্য। সমকালীন অন্য লেখকদের মতো এই লেখককেও ব্যতিব্যস্ত রেখেছিল সমকাল ও বাস্তব অভিঘাত। এই বহির্বাস্তবকে ওয়ালীউল্লাহ ধরতে চেয়েছেন মনোবাস্তবের পরিপ্রেক্ষিতে। তাই তার গল্পশরীরে বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে অন্য মাত্রার ব্যঞ্জনা। খিদের সমস্ত চাহিদা আকাঙ্ক্ষা গ্লানিকে ছাপিয়ে আত্মানুসন্ধান স্পষ্ট করে তোলে মনোভূমি।
'জাহাজী' গল্পে সমুদ্রযাত্রায় জাহাজ পরিবার ছেড়ে বাড়ি চলে যাওয়ার ছাড়পত্র পেয়ে যায় ছাত্তার। করিম সারেংও ভাবে "এবার শেষ হবে তার সামুদ্রিক জীবন, এবার এ-অশান্ত জীবন থেকে সে মুক্তি পাবে।" জাহাজ বন্দরে পৌঁছবার পর করিম সারেং ছাত্তারের হাতে ধরিয়ে দেয় ঘরে ফেরার অসম্ভব আকুতিভরা ছাড়পত্র, "তুই বারিৎ যা গই, আর ন আইছ", আর বদলে নেয় নিজের সিদ্ধান্ত "আবার সে জাহাজে চুক্তি নেবে, এবং যদি পারে আমৃত্যু সমুদ্রের বুকেই বাস করবে।" ছাত্তারদের ঘর আছে আত্মীয়পরিজন সবাই আছে। কিন্তু করিম সারেংদের জাহাজ ছেড়ে যাওয়ার মতো কোনো ঘর নেই। জাহাজ-ই তাদের ঘরবাড়ি, তারা যে জাহাজি।
ওয়ালীউল্লাহর গল্পে নিসর্গ এসেছে চরিত্র হিসেবেই। 'পরাজয়' গল্পে নিসর্গ যেন সহযোগী পার্শ্বচরিত্র। গল্পনির্মাতা হিসেবে লেখকের এও এক নির্মাণকৌশল। অনেকটা একই আঙ্গিকে ভিন্নতর বোধে, মাত্রায় রচিত হয় 'মৃত্যু-যাত্রা' গল্পটি। একক কোনো নায়ক নয়, পঞ্চাশের মন্বন্তরই এ গল্পের নায়ক। আরও নির্দিষ্ট করে বলতে হয়, মন্বন্তরের পীড়নে পিষ্ট একটি মৃতদেহকে ঘিরে আবর্তিত এ গল্প। একটি শবদেহ, তা যেন নিষ্প্রাণ অমানবীয় বস্তু নয়, হয়ে উঠেছে মানবিক চরিত্র। "ওপারে বড় গাঁ, চাল পাওয়া যাবি নিশ্চয়।” এ আশায় মেয়ে-পুরুষের দল সঙ্গী বৃদ্ধের মৃতদেহের বাধা অতিক্রম করে চলে যায়। "এবং প্রান্তরের ধারে বৃহৎ বৃক্ষের তলে তার গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে বুড়োর মৃতদেহ বসে রইল অনন্ত তমিস্রার দার্শনিকের মতো।" আশ্চর্য বিস্ময়ে স্তব্ধ হতে হয় পাঠককে। এভাবেই একের পর এক তুলনাহীন স্বতন্ত্র নির্মাণ। 'একটি তুলসী গাছের কাহিনী', 'খুনী', 'দুই তীর', 'নিষ্ফল জীবন', 'নিষ্ফল যাত্রা', 'মালেকা', 'খণ্ড চাঁদের বক্রতায়', 'সেই পৃথিবী', 'পাগড়ি', 'কেরায়া', 'সতীন' প্রতিটি গল্পকেই ওয়ালীউল্লাহ স্থিতধী স্থপতির মতো ভারি মমতায়, কিন্তু কখনো কখনো নৈর্ব্যক্তিক নিষ্ঠুরতায় গড়ে তুলেছেন। আর এই নির্মাণক্রিয়ায় বড় রকমের প্রাধান্য পেয়েছে মননচর্চা।
'অবসর কাব্য' এমনই এক গল্প যেখানে মধ্যবিত্ত চরিত্রের ভাবনা
বেদনার নাটকীয় উপস্থাপনা। মনের গহিনে যে জটিল আবর্ত, তার
চোরাগলি সন্ধানে মগ্ন লেখক। মনে হয় সময়ের নিরিখে
ওয়ালীউল্লাহ অনেক বেশি নিবিষ্ট মনের জটিলতা বিশ্লেষণে। 'স্তন'
গল্পটি পুরোপুরি মনোবিকলনধর্মী গল্প। একটি শিশুর জন্ম দিয়ে
এক মার মৃত্যু, অন্য এক মা মাজেদার ষষ্ঠ সন্তান জন্মের পরই চলে
গিয়েছে কোল খালি করে। মা মরা সন্তানটিকে দুধ দেবার জন্য
মাজেদাকে নিয়োগ করা হয়েছে। সন্তানহারা মাজেদা প্রাথমিক দ্বিধা
কাটিয়ে মাতৃহীন দুধের শিশুকে কোলে তুলে নেয়, স্তন গুঁজে দেয়
শিশুর মুখে। কিন্তু দুধ যে নেই তার বুকে। শেষ পর্যন্ত তার মনে
হয় "কুচাগ্রে কী যেন আটকে আছে বলে দুধটা সরছে না।" সরু
দীর্ঘ একটি মাথার কাঁটা নিয়ে পরপর দুটি স্তনের কোঁটায়
তীক্ষ্ণভাবে বসিয়ে দেয় সে। "তার স্তন থেকে দুধ ঝরে, অশান্তভাবে
দুধ ঝরে। তবে সে-দুধের বর্ণ সাদা নয়, লাল।" এমনই আরও অনেক
গল্প, যার নির্মাণকৌশল গল্পশরীর সচকিত করে, বিস্মিত করে।
'না কান্দে বুবু'র প্রতি অনুচ্ছেদের নির্মাণপর্বে আশ্চর্য কারুকাজ। এর বর্ণনায় মেলে রূপকথা-স্বাদ। ওয়ালীউল্লাহর নির্মাণকলার অন্যতম উপাদান তার ভাষাবিলয়। জাদুকলমের অসাধারণ চারুতাগুণে ভাষা পায় অলংকারের সৌকর্য। 'অবসর কাব্য' এ "পৃথিবীময় মখমলের মতো রাত্রি এসেছে নিঃশব্দে।" 'স্বপ্নের অধ্যায়' এ "মাস্টারনিটির সঙ্গে তার ভাব হল, পাখির পালকের মতো উষ্ণ নরম ভাব।" জীবনানন্দ বলতেন, "উপমাই কবিতা"। ওয়ালীউল্লাহর গল্পশরীরের স্থানে স্থানে আশ্চর্য সব উপমায় মনের মধ্যে চারিয়ে যেতে থাকে কবিতা-অনুভব।
চরিত্রের অন্তর্গত যে মানুষ তারই উন্মোচনে ওয়ালীউল্লাহর স্বকীয়তা। এতটাই আন্তরিক গভীর উপস্থাপনা যাতে গল্পভূমির মানসজনে আবিষ্ট হয়ে ওঠেন পাঠক। বাংলা ছোটগল্পের বহতা স্রোতের যে অভিমুখটির সন্ধান পেতে কিছুটা অসুবিধে হতো, উপস্থিতি অনুভূত হতো জগদীশ, মানিক, জ্যোতিরিন্দ্রের সৃজনে, কিন্তু ঘনিষ্ঠভাবে ছোঁয়া যেত না তাকে, ওয়ালীউল্লাহর 'গল্পসমগ্র' একালের পাঠককে এনে দেয় সেই আস্বাদ অহংকার।