আদিম জীবন পিপাসার সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় - দাম্পত্য প্রেম পরাজিত - উক্তিটি 'তারিণী মাঝি' গল্প অবলম্বনে আলোচনা কর। অথবা, অস্তিত্ববাদী দৃষ্টিকোণ থেকে 'তারিণী মাঝি' গল্পের আলোচনা উপস্থাপন কর।
সময় ও সমকালের দ্বান্দ্বিক দ্বৈরথে বিক্ষত, প্রবৃত্তিতাড়িত ও নিয়তি শাসিত মাটিঘেঁষা মানুষের চারুশিল্পী তারাশঙ্কর। কল্লোলীয় নাস্তির কুণ্ডলী ছিড়ে রাঢ় বাংলার গ্রামীণ জীবনকে আশ্রয় করে তারাশঙ্কর নির্মাণ করেছেন মানবাত্মার শাশ্বত জয়গাথা, চিরায়ত মানবধর্মের মাঙ্গলিক মূর্ছনা। ব্রাত্যমানুষের আদিম জৈবচেতনার কুণ্ঠাহীন উপস্থিতি তারাশঙ্করের অনেক গল্পে বিশেষভাবে লক্ষণীয়। অস্তিত্ববাদী জৈবচেতনার গল্প হিসেবে 'তারিণী মাঝি' গল্পটি তার এক বিস্ময়কর সৃষ্টি।
'তারিণী মাঝি' গল্পের প্রেক্ষাপট প্রত্যক্ষ বাস্তব, লেখকের নিজের চোখেই দেখা জীবনের কাহিনি। একটি নদী ও কয়েকটি চরিত্রকে ঘিরেই সে কাহিনি আবর্তিত। ময়ূরাক্ষীর গনুটিয়া ঘাটের খেয়া- পারাপারের মাঝি তারিণী। সংসারে তারা মানুষ মাত্র দুজন। তারিণী নিজে আর তার স্ত্রী সুখী। তারিণীর সংগ্রামশীল জীবনে প্রাচুর্য না থাকলেও সুখ ও শান্তির কোনো অভাব ছিল না। তন্বী, উচ্ছল, উজ্জ্বল-শ্যামবর্ণা সুন্দরী সুখীর জন্য তারিণীর আনন্দের কোনো সীমা নেই। সুখীও তারিণীর প্রতি ছিল গভীরভাবে আকৃষ্ট, স্বামীর প্রতি তার ভালোবাসা ও বিশ্বাস ছিল অটল। অন্যদিকে, তারিণীর জীবিকার উৎস ময়ূরাক্ষীর নদীর সঙ্গেও তার সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। ময়ূরাক্ষীই বাঁচিয়ে রেখেছে তারিণীকে, ময়ূরাক্ষীর স্রোতোধারা থেকেই সে পেয়েছে বেঁচে থাকার সঞ্জবনী শক্তি। কিন্তু একদিন এ জীবন পালিনী ময়ূরাক্ষীই তারিণী ও সুখীর জীবনে দেখা দেয় ভয়ংকর রাক্ষসী রূপে।
ময়ূরাক্ষীর হড়পা বানে ঘরবাড়ি সব ডুবে গেলে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে যাত্রা শুরু করে এ দুই মানব-মানবী। তারিণীর কোমর ধরে রইল সুখী, চলল তারা নিরাপদ ভূমির সন্ধানে। কিন্তু দৈব- দুর্বিপাকে তারা পড়ে গেল নদী গর্ভে। এরপর শুরু হলো তারিণীর জীবনসংগ্রাম, অনিবার্য মৃত্যুর ছোবল থেকে নিজেকে এবং সুখীকে রক্ষা করার আকুল সংগ্রাম। কিন্তু এক সময় তারা পড়ে গেল ময়ূরাক্ষীর ঘূর্ণিতে। সমস্ত শক্তি দিয়ে চেষ্টা করেও তারিণী পারল না ঘূর্ণি থেকে নিজেকে মুক্ত করতে। স্ত্রী সুখীর দৃঢ় বন্ধনে তারিণীর দেহও অসার হয়ে আসে, সুখীর বন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করে তারিণী, ব্যর্থ হয়ে অবশেষে সমস্ত শক্তি দিয়ে দুহাতে চেপে ধরে সুখীর গলা, খসে পড়ে পাথরের মতো দুর্বার সুখী। জীবন সত্যের অপার রহস্য উন্মোচন করে মাতৃরূপী ময়ূরাক্ষীর জলে ভেসে ওঠে আলো ও মাটি প্রত্যাশী তারিণী মাঝি- তারাশঙ্করের এ গল্পে ধ্বনিত হয়েছে শাশ্বত ও চিরকালীন জীবধর্মের জয়ধ্বনি। চরম মুহূর্তে মানুষের কাছে আপন জীবন ছাড়া অন্যকিছুই প্রিয়তর নয়-কর্তব্যবোধ, ভালোবাসা, দাম্পত্য সম্পর্ক কিছুই নয়। এ অস্তিত্ববাদী অন্ধ জৈবধর্মের জয়ই এ গল্পে রূপায়িত।
তারিণী মাঝি গল্পে প্রাধান্য পেয়েছে আদিমতাধর্মী জীবনের প্রতি টান এবং মানবজীবনের মহিমা। তারিণী ও তার সহযোগী কালাচাঁদ সেই জীবনের অঙ্গনেই চলাফেরা করেছে। প্রথমটি অনাবৃত যথাতথা, এদের অপরিশীলিত অমার্জিত জীবন স্বভাবে যার প্রকাশ। দ্বিতীয়টি সেই প্রবল জীবনের স্বভাব তীব্র উদাত্ততা। তারিণীর বর্বরতা যেমন সহজ-স্বাভাবিক, তেমনি উদাত্ততার মহিমা মিশ্রিত।
মানবিক বৃত্তির সঙ্গে জৈব বৃত্তির সংঘাতের জটিলতা নিয়েই গড়ে উঠেছে তারাশঙ্করের গল্পের জগৎ। জীবনের বিপুল অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে তার মধ্য থেকে আবিষ্কার করতে চেয়েছেন তিনি তারিণীর আদিমতাধর্মী জীবন রহস্যকে। সে কারণেই গল্পটি যেমন অস্তিত্ববাদী জৈব প্রবৃত্তিনির্ভর, তেমনি উদার অনাবৃত্তি সেই জীবনের ছবি। ময়ূরাক্ষীর জলের রাজত্বে যে মানুষ জীবকুলের একমাত্র ত্রাণকর্তা, সেই মানুষটিই একসময় নিজের প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে ভয়ংকর জলস্রোতে ছেড়ে দিয়েছে নিজের প্রিয়তমাকে। তারিণীর ট্র্যাজেডি নিজের স্ত্রীকে ত্রাণ করার অক্ষমতায় নয়, নিজেকে ত্রাণ করতে গিয়ে স্ত্রীর দৈহিক বিনাশেও নয়, তার চেয়ে বড় কথা যে বিনষ্টি তার হাতে ঘটেছে তা হলো মনুষ্যত্বের। অথচ এ মানুষটিই কিছুক্ষণ আগ পর্যন্ত নিজের বিপদের কথা বিন্দুমাত্র চিন্তা না করে অন্যদের বাঁচিয়েছে। গল্পের শেষে তারিণীর জীবনের এমন ভয়াবহ ট্র্যাজেডি পাঠককে বিমূঢ় স্তব্ধ করে দেয়।
তারাশঙ্করের ছোটগল্পের প্রাণ 'মানুষের ধাতু প্রবৃত্তি'। 'ধাতু প্রবৃত্তি' বলতে বুঝানো হয়েছে মানুষের আদিম বৃত্তি অর্থাৎ 'Elemental passion' কে। মানুষের মধ্যে যে জৈবিক বেগের প্রাবল্য, তারই মৌলিক স্বভাবের কাছে সে অসহায়। এ সম্পর্কে
তারাশঙ্করের শ্রেষ্ঠ গল্পের ভূমিকায় জগদীশ ভট্টাচার্য লিখেছেন- "আত্মরক্ষার আদিম প্রবৃত্তির হাতে মানুষের প্রেমনির্ভরতার চরম পরাভবের ট্র্যাজেডিই এ গল্পের উপজীব্য। নিয়তির লীলা-রহস্য
একেবারে অন্তিম মুহূর্তে একাগ্র অনিবার্যতায় আত্মপ্রকাশ করেছে।" 'তারিণী মাঝি' গল্পে তারিণী আগে চেয়েছিল নিজের জন্য 'মদ' তারপর সুখীর জন্য 'নথ'; আগে জৈব প্রবৃত্তি, তারপর মানসিক হৃদয়বৃত্তি। মানুষের জীবনে 'দেহরক্ষা'র প্রতিযোগিতায় মৌল প্রবৃত্তি এবং মনে মনে মিল চাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় হৃদয়বৃত্তি দুটোই ওতপ্রোতভাবে জড়িত। টিকে থাকার চেষ্টায় তারিণী প্রেমকে হত্যা করেছে। অপরদিকে, জীবনে আলো ও মাটির প্রত্যাশায় তার মন বৃত্তির চূড়ান্ত আশ্রয় লাভ করেছে।
'তারিণী মাঝি' গল্পের নির্মম পরিণাম ক্রুর ভয়াবহ হলেও লেখকের বক্তব্যের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য এর মধ্যেই নিহিত। মনুষ্যত্বের শ্রেষ্ঠতম মাপকাঠি প্রেমের চূড়ান্ত পরাজয় প্রবৃত্তি তাড়নাসম্ভূত জৈব শক্তির কাছে। অপরদিকে, গল্পের পিনদ্ধ একমুখী পরিণতিতে তারিণীর জীবনে সত্যের একমাত্র উপায়টিও চিহ্নিত হয়েছে সুচারুরূপে দুটি অভিপ্রায়িক শব্দ- 'আলো ও মাটি'র জন্য তার আকুল আকাঙ্ক্ষায়। জীবন ধর্ম ও প্রাণ ধর্মের মধ্যে কোনটি বলবত্তর লেখক তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। মূলত লেখকের নিরাসক্তির কারণেই এ গল্পের বিষয়বস্তুর পরিণতিতে হৃদয়হীনতার চরমে উপনীত হয়েছে।