'মাটি' গল্পের বিষয় ও শিল্পরূপ মূল্যায়ন কর। অথবা, 'মাটি' গল্পের শিল্পসাফল্য বিশ্লেষণ কর।
বাংলা সাহিত্যে তারাশঙ্করের প্রথম আত্মপ্রকাশ গল্পকার রূপে। তার প্রায় সমগ্র গল্পের কেন্দ্রীয় ও অন্যান্য চরিত্র দেশজ- তাদের মানসিকতা ও জীবনধর্মিতার মূলে দেশের মৃত্তিকার গভীরে প্রোথিত এবং চরিত্রগুলো প্রচন্ডভাবে জীবনধর্মী। তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে চরিত্র আহূত হলেও, রাঢ় অঞ্চলের আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হলেও জীবনদর্শনের স্পর্শ লাভ করে চরিত্রগুলো আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য অতিক্রম করে যেন চিরন্তন রসমূর্তি লাভ করেছে।
'মাটি' গল্পে জমিদার ও জাহাজ বা স্টিমার কোম্পানির জন্য গ্রামীণ কৃষক থেকে জীওনলালের কলকাতায় মাটিওয়ালায় পরিণত হওয়ার কাহিনি বর্ণিত হয়েছে। একই সঙ্গে ভূমি ও বাড়ি থেকে উচ্ছেদ হওয়া জীওনলালের অজান্তে প্রতিবাদ সংঘটিত হয়েছে লছমনিয়াসহ গঙ্গার তীরে জঙ্গলের ভিতরে পুরোনো ইমারতের সুড়ঙ্গ পথের পাথর সরানোয়, বানের পানিতে স্টিমার স্টেশন, গ্রাম ভেসে যাওয়ার মধ্য দিয়ে। তবে এ ঘটনায় জীওনলালের পাঁচ বছর ও লছমনিয়ার দুই বছর জেল হয়। জীওন কলকাতায় এসে মজুর খাটা বা চাকরি করার চিন্তা করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত গঙ্গার ভাটিতে মাটি ভেসে উঠলে মাটি হাতে নিয়ে ঘেঁটে, পিষে, গন্ধ শুঁকে দুহাত ভরে তাল বেঁধে ওঠে আস্তানার খোঁজে দুপুর রোদে পাড়ায় ঢুকলে জনৈক খোকী মাটিওয়ালা বলে ডাকায় মাটি বিক্রি করে জীবিকার সন্ধান লাভ করে। পরিণত হয় মাটিওয়ালায়। খেতের মালিক জীওনলাল হয়ে যায় মাটিওয়ালা মেওয়ালাল।
কেন্দ্রীয় চরিত্রের উপস্থিতি গল্পের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেখা যায়। আর মধ্যবর্তী চরিত্র একবার, পার্শ্ববর্তী চরিত্র গল্পে কয়েকবার দেখা যায়। 'মাটি' গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র মাটিওয়ালা মেওয়ালাল ওরফে জীওনলাল, মধ্যবর্তী চরিত্র হিসেবে রতনলাল, পার্শ্বচরিত্র হিসেবে লছমনিয়াকে দেখা যায়।
গল্পে জীওনলাল চরিত্র দেখানো হয়েছে মাটিওয়ালা হিসেবে। জীওনলাল এক সময় খেতের মালিক ছিল। কিন্তু খেতের মালিক জীওনলাল হয়ে যায় মাটিওয়ালা মেওয়ালাল। তার চরিত্রে কোনোপ্রকার দাগ লাগতে দেননি লেখক। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত জীওনলালকে সহজসরল চরিত্র হিসেবে তুলে ধরেছেন। জীওনলাল এতটাই সরল যে- বাবুজির মিথ্যাকে সে বড় করে দেখে না। বাবুজির উক্তির মধ্য দিয়ে তা প্রকাশ পায়, "সহজসরল মানুষ- তাই এত সহজ করে ওর সন্দেহ থেকে নিষ্কৃতি পেয়েছি।"
সহজসরল মানুষ জীওনলাল চরিত্রে লেখক প্রেমিক সত্তার দিকটি ফুটিয়ে তুলেছেন। লছমনিয়াকে সে ভালোবাসে, কিন্তু সাহস হয় না বলার। কিন্তু গঙ্গাজীর কিনারের পোড়াবাড়ির ইমারতে যখন তার খুব কাছাকাছি থাকে, তখন তারা আর থেমে থাকতে পারেনি। জীওনলালের উক্তিতে তার চরিত্রের প্রেমিক সত্তার দিকটি দেখিয়েছেন- "গাছের ফাঁকে ফাঁকে আলো ছোট একটা টুকরো ছটা তার মুখের উপর পড়েছিল। সে মুখের চেহারা দেখে মেওয়ালালের দিশা হারিয়ে গেল, বলতে পারল- পিয়ারী।
মুখে শুধু একটি কথা সে
গল্পের অন্যতম চরিত্র হলো লছমনিয়া। পার্শ্বচরিত্রের মধ্যে তাকে ধরা হয়। গল্পে জীওনলাল অর্থাৎ কেন্দ্রীয় চরিত্রের পাশাপাশি পার্শ্বচরিত্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সে সাহসী, তেজস্বী, প্রেমময়ী 'এক নারী। ছোটবেলায়, বারো বছর পর্যন্ত তার তিনবার বিয়ে হয়, কিন্তু প্রত্যেকটা স্বামী মারা যায়। তাই সে বলে, "আবারও যদি সাগেয়র ব্যবস্থা কর, তবে আমি দরিয়ায় ঝাঁপ দেব, নয় তো জহর, মানে বিষ খাব।" তাছাড়া জমিতে সাহেবরা যখন তার হাত ধরেছিল, তখনও সে হাত ঝাঁকি দিয়ে ছাড়িয়ে নিয়েছিল।
গল্পের মধ্যবর্তী চরিত্র রতনলাল। রতনলালের ইচ্ছে ছিল ছেলে লেখাপড়া শিখে আদালত কি জমিদারি কি। কাছারি কোথাও কলম ধরুক। কিন্তু তার সে আশা পূরণ হয় না। অকস্মাৎ তার মৃত্যু ঘটে। অর্থাৎ 'মাটি' গল্পে রতনলালের ভূমিকা খুব বেশি নয়, তবুও যতটুকু ভূমিকা রেখেছিল, তাতেই চরিত্রটি গুরুত্ব বহন করে।
এছাড়াও 'মাটি' গল্পে কালো সাহেব, গল্পকথক বাবুজি, জনৈক খোকী ও তার মা প্রভৃতি নানাপ্রকার চরিত্রের সমাবেশ ঘটেছে, যাদের উপস্থিতি গল্পে খুব সামান্য। কিন্তু সামান্য হলেও গল্পের প্রতিটি চরিত্র খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
যেকোনো গল্পে দুই ধরনের দৃষ্টিকোণ বা দৃষ্টিভঙ্গি ব্যবহৃত হয়। যথা: ১. সর্বজ্ঞ দৃষ্টিকোণ ও ২. উত্তম পুরুষের দৃষ্টিকোণ। লেখকের দৃষ্টিভঙ্গিকে সর্বজ্ঞ দৃষ্টিকোণ এবং চরিত্রের দৃষ্টিভঙ্গিকে উত্তম পুরুষের দৃষ্টিকোণ বলা হয়। জীওনলাল ওরফে মাটিওয়ালা মেওয়ালালের বর্ণনায় লেখকের সর্বজ্ঞ দৃষ্টিকোণ প্রকাশ পায়- "বিচিত্রদর্শন উলঙ্গপ্রায় মানুষ। পরনে শুধু একটা নেংটি; সর্বাঙ্গ কাদায় আবৃত। সন্ন্যাসীরা যেমন ভস্মে সর্বাঙ্গ আবৃত করে তেমনিভাবে কাদায় মাখা লোকটির সর্বাঙ্গ।"
গল্পের বেশিরভাগ জায়গায় লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পেয়েছে। লছমনিয়ার উক্তির মধ্য দিয়ে জীওনলালের চরিত্র বর্ণনা করা হয়- "গাল কপাল যে আনারের দানার মত টসটসে লাল হয়ে উঠল। এ একেবারে খাস মেওয়ালাল তুমি।" এটি হলো উত্তম পুরুষের দৃষ্টিকোণ। এ উক্তির মধ্য দিয়ে জীওনলাল চরিত্রকে বুঝানো হয়েছে।
পরিচর্যা রীতি গল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। 'মাটি' গল্পে লেখক পরিচর্যা রীতির ব্যবহার ঘটিয়েছেন। গল্পের শুরুটা হয়েছে একটি নাটকীয় পরিচর্যায়- "উত্তর কলকাতার অধিবাসীদের অন্তত সিকি লোক লোকটিকে বোধ হয় চেনে, অর্ধেক লোক ওর কণ্ঠস্বর শুনেছে এবং শুনলেই চিনতে পারে- এ সেই কণ্ঠস্বর।"
এখানে মাটিওয়ালা মেওয়ালাল সম্পর্কে নাটকীয়ভাবে বলা হয়েছে। লছমনিয়ার চরিত্রের বর্ণনায় বর্ণনাধর্মী পরিচর্যা রীতির প্রকাশ ঘটেছে- "লছমনিয়া মেওয়ালালের চেয়ে বয়সে বছর খানেকের বড়ই হবে। তেমন কি তার চেহারা! দেখে মনে হ'ত পাঞ্জাব দেশের রহনেওয়ালী। এই লম্বা বাবুজী। বাঁশির মত নাক, পাঞ্জাবী মেয়েদের মতই চোখ ছোট ছোট। গায়ের রঙ কিন্তু কালো। মেয়েটাকে মুসহরেরা বলত 'সাপিন'। সাপিনের মতই লম্বা-তেমনি চোখ চেহরাতেও যেমন- ভাগ্যের দিক থেকেও তাই।"
উপমাগুলো ব্যবহারের মধ্য দিয়ে কাব্যিক পরিচর্যা রীতির প্রকাশ ঘটে থাকে।
প্রতীকী ব্যঞ্জনায় মেওয়ালালের মাটিওয়ালা হয়ে ওঠার কথা বলা হয়েছে। "অপরাহ্ণের প্রারম্ভকালের মাধুর্যটুকু যেন অকস্মাৎ চমকে উঠল তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বরের বেসুরা ভঙ্গির হাঁকে।"
প্রকৃতির চিত্র ফুটিয়ে তোলার মাধ্যমে জনজীবনের পরিচয় দেওয়া হয়েছে। "বাড়ির পিছনেই তালগাছ- ঘেরা খিড়কির পুকুরের কোন তালগাছের মাথায় বসে রৌদ্রশ্রান্ত চিল তীক্ষ্ণ-করুণ সুরে ডাকছে চি-লো-চি-ল-অ। শেষে অ-কারটা ঠিক এমনি বেপর্দায় নরম সুরে নেমে এসে থেমে যায়। চিলটার ঠোঁটের নীচে গলার কাছটা ধুক-ধুক করে কাঁপে।"
একটি রচনার গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ভাষা। 'মাটি' গল্পটি গল্পকথকের মুখের ভাষা চলিত রীতিতে এবং মেওয়ালালের ভাষাকে গঙ্গাজীর কিনারের মানুষের উপযোগী মুখের ভাষায় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। "উত্তর কলকাতার অধিবাসীদের অন্তত সিকি লোক লোকটিকে বোধ হয় চেনে, অর্ধেক লোেক ওর কণ্ঠস্বর শুনেছে।” লছমনিয়া ও মেওয়ালালের কথপোকথনের মধ্য দিয়ে চরিত্র উপযোগী ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে।
'মাটি' গল্পে জীবনসত্যের নানা দিক তুলে ধরা হয়েছে। জীবনের প্রশস্ত ও প্রসন্ন রূপটি প্রকাশ করা হয়েছে জীবনবোেধ তুলে ধরার মধ্য দিয়ে। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় 'মাটি' গল্পের বিষয় ও শিল্পরূপ দক্ষতার সাথে তুলে ধরেছেন।