জগদীশ গুপ্তের 'অসাধু সিদ্ধার্থ' উপন্যাসে মানবপ্রবৃত্তির যে বিভিন্ন প্রান্ত উন্মোচিত হয়েছে তা আলোচনা কর।

জগদীশ গুপ্তের অসাধু সিদ্ধার্থ উপন্যাসে মানবপ্রবৃত্তির যে বিভিন্ন প্রান্ত উন্মোচিত হয়েছে তা আলোচনা কর।
জগদীশ গুপ্ত (১৮৮৬-১৯৫৭) অসাধারণ একজন কথাসাহিত্যিক। তিনি তার অধিকাংশ উপন্যাসের চরিত্রগুলোর মাধ্যমে মানুষের ভিতরকার বিভিন্ন রহস্য উন্মোচন করেছেন। মানুষের বাহ্যিক অবয়বের আড়লে যে হীনতা, নীচতা, ছলচাতুরী থাকতে পারে আবার সুখী মানুষের অন্তর্দাহ, অতৃপ্তি বা অন্তর্দ্বন্দ্ব থাকতে পারে এসব ব্যাপার ফুটিয়ে তুলেছেন তার উপন্যাসে। অর্থাৎ মানবপ্রবৃত্তি বহুমুখী আর এই বহুমুখিতার উন্মোচন করেছেন জগদীশ গুপ্ত তার অসাধু সিদ্ধার্থ (১৯২৯) উপন্যাসে।
উপন্যাসটির কেন্দ্রীয় চরিত্রের নাম সিদ্ধার্থ। কিন্তু এটি তার ছদ্মনাম, তার প্রকৃত নাম নটবর। সে আসলে বৈষ্ণবীর ঘরে এক ব্রাহ্মণের জারজ পুত্র, মুদি দোকানের প্রায় বিনি পয়সার চাকর, শখের থিয়েটারে ছোকরা অভিনেতা, এমনকি টাকার বিনিময়ে বৃদ্ধা বেশ্যার শয্যাসহচর ও তার সেবক। কিন্তু এতসব অতীতকে পিছনে ফেলে সে নিজেকে পরিবর্তন করতে চেয়েছিল। তাইতো, নটবর নামের এই লোকটি সিদ্ধার্থ নামের এক শুদ্ধচরিত্র ব্যক্তির ছদ্মবেশ ধারণ করে এসেছে। আর তার দৈহিক অবয়বটাও এর সঙ্গে খাপ খেয়েছে। লেখকের ভাষায়, "সিদ্ধার্থের ঋজু বলিষ্ঠ দেহ, বর্ণ গৌর, মুখে বুদ্ধির দীপ্তি, এমনি করিয়া সে মাটিতে পা ফেলিয়া চলে যেন পৃথিবীর যাবতীয় প্রতিকূলতা আর বিমুখতা সে অতীব অবজ্ঞার সহিত দু-পা দিয়া মাড়াইয়া চলিয়াছে। মানুষের সঙ্গ দিয়া, সাহচর্য দিয়া তার কোনো প্রয়োজন নাই, সহানুভূতির সে ধার ধারে না।" আসলে লেখক ছদ্মবেশী সিদ্ধার্থ চরিত্রের দুটো দিক উন্মোচন করেছেন। উপরিউক্ত দিকটি সিদ্ধার্থের বাহ্যিক রূপ, এর বাহিরেও তার ভিতরের একটি রূপ আছে। আসলে সে ভিতরে দুর্বল, পরমুখাপেক্ষী। তাইতো, তার ভিতরের রূপ। এ সম্পর্কে লেখকের ভাষ্য- 'কিছুদিন হইতে সেখানে অগ্নিগিরির অগ্নিবমন শুরু হইয়া গেছে, ভিতরে সে শ্রান্ত, অতিশয় পরমুখাপেক্ষী।"
লেখক খুব সুন্দরভাবে আগ্নেয়গিরির সাথে সিদ্ধার্থের তুলনা করে দেখিয়েছেন। আগ্নেয়গিরি শান্ত দেখালেও তার আগ্নেয় চাপা থাকে অভ্যন্তরে ঠিক তেমনি মানুষের মনের সচেতন অংশ শান্ত ও সামাজিক হলেও এর মধ্যেই অবদমিত হয়ে থাকে সচেতন ও অসামাজিক আকাঙ্ক্ষা। যা কখনো কখনো সচেতন অংশে উঠে এসে মানুষের মানসিকতায় বিকৃতি ঘটায় এবং বিপর্যয় নেমে আসে। তাইতো আগ্নেয়গিরির সঙ্গে সিদ্ধার্থের মানসিক অবস্থার তুলনা মনঃসমীক্ষণের দৃষ্টিভঙ্গিতে গুরুত্বপূর্ণ। কেননা পারিপার্শ্বিক বিভিন্ন অবস্থার প্রেক্ষিতে সিদ্ধার্থের মানসিকতার অচেতন অংশ উঠে এসে অনেক সময় তার কথাবার্তা এবং আচরণের মাধ্যমে তার চিত্তের রূপটি প্রকাশ করে। সিদ্ধার্থ যখন দেবরাজের সাথে অন্ধকার প্রসঙ্গে কথা বলে তখন দেবরাজ ফিক করে হেসে হেসে বলে- "অন্ধকার কোথায়? দিব্যি দিনের মত ফুটফুটে জ্যোছনা।"
কিন্তু দেবরাজকে অন্ধকারাচ্ছন্ন জায়গাটি বুঝানোর জন্য তার ডান হাত বুকের উপর টেনে নিয়ে সিদ্ধার্থ বলে- "অন্ধকার এইখানে।" সিদ্ধার্থের এই উক্তি থেকে মনে হতে পারে তার মনে অপরাধবোধ গভীরভাবে জাগ্রত হয়েছে। কিন্তু এখানে অপরাধবোধের চিত্রটি ফুটে উঠলেও অপরাধ সম্পর্কে তার কোনো স্বীকৃতি নেই। সিদ্ধার্থ বলেছে, "কান পেতে থাকো একটা শব্দ শুনতে পাবে। ভগবানের অভিসম্পাত বুকের গহ্বর জুড়ে চেপে বসে আছে; তার ভেতর থেকে অবিশ্রান্ত উঠছে পৃথিবীর ক্ষুধার গোঙানি।"
সিদ্ধার্থের এসব কথার মাধ্যমে বুঝা যায় তার অহংশক্তির দুর্বলতা। হয়তো অনেক সময় মনে হয় সবকিছু নির্ধারিত। ইচ্ছে থাকলেও জীবনের একটি আবদ্ধ বেড়াজাল পেরিয়ে বেরিয়ে আসা যায় না। আবার তার মুখেই যখন মনের ভেতরের অন্ধকারের প্রসঙ্গ আসে তখন মনে হয় সে তার অপরাধবোধে অনুতপ্ত, সে সহজ স্বীকারোক্তির মাধ্যমে তার অপরাধবোধ প্রকাশ করছে। কিন্তু শেষমেশ বিষয়গুলো অধিক জটিল আকার ধারণ করে অন্তর্দাহ সৃষ্টি করে। বাইরের কোনো উত্তেজনার সূত্র ধরে অবচেতনের অপরাধবোধ এবং অপরাধের শান্তির জন্য বেদনাবোধ সিদ্ধার্থের চেতনার উপরের স্তরে চলে আসে। এই মানসিক বিপর্যয় সিদ্ধার্থের কাছে এক বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা। তার মানসিক বিপর্যয়ের এই পর্যায়ে তার কাছে প্রস্তাব আসে তমসুক জাল করে অর্থ সংগ্রহ করার। কিন্তু এই প্রস্তাবের মাধ্যমে তার অপরাধবোধ জাগ্রত হওয়ার তীব্রতা চমৎকার বিবরণের মাধ্যমে উপন্যাসে দেখানো হয়েছে। আর এ শাস্তির ভীতিজনিত আতঙ্ক কেবল তার মনের স্তরেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, দৈহিক বিকারের মধ্য দিয়েও তা প্রকাশ লাভ করে। লেখকের ভাষ্য মতে, "সিদ্ধার্থ তক্তপোষের কিনারাটা আঙুল বাঁকাইয়া চাপিয়া ধরিয়া উপরের দিকে টানিতে লাগিল। বলিল, দাঁড়াও- টানিতে টানিতে হাত দুখানা তার টান টান হইয়া সমস্ত দেহটাই খাড়া হইয়া দেখিতে দেখিতে আড়ষ্ট শক্ত হইয়া উঠিল।
সিদ্ধার্থের কার্যকলাপে মানবপ্রবৃত্তির দ্বিমুখী প্রান্ত উন্মোচিত হচ্ছে। সে ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে নিজের আসল পরিচয় দিতে পারছে না বরং কপটতা করে সিদ্ধার্থ নামটা ব্যবহার করছে আবার অন্য কারও আনীত অনৈতিক প্রস্তাব গ্রহণ করতেও সে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছে। লেখক এখানে মানবচিত্তের একাধিক প্রান্ত দেখিয়েছেন। তাইতো, লেখক বলেছেন, "সত্যই একটা দ্বন্দ্ব চলিতেছিল। যতদূর অধঃপতিত এবং হীনতার মান বলিয়া সিদ্ধার্থ পরিচিত তাহা একেবারেই ভুল না হইলেও দুর্বিপাকের ভিতর পড়িয়াও তার অপেক্ষাকৃত শিক্ষিত মনে দেবরাজের অনুমানের অতীত একটা স্থানে কু ও সু এর কলহ এখনো ঘটে।" 
উপন্যাসটিতে লেখক সিদ্ধার্থ চরিত্রের একটি অংশ দেখিয়েছেন যেখানে নীতিবোধ প্রবলভাবে ধারণ করে আছে। আর এই প্রবল নীতিবোধের অংশটুকুই তার যাবতীয় অপকর্মের সমালোচনা করে এবং তার ভিতরে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করে। হীন জীবনযাত্রার মধ্যেও চরিত্রের যে সততার দিক রয়েছে সেটি রক্ষা করার জন্য তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করেন। তাই বলা হয়েছে, "চোখে পড়িল, জীবনের অতীত ইতিহাসের সমস্তটা-তার যত দুষ্কৃতি, যত অপকার্য, যত অধর্ম। কিন্তু সিদ্ধার্থের মনে হইল, তারাও যেন একটা নির্দিষ্ট সীমার বাহিরে তাকে আনিতে পারে নাই- সমতল ভূমির উপর শিলাস্তূপের মত কঠিনতম আর উচ্চতম হইয়া উঠিল চোখের সম্মুখে এইটাই। কাহারো সর্বনাশ সে কখনো করে নাই; নিরাশ্রয় অন্নের কাঙাল করিয়া কাহাকেও সে পথে বসায় নাই।” সিদ্ধার্থ দুষ্কৃতি, অপকর্ম এবং বহু অধর্মের কাজ করেছে কিন্তু সে দেবরাজের তমসুক জাল করার প্রস্তাবে বিমূঢ় হয়ে পড়ে। সে ভাবে, মানুষের মনে কতদূর গভীর ইতরতায় নিঃসংশয় বিশ্বাস জমলে তার সে এমন হীন প্রস্তাব নিয়ে আর একজনকে টাকার লোভ দেখাতে আসতে পারে। 
সিদ্ধার্থ নিজে মিথ্যাকে সমর্থন করে না বা প্রশ্রয় দেয় না কিন্তু তার হৃদয়ের মিথ্যা উন্মোচন হওয়ার আগ পর্যন্ত সে প্রকাশ করতে পারে না। কোনো এক পিছুটান তাকে আঁকড়ে ধরে থাকে। সিদ্ধার্থের এই বেদনার স্বরূপ লেখক আরও বিস্তৃতভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। লেখকের ভাষায়, সিদ্ধার্থ সাংসারিক জীবনের শান্তি এবং আনন্দ একান্তভাবেই কামনা করে, কিন্তু অতীতের কোনো দৃঢ় বন্ধনের জন্যই সে সাংসারিক জীবনে যেতে পারে না। তাইতো, লেখক সিদ্ধার্থ সম্পর্কে বলেছেন, "সিদ্ধার্থ গৃহী নয়, গৃহ তার নাই। বৈরাগী সে নহে; বৈরাগ্য তার জন্মে নাই। মাঝখানে সে দুলিতেছে। ইহা যে কত বড় ব্যর্থতা, বিরহ আর শূন্যতা তাহা কেবল সে-ই জানে যার ঘটিয়াছে।"
সিদ্ধার্থ চরিত্রের এই আত্মচেতনা এবং আত্মবিশ্লেষণের ঐকান্তিক চেষ্টা তার ঘৃণ্য জীবনযাত্রার উপরেও মানুষের চিরকালের মর্যাদার সংগ্রামের গৌরবটি উজ্জ্বল করে তুলেছে। একদিকে সিদ্ধার্থ যেমন বিলাসবহুল জীবনযাত্রা ভোগ করার জন্য লোককে প্রতারণা করে অর্থ সংগ্রহ করেনি, কিন্তু সে একটা সময় অজয়াকে ভালোবেসে ফেলে। কিন্তু এই ভালোবাসার পেছনে লুক্কায়িত ছিল স্বার্থ। সিদ্ধার্থ আসলে অজয়ার সম্পদের মোহে পড়ে কল্পনার দিন গুনতে থাকে। 
আসলে তার অস্তিত্বই তখন সংকটাপন্ন হয়ে পড়েছিল যে তার তাগিদেই এই জীবনযাত্রা অনিবার্য হয়ে পড়ে।
এমতাবস্থায় নীতিবোধের চাপের তীব্রতায় আত্মহননের মানস তার চিত্তে জাগ্রত হয়। এই অপরাধবোধ একেবারেই তার অন্তর্নিহিত যা কখনোই কেউ দেখে না বা বুঝে না।
জীবন চলার পথে একটা সময় সে উপলব্ধি করতে পেরেছে তার নিজের মধ্যে যে দুর্বলতা রয়েছে তা প্রায় অনতিক্রম্য। আর এই অভাবেই সাধারণ মানুষের মতো সাধারণ জীবনযাপনে সে অপারগ। ফলে "সিদ্ধার্থের মনে হইতে লাগিল সে যেন গলিত কর্দমকুণ্ডের কৃমি, মানুষের পাদস্পর্শের যোগ্য সে নয়। কোথায় একটু দুর্বলতার ফাঁক ছিল, তাহারই সুযোগ লইয়া দুনিয়া তাহাকে ভুলাইয়া ফুসলাইয়া প্রবঞ্চক ইতর সাজাইয়াছে- তারপর তাহাকে গায়ের জোরে ভদ্রসীমার বাহিরে ঠেলিয়া দিয়াছে।"
এদিকে তার নীতিবোধ প্রবল হওয়ার ফলে এই জীবনযাত্রার জন্য অনুশোচনা এবং গ্লানিবোধও তীব্র। তার অপরাধবোধের তীব্রতা কখনো কখনো এতটাই বেড়ে যায় যা তীব্র মানসিক যন্ত্রণায় রূপ নেয়। আর এই মানসিক যন্ত্রণা তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। আবার সে প্রাথমিকভাবে দেবরাজের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেও পরবর্তীকালে পাওনাদারদের দাবির মুখে সে অন্যায়ভাবে অর্থ গ্রহণ করে থাকে। পরিস্থিতির কারণে তার চিত্তের বিভিন্ন দিক দৃশ্যমান হচ্ছে। কিন্তু আরও অনুশোচনায় সে স্থির না থাকতে পেরে আত্মহননের সিদ্ধান্ত নেয়। সে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহননের চেষ্টাকালে অজয়া নামের এক রূপবতী নারীকে দেখতে পায়। শুধু এই নারীর জন্য সে আত্মহননের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে এবং জীবনের জ্যোতির্ময় মঞ্চে এসে দাঁড়ায়- বলাই বাহুল্য, সে এক নারী এবং সহসা তাহাকে দেখিয়াই সিদ্ধার্থের পরিবার সংকল্প উলটাইয়া সরাসরি একটা সহজ বুদ্ধির উদয় হলো। এই মন্তব্যের ভিতর দিয়ে জগদীশ গুপ্ত জীবন নিয়ে যেন এক মর্মান্তিক বিদুপের আশ্রয় নেন। কারণ তিনি তো জানেন যে, যার জন্য সিদ্ধার্থ মৃত্যুর মতো ভয়াবহ হানাহানিকে উপেক্ষা করে অমেয় জীবনে আশ্রয় নিতে চায়, সেখানেও শেষ পর্যন্ত তার আশ্রয় হয় না। 
উপন্যাসটিতে জগদীশ গুপ্ত প্রেম-ভালোবাসায় স্বার্থান্বেষী মনোভাবের চিত্র দেখিয়েছেন। যে অজয়াকে দেখে সিদ্ধার্থ আত্মহত্যার পথ থেকে ফিরে আসে সে অজয়ার সাথে সিদ্ধার্থ শুধু প্রণয়ের সম্পর্ক গড়তে চায়নি। সিদ্ধার্থ অজয়াকে ভালোবাসতো এটা সত্য, কিন্তু তার সেই ভালোবাসার মধ্যে আর্থিক লাভের প্রত্যাশাও মিথ্যা নয়। ফলে তার চিত্তের মধ্যে অনিবার্য দ্বন্দ্ব স্পষ্ট। কেননা যে সিদ্ধার্থ নিজেকে সর্বপ্রকার অনৈতিক প্রস্তাব থেকে দূরে রাখতে চেয়েছে, যে নিজের কৃত অন্যায়ের জন্য অনুশোচনা করেছে এবং আত্মহননের পথও বেছে নিতে চেয়েছিল আবার সেই সিদ্ধার্থ অজয়াকে ভালোবেসেও আর্থিক লোভ সংবরণ করতে পারেনি। এখানে লেখক তার চিত্তের ভিন্ন ভিন্ন দিকের চিত্র দেখিয়েছেন। লেখকের উক্তিতে, "একদিকে সিদ্ধার্থের শিক্ষিত মন, অন্যদিকে তার বর্বরতার প্রগতি, একদিকে ভাবোন্মাদনা, অন্যদিকে বস্তুমোহ, একদিকে কি করা যায় তা সম্বন্ধে অসাধারণ দুশ্চিন্তা, অন্যদিকে প্রয়োজনের দুর্নিবার চাহিদা -এইসব বিপরীতধর্মী প্রেরণার সংকোচ ও প্রসারণের মধ্যে পড়িয়া সিদ্ধার্থ অবিরাম হাঁপাতে লাগিল।" কিন্তু এই সব দ্বন্দ্ব-সংঘাতের মধ্যেও অজয়ার সান্নিধ্য সিদ্ধার্থের যে মানস-পরিচয় তুলে ধরেছে তা হলো,
নারীর রূপ যে ছায়া নয়, তাহা রস-আবেদনে পরিপূর্ণ একটি সজীব গভীর সত্য বস্তু সে জ্ঞান তার জন্মে নাই। অজয়াকে দেখিয়া তাহার পরমাত্মা যেন সহসালব্ধ সেই জ্ঞানের অমৃতলোকে আজ প্রবুদ্ধ হইয়া উঠিল।
হীন সংশ্রলে দীর্ঘদিন কাটানোর ফলে তার মধ্যে অভ্যাসের যে দ্বন্দ্ব প্রোথিত হয়েছে তার থেকে মুক্তি পাওয়া কোনোমতেই তার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই সিদ্ধার্থ চরিত্র বিশ্লেষণে লেখক বলেছেন যে, সিদ্ধার্থ নীতি সমর্থিত স্বাভাবিক জীবনের পথ অবলম্বন করতে চাইলেও তার পক্ষে • সে পথ অনুসরণ করা সম্ভব নয়। হয়তো পরিস্থিতির কারণে এবং নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য সিদ্ধার্থকে ছলনার আশ্রয় গ্রহণ করতে হয়েছে। কিন্তু তার মধ্যে হীনতার কোনো লক্ষণ লেখক দেখাননি। তাইতো লেখক বলেছেন, "অতিশয় হীন সংশ্রবে জীবনের দীর্ঘদিন সে কাটাইয়াছে- তাই তার আহৃত শিক্ষার ফলটিকে আবৃত করিয়া মাঝে মাঝে পাঁকের বুদবুদ উঠিতে থাকে।"
এভাবে দিন চলতে চলতে একটা সময় নটবর অর্থাৎ ছদ্মবেশী সিদ্ধার্থের ব্যাপারে অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করতে থাকে। সন্দেহের প্রথম আওয়াজ তোলে পিসিমা এবং ভাই রজত। তাদের সংলাপের মধ্য দিয়ে সিদ্ধার্থের প্রতি তাদের সন্দেহের চিত্রটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এবং একটা সময় তাদের এই সংলাপ অজয়া পর্যন্ত পৌছায়। অজয়া প্রথমদিকে রাগান্বিত হলেও শেষে বলে, "তিনি সিদ্ধার্থ। ভদ্রলোক নয় তিনি তা নন জানা গেলে আমি এই ছদ্মবেশী সিদ্ধার্থকে ত্যাগ করব।" আবার, এমন অবস্থায় প্রকৃত সিদ্ধার্থের মাতামহ কাশীনাথ এই ছদ্মবেশী সিদ্ধার্থকে দেখে অজয়াকে জিজ্ঞেস করে, "সিদ্ধার্থকে তুমি খুব ভালোবাস? বলো, লজ্জা কি? আমি যে তোমার দাদামশাই! বৃদ্ধের যেন কিছুরই দিশা নাই। অজয়া নিরুত্তরে মাথা নত করিয়া রহিল-বৃদ্ধ হাত চাপড়াইয়া বলিতে লাগিলেন,- কিন্তু সিদ্ধার্থের যে আর একদন্ড পরমায়ু; সে যে বাঁচবে না।"
এভাবে বিবাহ বন্ধনের দ্বারদেশে সিদ্ধার্থের প্রকৃত পরিচয় জানতে পেরে বিবাহ অনুষ্ঠান ভেস্তে যায়। বরং কাশীনাথ ছদ্মবেশী সিদ্ধার্থের ক্লেদাক্ত অতীত ফাঁস করে দেয়। ফলশ্রুতিতে দীর্ঘ সময় ধরে সিদ্ধার্থ নামধারী সুদর্শন যুবকটি মুহূর্তে নটবর হয়ে যায় এবং কাশীনাথের কোনো কথা অস্বীকার না করে সে সেই স্থান থেকে প্রস্থান করতে থাকে। হয়তো দীর্ঘদিনের মিথ্যা বোঝার ভার থেকে সে মুক্ত হয়েছে অথবা বিরাট দীর্ঘশ্বাসের মাধ্যমে সে অতীতকে একবার দেখে নেয়। কিন্তু প্রস্থানকালে পিতামহ লাফিয়ে উঠে জিজ্ঞেস করে- "বলে যা শয়তান, আমার সিদ্ধার্থ কোথায়?
- কোথায় তা জানিনা স্বর্গে কি নরকে, তবে সে বেঁচে নেই।
- বেঁচে নেই? নটবর যাইতে যাইতে মুখ না ফিরাইয়া বলিয়া গেল- না।"
আমরা এই উপন্যাসে নটবর নামক যুবকের ছদ্মবেশী সিদ্ধার্থ হয়ে ওঠার কাহিনি দেখতে পাই। যদিও তার পরিচয় থেকে জানতে পারা যায় সে জারজ, সে বেশ্যার শয্যাসহচর আর এসব বিষয় একটা সময় তার বেঁচে থাকার ইচ্ছা নষ্ট করে দেয়। কিন্তু এক অজয়ার সান্নিধ্যেই সে বেঁচে থাকার আশা খুঁজে পায়। শেষমেশ অজয়ার সাথে প্রতারণা করতেও সে ছাড়েনি। আবার সব ফাঁস হয়ে গেলে সে সব স্বীকার করে সেই জায়গা থেকে প্রস্থান করে। আসলে মানবপ্রবৃত্তির যে একাধিক প্রান্ত রয়েছে তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে জগদীশ গুপ্তের এই উপন্যাসে। আর ছদ্মবেশী সিদ্ধার্থ যে প্রকৃত সিদ্ধার্থ হয়ে উঠতে চেয়েছিল তার সম্পর্কে সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্যটি স্মরণযোগ্য। তিনি বলেছেন, "নিজে যা নয় ছদ্ম আবরণে নিজেকে তাই প্রতিপন্ন করার প্রাণবন্ত প্রয়াস তো প্রত্যেকেরই জীবনে এক অংশ -এই জীবনাগত চিরন্ত্রণ অদৃষ্ট লিখনের টানে আমাদের অনেক ব্যর্থতার জন্ম। সিদ্ধার্থের ছদ্মবেশের ব্যর্থতা প্রকৃতপক্ষে তার জীবনের ব্যর্থতা।"
আপনারঅদৃশ্যমন্তব্য
Cancel