'পুতুল নাচের ইতিকথা' উপন্যাসের বিষয়ভাবনা আলোচনা অথবা, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'পুতুল নাচের ইতিকথা' উপন্যাসের গতিশীলতার স্বরূপ বিশ্লেষণ কর।
তিরিশোত্তর বাংলা সাহিত্যে আধুনিক জটিল জীবনজিজ্ঞাসার বহমান ধারায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এক অবিস্মরণীয় নাম। তার উপন্যাসের বিষয় হিসেবে প্রাধান্য পেয়েছে মানব মনস্তত্ত্বের নানা অনুন্মোচিত প্রান্ত, রোমান্টিক ভাবাবেগ, মানব মনের চেতন, অবচেতন ও অচেতন প্রাপ্তি আশ্রয়ী জীবন অভীপ্সা, জীবন বাস্তবতার অনুসন্ধান ইত্যাদি। 'পুতুল নাচের ইতিকথা' তার কালজয়ী শিল্প সৃষ্টি। এ উপন্যাসের কাহিনির ধারাবাহিকতা ও অনিবার্যতা নির্মাণে লেখকের সর্বৈব সাফল্য নিহিত।
মানুষের জীবনবোধের গভীরতা, জীবনের রহস্য সন্ধানে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বারবার অভ্যস্ত জীবনযাত্রার শৃঙ্খলাকে ছিন্ন করেছেন। আর মানব মনস্তত্ত্বের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়গুলো তুলে ধরেছেন বস্তুবাদ, বিজ্ঞান দৃষ্টি ও মানব মনের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়াকে গ্রহণ করে। উপন্যাসে যার প্রতিফলন ঘটেছে নিখুঁতভাবে। এ উপন্যাসে পল্লি জীবনের বিশ্লেষণ হয়েছে নিপুণভাবে। উপন্যাসে কাহিনির ধারাবাহিকতার কেন্দ্রে রয়েছে গাওদিয়া গ্রাম। উপন্যাসে কাহিনির শুরু হারু ঘোষকে দিয়ে। মেয়ে মতির জন্য সে পাত্রের সন্ধানে গিয়েছিল। ফেরার পথে বজ্রাঘাতে তার অপমৃত্যু হয়। গাওদিয়া গ্রামের ডাক্তার শশী বাড়ি ফেরার পথে হারুর মৃতদেহ নৌকায় তুলে নিয়ে যায়। তারপর গ্রামের লোকজনের সাহায্যে তার সৎকার করে।
গ্রাম থেকে স্থলপথে বাজিতপুরে যাতায়াত চলে। কখনো লোকে নৌকায় বা রেলগাড়িতে চড়ে কলকাতা পর্যন্ত যায়। লেখক এ উপন্যাসে গতিময়তার ব্যঞ্জনা এনেছেন পথের বর্ণনা, ঋতু পরিবর্তনসহ ছোট ছোট জিনিস দিয়ে। ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে ঔপন্যাসিক মানুষের জীবনের পরিবর্তনের কথাও বলেছেন।
শশীর চরিত্রের দুটি ভাগ আছে। একদিকে তার মধ্যে যেমন কল্পনা, ভাবাবেগ ও রসবোধের অভাব নেই তেমনি সাংসারিক বুদ্ধি ও ধনসম্পত্তির প্রতি তার মমতাও যথেষ্ট। তার পিতা গোপাল দালালি ও মহাজনি কারবার করে। বৃদ্ধ যামিনী কবিরাজের যুবতী স্ত্রী সেনদিদিকে সেই জুটিয়েছিল। গোপালের সঙ্গেই তার নামটা জড়ানো হয় বেশি। সেনদিদি শশীকেও পুত্রের ন্যায় ভালোবাসত। শশীরও তার প্রতি কম মমতা ছিল না। স্ত্রীকে নিয়ে যামিনী কবিরাজের সন্দেহ কম নয়। সেনদিদির অসুস্থতার চিকিৎসা করতে শশী তার বাড়ি গেলে যামিনী কবিরাজ খুব অসন্তুষ্ট হতো। সেনদিদির বসন্ত রোগ হলে অবজ্ঞা আর অবহেলায় যামিনী তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছিল। অথচ কবিরাজ হিসেবে যামিনীর খুব নামডাক। অবস্থা বেগতিক দেখে শশী নিজ দায়িত্বে যামিনীর প্রবল অনিচ্ছা এবং প্রতিকূলতা সত্ত্বেও তার চিকিৎসার ভার নিয়েছিল এবং সেনদিদিকে বাঁচিয়ে তুলেছিল। সেনদিদির একটি ছেলে হতে গিয়ে মৃত্যু হয়।
শশী গোপালের একমাত্র ছেলে। কলকাতায় মেডিক্যাল কলেজে পড়ার সময় তার চিন্তাশক্তি ছিল ভোঁতা, হৃদয় ছিল সংকীর্ণ, রসবোধ ছিল স্থূল। সেই জীবনে বিশ্বের আলো জাগিয়েছে তার বন্ধু কুমুদ। জীবনের যে বিশালতা শশী অনুভব করেছে তা গ্রামে এসে স্তিমিত হয়ে যায়। ক্রমে ক্রমে তার মন শান্ত হয়, কারণ সে যে এ গ্রামেরই সন্তান।
হারু ঘোষের বাড়ির সঙ্গে শশীর নিবিড় পরিচয়। হারুর মেয়ে মতি এবং পুত্র পরানের বউ কুসুম তাদের ছোটবাবু শশীকে বিশেষ দৃষ্টিতে দেখে। কুসুমকে পাড়ার লোকে পাগলাটে বললেও আসলে কুসুম পাগল'নয়। স্বাধীন সত্তা কুসুমের মধ্যে আছে। মতির জ্বর হলে শশী তাকে পরীক্ষা করলে কুসুমের ঈর্ষাবোধ হয়। শশীর যাতায়াতের পথে সে অপেক্ষা করে।
মতির জ্বর সেরে যাওয়ায় হারুর বাড়িতে শশীর যাতায়াত কমে। কিন্তু কুসুম মিথ্যে জ্বর হয়েছে, মাথা ধরেছে বলে শশীকে হাত দেখায়। মতির কাছে কুসুম শশীর নামে যা-তা বলে। শশীর প্রতি মতিরও যে গভীর ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা আছে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। এমনই করে যখন শশী-মতি-কুসুমের লঘু অনুরাগের স্রোত বয়ে যাচ্ছিল তখন কার্তিক মাসের পূজা উপলক্ষ্যে গ্রামে বিনোদিনী অপেরা পার্টি আসে। সেই দলে আসে শশীর বন্ধু কুমুদ।
গ্রাম্য শশীর জীবনে কুমুদ প্রচণ্ড নাড়া দিয়েছে। বিদ্যায় আর বুদ্ধিতে সে শশীর চেয়ে শ্রেষ্ঠ। সে শশীর জীবনে যেমন এক বিস্ময় তেমনি পরম শ্রদ্ধেয়। কুমুদ উচ্চমধ্যবিত্ত পর্যায় থেকে নিম্নতর শ্রেণির সঙ্গে একাত্মবোধ করায় শশী খুশি হয়। কুমুদের সঙ্গে তালপুকুরের ধারে মতির পরিচয় হয়। কুমুদের চমৎকার অভিনয় দেখে মতির ভালো লাগে আর গ্রাম্য বালিকার অকৃত্রিম সরলতায় কুমুদ মুগ্ধ হয়। মতিকে সে নিজের মতো গড়ে নিতে পারবে বলে তাকে বিয়ে করে।
যাদব পণ্ডিত সূর্যবিজ্ঞানে পারদর্শী। তিনি নিজের মৃত্যুর কথাও বলতে পারেন। তিনি আগামী রথের দিন দেহত্যাগ করবেন ঠিক হয়ে আছে। চতুর্দিক থেকে ভক্তের দল ভিড় করে আসে। পুণ্যাত্মা বলে শ্রদ্ধা করে। কিন্তু শশী জানে এসবই মিথ্যা। তার মনে পড়ে এক রথের কথা। সেদিন বাড়ি ফেরার পথে যাদব সাপের ভয়ে লাঠি ঠুকে ঠুকে এসেছিল। যার জীবনে এত প্রাণের ভয় তিনিও লোকের মনে শ্রদ্ধা আর বিশ্বাস জাগানোর জন্য মুখ ফসকে বেরিয়ে আসা মৃত্যুর দিনের কথাটা আঁকড়ে থাকেন। যাদব পণ্ডিত মানুষের মনে যে অস্বাভাবিক ভক্তি গড়ে তুলেছিলেন তাকে খানিকটা বাড়ানোর জন্য শেষ পর্যন্ত আফিম খেয়ে সস্ত্রীক আত্মহত্যা করতে হয়। লোকে জানল যাদব পণ্ডিত অশেষ পুণ্যবান বলেই ইচ্ছামৃত্যু বরণ করেছেন। অথচ শশী বুঝতে পারল অতিরিক্ত আফিম খেয়ে তাদের মৃত্যু হয়েছে। মৃত্যুর পর শশী ডাক্তার যাদব পণ্ডিতের টাকায় তার ইচ্ছানুসারে একটি দাতব্য হাসপাতাল নির্মাণ করে। এতে তার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়।
নন্দলাল শশীর বোন বিন্দুকে বিয়ে করে আলাদা বাড়িতে রাখে। রক্ষিতার মতো বিন্দুর জীবন। এদিকে বিন্দু শশীর সাথে গাওদিয়া গ্রামে আসে। গ্রামে এসেও বিন্দু স্বাভাবিক জীবন বদলাতে পারেনি। কারণ বিন্দুর সাত বছরের উত্তেজনার অস্বাভাবিক, বিকারগ্রস্ত জীবন বিন্দু সহসা পরিবর্তন করতে পারে না। এখানে এসেও শশীর মদ চুরি করে খায়। ক্রমে ক্রমে বিন্দু নিস্তেজ হয়ে পড়ছিল। শশী বিন্দুকে নিয়ে যায় আবার কলকাতার সেই অসুস্থ জীবনে।
কুমুদ এক চাকরিতে বেশিদিন থাকতে পারে না। কুমুদ থিয়েটারে চাকরি নিল। কিন্তু কিছুদিন পরে সে চাকরি ছেড়ে চলে গেল পুরোনা যাত্রা দলে। তাহলে মতি থাকবে কোথায়? মতিকে গাওদিয়া নেওয়ার জন্য পরানে ও শশী আসে। উড়নচন্ডী কুমুদের সাথে প্রথম প্রথম মতির কষ্ট হলেও শেষে কুমুদের সাথে সে জড়িয়ে যায়। পরানে ও শশীর সাথে শেষ পর্যন্ত মতি ট্রেনে আসে না। বাথরুমে ঢুকে চলন্ত গাড়িতে কুমুদের সঙ্গে চলে যায়। কুমুদের শিক্ষায় অভ্যস্ত হয়ে মতি আর পুরোনো দিনে ফিরে যেতে চায় না।উপন্যাসে কাহিনির গতিশীলতা আনয়নে লেখকের সূক্ষ্ম ও বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়। কুসুম বহুবার বহুভাবে নয় বৎসর ধরে শশীর কাছে আত্মনিবেদন করেছে। মিথ্যা অসুখ, মিথ্যা হাত ভাঙা, কোমর ভাঙার নাম করে সে শশীর ঘনিষ্ঠতায় আসার চেষ্টা করেছে। কিন্তু শশী সেদিকে দৃষ্টি দেয়নি। কুসুমের উচ্ছ্বাসেও ভাটা পড়েছে। সে বাপের বাড়ি চলে যাবে। কুসুম বলে, "মানুষ তো লোহার গড়া নয় সে চিরকাল একরকম থাকবে।"
শশী পরদিন তালবনে কুসুমকে ডেকে নিয়ে যায়। সেখানে কুসুম উন্মোচন করে তার জৈবনিক ট্র্যাজেডি। শশী আজ তার হাত ধরে কুসুম বলে ডাকে। কিন্তু কুসুম বলে, "আপনি বুঝি ভেবেছিলেন, যেদিন আপনার সুবিধে হবে ডাকবেন, আমি অমনি সুড়সুড় করে আপনার সঙ্গে চলে যাব? কেউ তা যায়?
আর বলল "লাল টকটকে করে তাতানো লোহা ফেলে রাখলে তাও আস্তে আস্তে ঠান্ডা হয়ে যায়, যায় না? ... কাকে ডাকছেন ছোটবাবু, কে যাবে আপনার সঙ্গে? কুসুম কি বেঁচে আছে? সে মরে গেছে।” গ্রাম জীবনের নিরুত্তাপ শশীর জীবনে একটি কুসুম ফুটে উঠেছিল একদিন সে আপনা থেকে ঝরে গিয়েছে। কুসুম বাড়ি চলে গিয়েছে। শশীর জীবনকেও একটি প্রচণ্ড নাড়া দিয়েছে। শশী ঠিক করল সে গাঁ ছেড়ে চলে যাবে। বৈচিত্র্যহীন গ্রাম জীবন বিতৃষ্ণ হয়ে পূর্বেও গ্রাম ছাড়ার ইচ্ছা শশীর মনে কয়েকবার জেগেছিল। কিন্তু বিষণ্ণ চিত্তে শশী তার যাওয়ার আয়োজন বাতিল করে দেয়। দুই মাসের মাইনে দিয়ে নতুন ডাক্তারকেও বিদায় করে দেয়। নতুন দায়দায়িত্ব ও স্মৃতিবিজড়িত মন নিয়ে সে গ্রামেই রয়ে যায়।
উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, 'পুতুল নাচের ইতিকথা' উপন্যাসে কাহিনির ধারাবাহিকতা ও অনিবার্যতা নির্মাণে লেখকের কৃতিত্ব প্রশংসনীয়। যদিও উপন্যাসের গতিশীলতা মন্থর, তথাপি মানবজীবনের গতিময়তা বিশ্লেষণে উপন্যাসটি সর্বৈব সাফল্য সাহিত্য জগতে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। উপন্যাসের শেষে মানুষ সম্পর্কে শশীর আগ্রহ ও আস্থার সুর প্রসারিত ও প্রবাহিত হয়ে মিশে গেছে ঐকান্তিক মানব প্রত্যয়ের বৃহত্তর চেতনায়।