"পুতুল নাচের ইতিকথার পরিণাম ও প্রতিপাদ্য সিগমুন্ড ফ্রয়েডের মনঃসমীক্ষণতত্ত্ব-প্রভাবিত।"- উক্তিটির প্রাসঙ্গিকতা বিচার কর।

পুতুল নাচের ইতিকথার পরিণাম ও প্রতিপাদ্য সিগমুন্ড ফ্রয়েডের মনঃসমীক্ষণতত্ত্ব-প্রভাবিত।উক্তিটির প্রাসঙ্গিকতা বিচার কর।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯০৮-১৯৫৬) বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিকদের মধ্যে একজন। তিনি ৩৯টি উপন্যাস লিখেছেন। তার লেখায় বাস্তববাদী মিল রয়েছে। তার সাহিত্যকর্মে ফ্রয়েডের লিবিডো তত্ত্ব এবং মার্কসবাদের প্রভাব লক্ষ করার মতো বিষয়।
নতুন ধারার ঔপন্যাসিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তার সাহিত্যসাধনার শুরুর সময়ে এই তত্ত্বের দ্বারা দারুণভাবে প্রভাবিত হন। সমাজের সমসাময়িক প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহই ফ্রয়েডের কাছে সবকিছু। তবে ধর্ম, সংস্কৃতি, মনস্তত্ত্ব, শিল্পকলা, রাজনীতি, ইতিহাস-সবই তিনি এই ছাঁচে ঢেলে বিচার করেন। মানিকের যেসব উপন্যাস সিগমুন্ড ফ্রয়েডের মনঃসমীক্ষণতত্ত্ব প্রভাবিত তার মধ্যে পুতুল নাচের ইতিকথা (১৯৩৬) অন্যতম।
পুতুল নাচের ইতিকথায় আধুনিক জটিল জীবনবোধের প্রতিফলন ঘটেছে, তিরিশের দশকের এই উপন্যাসে প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর পর্বের আধুনিকতায় অপ্রত্যাশিত মৌল লক্ষণগুলো নিহিত থাকলেও পাঠকমনে এর সংবেদন কিন্তু গভীরতর এক দিকে ছুটে।
বিখ্যাত স্নায়ু বিশারদ এবং মনোচিকিৎসক সিগমুন্ড ফ্রয়েড (১৮৫৬- ১৯৩৯) ভিয়েনায় ১৮৯৬ সালে মানবমনের রহস্য উদ্‌ঘাটন করতে গিয়ে প্রথম মনঃসমীক্ষণ (Psychoanalysis) শব্দটি উপস্থাপন করেন। এই অর্থে তাকে মনঃসমীক্ষণতত্ত্বের প্রবক্তা বলা হয়। মানুষ কীভাবে সংগতিবিধানের চেষ্টা করে বিভিন্ন পরিবেশগত পরিস্থিতিতে মনঃসমীক্ষণের প্রধান কাজ হচ্ছে তার বৈজ্ঞানিক কারণ নির্ণয় করা। মনঃসমীক্ষণের প্রধান ধারণা হলো এই যে, আমাদের বেশিরভাগ চিন্তা ও প্রেষণা আমাদের মনের অবচেতন স্তরে লুক্কায়িত থাকে যা একেবারে বিলীন হয়ে যায় না বরং তা আমাদের আচরণকে নিয়ন্ত্রিত করে এবং ব্যক্তিত্বের ওপর ছাপ ফেলে।
মূল আলোচনার অনুষঙ্গের বা আবহের মতো প্রথমদিকে মনঃসমীক্ষণাত্মক রচনায় সাহিত্যের স্থান ছিল। এতে রোগ সম্পর্কিত তথ্য নির্ণয়ের জন্য সাহিত্যকে ব্যবহার করা হতো। ১৯২২ থেকে ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত মনঃসমীক্ষণের সাথে শিল্পকলা তথা সংস্কৃতির বিভিন্ন বিষয়ের সম্পর্কের ওপর রচনা প্রকাশের প্রধান মাধ্যম ছিল Imgo নামক একটি সাময়িকী। অটোর‍্যাঙ্ক এর একজন প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন। র‍্যাঙ্ক একজন মনঃসমীক্ষক। ১৯১৯ সালে ফ্রয়েডের The Uncarmy রচনাটি হিমগোর সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। মনঃসমীক্ষণাত্মক অনুসন্ধান রচনাটির বিষয় ছিল। সাহিত্যে মনঃসমীক্ষণের প্রভাবটি দিন দিন যেভাবে প্রকাশ পেয়েছে তার কয়েকটি স্তর পরিলক্ষিত হয়।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুতুল নাচের ইতিকথার আলোকে এরই মধ্যে সিগমুন্ড ফ্রয়েডের মনঃসমীক্ষণতত্ত্বে এর প্রতিফলন বিশ্লেষণ করেছেন। সাম্প্রতিককালের সাহিত্যিকেরা রুশ প্রকরণের কাহিনিতত্ত্বের সাথে মনঃসমীক্ষণাত্মক কাহিনির সাদৃশ্য দেখতে পান। বস্তুত মনঃসমীক্ষণাত্মক সমালোচনার শ্রেষ্ঠ অবদান হচ্ছে কোনো রচনায় কাঠামোকরণ ও অলংকরণে আকাঙ্ক্ষার ভূমিকার নির্দেশ করা। উভয়ের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েছে মনঃসমীক্ষণ, অলংকার এবং কাহিনির। আমরা মনঃসমীক্ষণের এই বৈশিষ্ট্য পুতুল নাচের ইতিকথার উপন্যাসের কাহিনি বিন্যাসে লক্ষ করি।
পুতুল নাচের ইতিকথা উপন্যাসে আক্ষরিক অর্থে পুতুল নাচের কোনো কাহিনি নেই। কিন্তু মানুষগুলো যে কী করে পুতুলের মতো নেচে বেড়ায়, চেতন-অবচেতন মনে যাওয়া-আসা করে তা বুঝা দুঃসাধ্য। অনুমান করা যায়- আড়াল থেকে কেউ একজন চালনা করছে মানুষের পুতুলসত্তাকে। উপন্যাসটি বৃহদায়তনের মহাকাব্যের মতোই এর জৈবনিক বিস্তার, অসংখ্য মানুষ এবং অসংখ্য মানসিক গঠনের মানুষ এই উপন্যাসে ভিড় করেছে। এখানকার প্রতিটি মানুষ নিজেদের স্বার্থ, আয়, আকাঙ্ক্ষা দ্বারা পরিচালিত। উপন্যাসে পুতুলদের কথা ব্যক্ত হয়নি বরং মানবসত্তার মধ্য দিয়ে মানুষ ও পুতুলের দ্বৈরথ নির্মাণ করা হয়। উপন্যাসে লেখক বুঝাতে চেয়েছেন, প্রতিটি মানুষই আত্মকাম, নিজের 'লোভ এবং আকাঙ্ক্ষার দ্বারা পরিচালিত। এখানে মানুষ মানুষের শত্রু না হলেও বিরোধী। মানুষ এই আত্মকামনার কারণেই নিজেকে নিয়ে খেলে-যে খেলায় সে যেমন খেলনা-তেমনি খেলোয়াড়ও বটে। উপন্যাসের সর্বত্রই যেন ফ্রয়েডীয় তত্ত্বের ছড়াছড়ি।
যেমন উপন্যাসের শেষে কুসুমের বাবার উক্তিতেও সেই কথারই প্রতিধ্বনি শোনা যায়-
"সংসারের মানুষ চায় এক, হয় আর এক। চিরকাল এমনি দেখে আসছে ডাক্তারবাবু। পুতুল বই তো নই আমরা, একজন আড়ালে বসে খেলাচ্ছেন।" সাহিত্য বা মনঃসমীক্ষণ কর্মকে মনে করা হতো ফ্যান্টাসির অনুরূপ বা তাকে নির্দিষ্ট রচয়িতার লক্ষ্য হিসেবে গণ্য করা হতো। আমরা এ থেকে রচয়িতার মনঃসমীক্ষণের দিকেই অগ্রসর হই। সেই ফ্যান্টাসিকে লেখক তুলে ধরেছেন। উপন্যাসের শুরু হারু ঘোষের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। আদরের মেয়ে মতির জন্য হারু ঘোষ পাত্র দেখতে গিয়েছিল। ফেরার সময় বজ্রপাতে অপঘাতে মারা যায়। শশী শহর থেকে গোবর্ধনের নৌকায় ফিরছিল। সে নৌকা থেকে দেখতে পায়, গাছের সাথে ভূতের মতো এক লোক ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে ডাক দেয়, কিন্তু সাড়া পায় না। কাছে গিয়ে দেখে হারু ঘোষ মৃত। গ্রামের শশী ডাক্তার শহর থেকে ফেরার পথে প্রকান্ড বটগাছের নিচে কাঁচা- পাকা চুল আর মুখে বসন্তের দাগভরা রুক্ষ চামড়া ঝলসে পুড়ে যাওয়া হারু ঘোষকে আবিষ্কার করে। হারু ঘোষ মৃত অবস্থায়। বটগাছের সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। হারু ঘোষের মৃত্যুর দিন আরও মৃত্যু সংঘটিত হয়েছে- যা ঔপন্যাসিক ফুটিয়ে তুলেছেন পঞ্চানন চক্রবর্তীর সংলাপে। যেমন- "ভূতো যেদিন পড়ল আছাড় খেয়ে, দিনটা ছিল বিষ্যুদবার। খবর পেয়ে মনে কেমন খটকা বাধল। বাড়ি গিয়ে দেখলাম পাঁজি যা ভেবেছিলাম! ছেলেটাও পড়েছে, বারবেলাও খতম! লোকে বলে বারবেলা, বারবেলা কি সবটাই সর্বনেশে বাপু? বিপদ যত ওই খতম হবার বেলা। বারবেলা যখন ছাড়ছে, পায়ে কাঁটাটি ফুটলে দুনিয়ে উঠে অক্কা পাইয়ে দেবে- নবীন জেলের বড় ছেলেটাকে সেবার কুমির নিলে, সেদিনও বিষ্যুদবার, সেবারও ছেলেটা খালে নামল, বারবেলাও অমনি ছেড়ে গেল- গাওদিয়ার খালে নইলে কুমির আসে?"
ফ্রয়েডের মতে, লেখকের বিভিন্ন জটিলতার সাহায্যে বিভিন্ন চরিত্রকে রূপদান করা হতো ফ্যান্টাসির মধ্যকার জীবন্ত সংজ্ঞা হিসেবে। ফ্রয়েড সংক্ষেপে ফুটনোট হফম্যানের জীবনী আলোচনা করেছেন। দরিদ্রের শিক্ষাসুলভ জটিলতার ব্যাখ্যার মাধ্যমে গল্পটির অস্বাভাবিক প্রভাবকে বিশ্লেষণ তার উদ্দেশ্য ছিল। 'পুতুল নাচের ইতিকথা' উপন্যাসের শুধু কেন্দ্রীয় চরিত্র নয় প্রায় প্রতিটি চরিত্রই ফ্রয়েডের ব্যাখ্যাকে ধারণ করে আছে। যেমন- কুসুম, হারু ঘোষের কন্যা মতি এবং মতির স্বামী কুমুদের মধ্যেও এ জাতীয় বৈশিষ্ট্যের সন্ধান পাওয়া যায়। মতিকে তার নিজের বিয়ের জন্য নানা ধরনের ভাবনায় মগ্ন থাকতে দেখা যায়। মতি ধনী বাড়ি এবং গ্রামের শশী ডাক্তারের মতো বরের আশা করে। সে এমন একটি পরিবেশ কামনা করে যেখানে কলহ, বকুনি, কাজ ও নোংরামি কিছুই থাকবে না। তাছাড়া বাড়ির পরিবেশ হবে পরিষ্কার- পরিচ্ছন্ন, বাড়ির বউকে মাথায় করে রাখবে এবং সবাই মিষ্টি কথা বলবে। তার সর্বাঙ্গে ঝলমলে গহনা ও পরনে ঝকঝকে শাড়ি থাকবে। সে ঘোমটার মধ্যে চন্দনচর্চিত মুখখানি নিয়ে লজ্জায় রাঙা হয়ে যাবে। গ্রামের যামিনী কবিরাজের বউয়ের মতো সুন্দরী একটি মহিলা সে সম্পর্কে তার ননদ হবে ও তার কাছে পান খেতে চাইবে। মতি ও কুসুম সম্পর্কে তারা ননদ-বউদি; তাদের সবসময় কোনো একটা কাজ নিয়ে খুনশুটি চলে। আজকাল মতির প্রায়ই কুসুমের সঙ্গে ঝগড়া বাধে। গাওদিয়া গ্রামের শশী ডাক্তারের কথা তুলে অন্যায় পরিহাস করে। কুমুদ শশীর বন্ধুর নাম। কুমুদের সাথে শশীর পরিচয় হয় মেডিক্যালে পড়ার সময়। তারপর একবার গ্রামের যাত্রায় কুমুদও মতিকে দেখে তার ভালো লাগে।
কুসুমের ননদ মতির প্রতি শশীর সহজাত আগ্রহকে কুসুম ঈর্ষা করে। কুসুমের এই জটিল মনস্তত্ত্বের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া উন্মোচনে লেখক আবহমান গ্রামজীবনের লোকজ প্যারাডাইম ব্যবহার করেছেন। উপন্যাস থেকে উদ্ধৃতি- "শশী চলিয়া গেল অন্ধকারে বেগুনখেতে দাঁড়াইয়া কুসুম একটু হাসিল। সামনে গাছের মাথার কাছে একটু আলো হইয়াছে। কুসুম জানে ওখানে চাঁদ উঠিবে, চাঁদ উঠিলে, চাঁদ উঠিবার আভাস দেখিলে কুসুম যেন শুনিতে পায়; ভিনদেশী পুরুষ দেখি চাঁদের মতন লাজরক্ত হইয়া কন্যা পরথম যৌবন।"
ফ্রয়েড প্রতীককে ভাষায় পাইকারিভাবে প্রযুক্ত বলে মনে করেছেন যেন তা নির্দিষ্ট এবং অনমনীয় সংকেত। এই সংকেতকে প্রায়ই স্থল Vulger ফ্রয়েডীয় প্রতীকবাদ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। ফ্রয়েড মনে করতেন, মনঃসমীক্ষণে স্বপ্নের যে উদ্দেশ্য, সাহিত্যেরও সেই একই উদ্দেশ্য। উদ্দেশ্যটি হলো অবচেতনোস্থিত শৈশবীয় এবং বিস্মৃত আকাঙ্ক্ষার গোপন পরিপূরক। তাছাড়া সময়ের পরিক্রমায় মানুষের চেতন-অবচেতন এবং প্রাক্-চেতন মনের যে দ্বন্দ্ব তাও লেখক তুলে ধরেছেন। পূর্বানুমান তিনটি স্তরে, দ্বিতীয় ও তৃতীয় পূর্বানুমানটি স্পষ্টত রচয়িতার মনের সাথে জড়িত। এক্ষেত্রে কুসুম এবং শশী ডাক্তারের চরিত্রায়ণের কথা বলা যেতে পারে। উপন্যাসের তথ্য থেকে জানা যায়, পরানে ঘোষের স্ত্রী কুসুম, শশী পবানের পারিবারিক পরামর্শদাতা বন্ধু। এভাবেই কখন যে কুসুমের মন জুড়ে শশীর রাজত্ব শুরু হয়ে গেল কুসুম নিজেই বুঝতে পারেনি। পরানের স্ত্রী তেইশ বছরের বাঁজা মেয়ে। কুসুম অবচেতন মনে অস্থির, বেপরোয়া ও দুর্বোধ্য। গাওদিয়ার একঘেয়ে জীবনে অভ্যস্ত কুসুমের মৃতপ্রায় মনোজগৎ নতুনভাবে জেগে উঠে কলকাতা-ফেরত ডাক্তার শশীর প্রতি গোপনে লালন করে গভীর আসক্তি, গাঁয়ের মেয়ে হিসেবে কুসুম যথেষ্ট সাহসী। তাই নিজের ভালোলাগাটুকু জানিয়ে দিতে কুসুমের কোনো জড়তা নেই। বাড়ির পাশেই তালবন; সেখানেই তাদের গোপন অভিসার। কখনো আকারে-ইঙ্গিতে, কখনো সরাসরি, কখনোবা মান-অভিমানের ছলে শশীর বাগানের চারা গাছটাকে মাড়িয়ে আবার কখনো চরম মমতায় দীর্ঘ নয় বছর সে শশী ডাক্তারের জন্য অপেক্ষা করে। এদিকে সামাজিক দায়ভার আর সিদ্ধান্তহীনতায় শশী বুঝেও না বুঝার ভান করে এড়িয়ে চলে। কুসুমের আত্মনিবেদন যখন "সইতে পারি না ছোটবাবু;” এই সংলাপ আকারে বেরিয়ে আসে, তখন শশীই তাকে বাস্তবে ফেরায়। বলে- "আমরা ছেলে মানুষ নই। ইচ্ছে হলেই একটা কাজ কি আমরা করতে পারি? বুঝে সুঝে কাজ করার দরকার।" এই দীর্ঘ সময়ে সে যে কতবার-কতভাবে শশীকে জাগিয়ে তুলতে চায়। শশীর মনোজগতে গাওদিয়ার গ্রামজীবন নিয়ে বিতৃষ্ণা থাকলেও নতুন কোনো জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কোনো বাসনা শশীর মধ্যে দেখা অলক্ষণীয়। কুসুমের মনোদৈহিক আকাঙ্ক্ষা আত্মপ্রকাশের পথ খুঁজলেও তাকে সফল করার কোনো ইচ্ছা শশীর মধ্যে ছিল না।
উপন্যাসে রয়েছে- শশীর সাথে দেখা করতে এসে কুসুম দু-বার শশীর গোলাপের চারা পা দিয়ে মাড়িয়ে দেয়; এই পুষ্পবিনাশের মধ্য দিয়ে প্রতীকায়িত হয়েছে কুসুমের অতৃপ্ত রোমান্টিক জীবনাকাঙ্ক্ষাকে অবদমিত করার প্রয়াস। কুসুম পরানের গৃহগত ও সামাজিক সংস্কারকে উপেক্ষা করে তার অবদমিত অভিপ্রায়ের কথা অকপটে ব্যক্ত করেছে "এমনি চাঁদনী রাতে আপনার সঙ্গে কোথাও চলে যেতে সাধ হয় ছোটবাবু।" নারীর ভীরু অস্তিত্বের দ্বিধাকে অস্বীকার করে সে তাকে বলেছে, "আপনার কাছে দাঁড়ালে আমার শরীর এমন করে কেন ছোটবাবু।"
শশী অবিচল। "শরীর! শরীর! তোমার মন নাই কুসুম?" শশীর ক্রমাগত নিস্পৃহতার আঘাতে কুসুমের পল্লবিত আবেগ পরিণত হয় মৃত অনুভূতিতে। মৃত যাদব কাকার উইল করে যাওয়া সম্পত্তি দিয়ে হাসপাতাল তৈরির কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে শশী। যামিনী কবিরাজের অল্পবয়স্কা স্ত্রী সেনদিদির বসন্ত রোগের সময় দিন-রাত সেবা করে শশী। এভাবে গাঁয়ের লোকের মাঝে তৈরি হয় তার একটি বিশিষ্ট স্থান। তখনি ঠিক যেন সে আবিষ্কার করে- সে অনেক লোকের ভিড়ে থেকেও আসলে সে বড় একা।
ফ্রয়েড তার রচনায় Unconcious শব্দটি ব্যবহার করেছেন। এর অর্থ হচ্ছে অসংজ্ঞান বা অবচেতন। যা চেতনার রাজ্যে বর্তমান নেই কেবল তা নয়। শব্দটিকে দেখতে হবে ফ্রয়েডের মনসম্পর্কিত স্থান বিবরণ বিষয়ক আদর্শের পরিপ্রেক্ষিতে। এখানে অসংজ্ঞানকে দেখা হয়েছে একটি গতিশীল অংশ প্রতিক্রিয়া হিসেবে এ হলো মনের একটি অঞ্চল বা স্তর যা কিনা বিপরীতধর্মী শক্তিসমূহের একটি ব্যাপক প্রক্রিয়ার অংশবিশেষ। স্বপ্নের আকাঙ্ক্ষা পূরিত হওয়ার জন্য প্রয়োজন ছদ্মাবরণ এবং চেতনার মধ্য দিয়ে তার প্রকাশ। আমরা এ উপন্যাসে কুসুম এবং শশী ডাক্তারের জাগ্রত স্বপ্ন, অবচেতনে-চেতনে আসা-যাওয়া প্রত্যক্ষ করি এবং পরে সেই স্বপ্নের মৃত্যু হতে দেখি।
শশী গ্রামের কাজের মধ্যে বড্ড একা; এতদিন যে শশী নিঠুর পায়ে দলেছিল প্রেমের অর্ঘ্য, সেই শশীই কাঙালের মতো ছুটে যায় কুসুমের কাছে। বলে- যেখানে হোক। যেখানে হোক চলে যাই, চল আজ রাত্রে। কিন্তু এবার কুসুমই তাকে ফিরিয়ে দেয়। বলে- "কেন যাব?... আপনি বুঝি ভেবেছিলেন যেদিন সুবিধে হবে ডাকবেন, আমি অমনি সুড়সুড় করে আপনার সঙ্গে চলে যাব? কেউ তা যায়?” শশী তখন মরিয়া হয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করেছে-
"চিরকাল আমার জন্যে ঘর ছাড়তে তুমি পাগল ছিলে, আজকে হঠাৎ বিরূপ হলে কেন?" কুসুম বলে- "স্পষ্ট করে ডাকা দূরে থাক, ইশারা করে ডাকলে ছুটে যেতাম।... আজ হাত ধরে টানলেও আমি যাব না।"
কুসুম বাঘিনীর মতো ক্ষিপ্ত স্বরে বলে- "লাল টকটকে করে তাতানো লোহা ফেলে রাখলে তাও আস্তে আস্তে ঠাণ্ডা হয়ে যায়, যায় না? সাধ-আহ্লাদ আমার কিছু নেই, নিজের জন্য কোনো সুখ চাই না-বাকি জীবনটা ভাত রেঁধে ঘরের লোকের সেবা করে কাটিয়ে দেব ভেবেছি- আর কোনো আশা নেই, ইচ্ছে নেই, সব ভোঁতা হয়ে গেছে ছোটবাবু।"
তারপর বাবার বাড়ি যাওয়ার আগে কুসুম সব পাঠ চুকিয়ে যায়। -মন ভাঙা শশীও গাওদিয়ার সব ছেড়ে দিতে চায়। প্রথমে কোলকাতা, সেখান হতে বিলেত-এই চিন্তায় সবকিছু গুছিয়ে নিতে থাকে সে। কিন্তু এবার খেল দেখায় তার পিতা গোপাল। আজন্ম সংসার- অর্থলোভী গোপাল সবকিছু ছেড়েছুড়ে নিরুদ্দেশ যাত্রা করে। সাথে করে নিয়ে যায় সেনদিদির মাহারা সন্তানটিকে, যার পিতৃত্বের ব্যাপারে শশীর সন্দেহের তির সবসময় তাক করা ছিল পিতা গোপালের দিকেই। অগত্যা শশী জড়িয়ে যেতে থাকে গাওদিয়া গ্রামের সাথে। পিতা-পুত্রের মধ্যে যে স্নেহ ও শ্রদ্ধা এবং সোহাগ ও সমীহের সম্পর্ক আমাদের সমাজব্যবস্থার চিরায়ত রীতি 'পুতুল নাচের ইতিকথা' উপন্যাসে তা মুখ থুবড়ে পড়ে। পিতা-পুত্র দ্বন্দ্ব এই উপন্যাসের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ। পিতা গোপাল এবং পুত্র শশীর মধ্যকার সংঘাত Generation gap বা Intergenerational conflict যাই হোক না কেন, এই সমস্যা জীবনের যে বিচিত্রমাত্রিক জটিল চূড়া স্পর্শ করে আছে তা বাংলা কথাসাহিত্যের ইতিহাসে অভিনব এবং নিরাবেগ বাস্তবতা ও নির্মোহ জীবনাভিজ্ঞতার ফসল। পিতা-পুত্রের এই বৈরী সম্পর্ককে ফ্রয়েডের 'Oedipusmyth', ডারউইনের 'parent- offspring conflict কিংবা 'generation gap' বা inter- generational conflict প্রভৃতি তথ্য ও তত্ত্বের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করা যায়। মানবিদ্যার সেই বিস্তৃততর আলোচনায় না গিয়ে আমরা শুধু পিতা-পুত্রের সম্পর্কের সেই স্বরূপটুকু তুলে ধরতে চাই, যেখানে দুজনের কেউই স্বাভাবিক নয়।
উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, পুতুল নাচের ইতিকথা উপন্যাসের বেশকিছু ছোট অবয়বের চরিত্রের মধ্যে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবনবোধের স্বরূপ সবচেয়ে বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। মানবজীবনের রহস্যাবৃত কুটিলতা, জটিলতা, স্বার্থপরতা ও কামপ্রবৃত্তি এই চরিত্রগুলোর মধ্যে অকৃত্রিমভাবে পরিস্ফুট। নিজস্ব একটা জীবনদর্শন ছাড়া সাহিত্যক হওয়া সম্ভব নয় বলে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় যে অভিমত পোষণ করতেন, সেই জীবনদর্শন এই চরিত্রগুলোকে কেন্দ্র করেই যেন অধিক জীবন্ত হয়ে উঠেছে। ফ্রয়েডের মনঃসমীক্ষণ তত্ত্বের আলোকে সর্বাঙ্গসুন্দর না হলেও তাতে মনঃসমীক্ষণ তত্ত্বের বহু বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে। তাই বলা যায়, পুতুল নাচের ইতিকথার পরিণাম ও প্রতিপাদ্য সিগমুন্ড ফ্রয়েডের মনঃসমীক্ষণতত্ত্ব-প্রভাবিত।
আপনারঅদৃশ্যমন্তব্য
Cancel