লোকসাহিত্য কাকে বলে? লোকসাহিত্য সংগ্রহের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব আলোচনা কর।

লোকসাহিত্য কাকে বলে? লোকসাহিত্য সংগ্রহের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব আলোচনা কর।
লোকসাহিত্য মৌখিক ধারার সাহিত্য যা অতীত ঐতিহ্য ও বর্তমান অভিজ্ঞতাকে আশ্রয় করে রচিত হয়। একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক পরিমণ্ডলে একটি সংহত সমাজমানস থেকে এর উদ্ভব। সাধারণত অক্ষরজ্ঞানহীন পল্লিবাসীরা স্মৃতি ও শ্রুতির ওপর নির্ভর করে এর লালন করে। মূলত ব্যক্তিবিশেষের রচনা হলেও সমষ্টির চর্চায় তা পুষ্টি ও পরিপক্বতা লাভ করে। এজন্য লোকসাহিত্য সমষ্টির ঐতিহ্য, আবেগ, চিন্তা ও মূল্যবোধকে ধারণ করে। লোক ঐতিহ্য অনুশীলন, অনুধাবন ও প্রয়োগে এর যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে।

Folklore কথাটির বাংলা প্রতিরূপ লোকসাহিত্য। ফোকলোর কথাটির উদ্ভাবক উইলিয়াম থমাস। ১৮৪৮ সালে সর্বপ্রথম লন্ডনে Folklore Society প্রতিষ্ঠিত হয়। বিভিন্ন পণ্ডিত 'লোকসাহিত্য' শব্দটিকে Folklore শব্দের প্রতিশব্দ হিসেবে মানতে রাজি নন। কারণ ইংরেজি Folklore শব্দটি ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়। ফলে তারা লোকসাহিত্যের পরিবর্তে লোকবিজ্ঞান, লোকশ্রুতি, লোককথা ইত্যাদি শব্দ ব্যবহারে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। 

বাংলায় লোকসাহিত্য চর্চা শুরু হয়েছিল মিশনারিদের হাতে; তারা মূলত এদেশ শাসনের সুবিধার্থে দেশীয় ভাষা ও সংস্কৃতির সংস্পর্শে আসে। এদের মধ্যে কেউ কেউ বাংলার লোকজীবন ও সাহিত্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে লোকসাহিত্য সংগ্রহ শুরু করেন। স্যার উইলিয়াম জোন্স ১৭৮৪ সালে কলকাতায় এশিয়াটিক সোসাইটি গঠন করেছিলেন এবং এ উদ্যোগ ভারতবিদ্যা চর্চার প্রাথমিক সোপান হিসেবে গণ্য করা হয়। এর সাথে পরবর্তীকালে গভীরভাবে যুক্ত ছিল লোকসংস্কৃতি। ইউরোপীয় পণ্ডিতদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েই পরবর্তীকালে বাঙালিরা লোকসাহিত্য চর্চায় এগিয়ে আসেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লোকছড়া সংগ্রহ ও প্রকাশ করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে দীনেশচন্দ্র সেন, আশুতোষ ভট্টাচার্য, মুহম্মদ মনসুর উদ্দীন প্রমুখ ব্যক্তিরা বাংলার চিরায়ত লুপ্তপ্রায় লোকসাহিত্যের অমূল্য ভান্ডারকে আমাদের সামনে নিয়ে আসেন। 

লোকসাহিত্য কোনো ব্যক্তিবিশেষের সৃষ্টি নয়, সমাজের সাধারণ মানুষের সৃষ্টিশীলতার প্রতীক এটি। জগৎ ও জীবন থেকে সৃষ্ট এ সাহিত্য ক্রমান্বয়ে মানুষের মুখে মুখে ফিরে নতুন নতুন রূপ লাভ করে। বৈচিত্র্য ও ব্যাপকতায় এটি বাংলা সাহিত্যের ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে। তাই সমাজবিদ্যা ও সংস্কৃতির মূল বিষয় হিসেবে লোকসাহিত্য বাংলাদেশের সামাজিক উন্নয়ন ও সাংস্কৃতিক জাগরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। আমাদের মৌখিক সাহিত্যের অজস্র সম্পদ আমাদের উন্নয়ন ও জাগরণমূলক কাজে সহজে ব্যবহার করা যায়। দেশজ বা লোকজ জ্ঞান ব্যবহার করে আমাদের খাদ্য, কৃষি, স্বাস্থ্য, পরিবেশ ও পর্যটন ক্ষেত্রে ব্যাপক উদ্যোগ নেওয়া যায়। পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন ও টেকসই উন্নয়নে আমাদের দেশে লোকজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে কাজে লাগানোর অজস্র সুযোগ রয়েছে। খাদ্য সংরক্ষণে লোকজ জ্ঞান ব্যবহার সবচেয়ে বড় উদাহরণ হতে পারে। 

লোকসাহিত্যের জ্ঞান বা নান্দনিক ধারণা নিয়ে আধুনিক নগর পরিকল্পনা গ্রহণ করা খুবই সময়োপযোগী উদ্যোগ হতে পারে। গ্রামীণ জীবনধারাকে পর্যটনের অন্যতম নিয়ামক হিসেবে ব্যবহারের দারুণ সুযোগ আমাদের রয়েছে। আমাদের হাজার নদনদী ও গাছপালা বেষ্টিত গ্রামীণ জীবন ও লোকসংস্কৃতির উপাদান (লোকগান, লোকনৃত্য, লোকনাটক, লোকক্রীড়াসহ অসংখ্য পরিবেশনা) নিয়ে খুব সহজে আউটডোর জাদুঘর তৈরির সুযোগ রয়েছে, যা একই সাথে আমাদের লোকসাহিত্য ও লোকজ সংস্কৃতি বিশ্বের পর্যটকদের কাছে পৌঁছাবে। অন্যদিকে, এ শিল্পীরা বেঁচে থাকবেন তাদের শিল্প নিয়ে। 

লোকশিল্প নিয়ে আমাদের দেশে নানাভাবে ব্যবসা বাণিজ্য হচ্ছে। আমাদের বস্ত্রখাতে বা পোশাক শিল্পে লোক ঐতিহ্যের নানা মোটিফসহ এর প্রক্রিয়াজাত আদি কৌশল ব্যবহৃত হচ্ছে। এটিকে ব্যাপক আকারে বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া যায়। আমরা হারানো মসলিনসহ লুপ্তপ্রায় অন্য শিল্পবস্তু ও প্রকরণগুলো খুঁজে পেতে চেষ্টা করতে পারি। মাটি, বাঁশ, বেত, কাঁসাসহ নানা প্রকার লোকজ শিল্পের প্রসার ও ব্যবহারিক বাণিজ্যিক মূল্য খোঁজা খুব কষ্টের কাজ নয়। সত্যিকার অর্থে স্বাধীনতার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে আধুনিক প্রযুক্তিবিপ্লবের পাশে লোকসাহিত্য ও লোকসংস্কৃতির সমস্ত উপাদান ব্যবহারে এগিয়ে আসতে হবে যা একই সাথে যে আমাদের গৌরবময় ঐতিহ্যকে রক্ষা করবে এবং টেকসই- পরিবেশবান্ধব উন্নয়নে সার্বিক সহায়তা দেবে। এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ নিতে হবে। 

কোনো দেশই তার লোক ঐতিহ্য, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও লোকসাহিত্যকে অস্বীকার করে অগ্রসর হতে পারেনি। বাংলা সাহিত্যও এর ব্যতিক্রম নয়। বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন পর্যায়ে আমাদের প্রবহমান ঐতিহ্যে বিভিন্ন লোকসংস্কৃতির ধারা এসে মিশেছে। জীবনের নানা পর্যায়ে তা আজও মলিন হয়ে যায়নি। এজন্য আমাদের প্রাচীন সাহিত্য, লোককথা, পুথিসাহিত্য, মৈমনসিংহ গীতিকা অথবা পূর্ববঙ্গ গীতিকার মতো অন্যান্য আরও অনেক সাহিত্য ও সংস্কৃতির ধারা এবং বিভিন্ন রূপকল্প আমাদের আধুনিক সাহিত্যে প্রতিফলিত হবেই। কারণ লোকসাহিত্যের সীমাহীন ভান্ডার থেকে এমন সব বিচিত্র রস সংগ্রহ করা সম্ভব যার জ্ঞানময় আলোকচ্ছটায় উদ্ভাসিত হতে পারে আমাদের মন ও মনন। 

আমাদের সামগ্রিক লোকজ জীবন শিল্প ঐতিহ্য জীবনধারা নিয়ে পদ্ধতিগত গবেষণা ও চর্চার সুযোগ তৈরি হয় ১৯৯৮ সালে। সে বছর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পূর্ণাঙ্গভাবে ফোকলোর বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয়। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও লোকসাহিত্য চর্চা ও গবেষণা চলছে। তারপরও আমাদের প্রয়োজন জাতীয় লোকসাহিত্য সংস্থা প্রতিষ্ঠা করা, যার অধীনে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলা যায়। সোনারগাঁওয়ে লোকশিল্প জাদুঘরকে একটি পূর্ণাঙ্গ লোকসাহিত্য চর্চা কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব। 

উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, লোকসাহিত্য খাঁটি বাংলা সাহিত্যের উদাহরণ। গ্রামের অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত, সুফিসাধক, মাঝিমাল্লা, চাষি, বৈরাগী ও লোককবি কর্তৃক সৃষ্ট লোকসাহিত্য বাংলা সাহিত্যের ঐতিহ্য। এতে সহজ ও সাবলীল ভাষায় গ্রামের সাধারণ মানুষের স্বপ্ন, আশা ও বিনোদন প্রতিফলিত হয়। সুতরাং গ্রামীণ মানুষের হাজার বছরের লালিত এসব লোকসাহিত্য যথাযথ পরিচর্যা এবং সংরক্ষণের মাধ্যমে বাংলার মানুষের মনে বেঁচে থাকবে হাজার বছর।
আপনারঅদৃশ্যমন্তব্য
Cancel