"শশীই পুতুল নাচের ইতিকথার নায়ক।" মন্তব্যটি বিস্তৃত কর। অথবা, 'পুতুল নাচের ইতিকথা' উপন্যাস অবলম্বনে 'শশী' চরিত্র অঙ্কন কর। অথবা, "নিঃসঙ্গ নায়ক শশী যথার্থই একক এবং অদ্বিতীয়।” -শশী চরিত্র বিশ্লেষণে এ মন্তব্যের যথার্থতা নির্ণয় কর

শশীই পুতুল নাচের ইতিকথার নায়ক। মন্তব্যটি বিস্তৃত কর।  অথবা, পুতুল নাচের ইতিকথা উপন্যাস অবলম্বনে শশী চরিত্র অঙ্কন কর।  অথবা, নিঃসঙ্গ নায়ক শশী যথার্থই একক এবং অদ্বিতীয়। -শশী চরিত্র বিশ্লেষণে এ মন্তব্যের যথার্থতা নির্ণয় কর।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসে বিষয় হিসেবে প্রাধান্য পেয়েছে মানব মনস্তত্ত্বের নানা অনুন্মোচিত প্রান্ত, রোমান্টিক ভাবাবেগ, মনোবিকার এবং বিকারের উৎস, মানুষ, মানুষের জীবন ও মন, জীবনবোধের গভীরতা। 'পুতুল নাচের ইতিকথা' তার একটি কালজয়ী সৃষ্টিকর্ম। এ উপন্যাসে মানিক শুধু মানব মানবীর হৃদয় সম্পর্ককেই তার উপন্যাসে উপস্থাপন করেননি; বরং মানব ব্যক্তিত্বের সামগ্রিকতার অবয়বের সঙ্গে সম্পর্কিত করে সমাজ, রাজনীতি, সংস্কৃতি বোধের প্রাজ্ঞ বাস্তবতা তার উপন্যাসে উপস্থাপন করেছেন। শশী এ উপন্যাসের প্রধান চরিত্র।
'পুতুল নাচের ইতিকথা' উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র শশী পেশায় একজন ডাক্তার। শহর থেকে ডাক্তার হয়ে আসা গ্রামের ছেলে শশীর মৃত্যুকে জয় করার সাধ্য নেই। তবু শরীর ও স্বাস্থ্যের ওপর প্রকৃতির আক্রমণ ঠেকানোর চেষ্টা তার। হারু ঘোষের মতোই প্রায় মৃত একটি গ্রামীণ সমাজকে শশীর দৃষ্টিতে পাঠক সাধারণের সামনে মানিক অত্যন্ত নৈপুণ্যের সঙ্গে তুলে ধরেছেন। সমালোচকদের মতে, "শশীর চরিত্রে দুটি সুস্পষ্ট ভাগ আছে। একদিকে তাহার মধ্যে শিক্ষিত মধ্যবিত্তসুলভ কল্পনা, ভাবাবেগ ও রসবোধের অভাব নাই; অন্যদিকে তেমনি সাধারণ সাংসারিক বুদ্ধি ও ধনসম্পত্তির প্রতি মমতাও তাহার যথেষ্ট। ... সংসারে টিকিবার জন্য দরকারী এই গুণগুলির জন্য শশীকে সকলে ভয় ও খাতির করিয়া চলে।"
শশী চরিত্রের দ্বিতীয় দিকটি গড়ে তুলেছে তার বাবা গোপাল দাস। সে দালালি ও মহাজনি করে। তারই শাসনে বড় হয়েছে শশী। আধুনিক নাগরিক শিক্ষায় শিক্ষিত শশী প্রথমে গ্রামে এসে বিচ্ছিন্নতা বোধ করে। যামিনী কবিরাজের স্ত্রী সেনদিদির প্রতি শশীর খুব মমতা ছিল। সেনদিদির অসুস্থতা বেগতিক দেখে শশী নিজ দায়িত্বে যামিনীর প্রবল অনিচ্ছা এবং প্রতিকূলতা সত্ত্বেও তার চিকিৎসার ভার নিয়েছিল এবং প্রচুর পরিশ্রম করে সেনদিদিকে বাঁচিয়ে তুলেছিল।
শশী বিজ্ঞানের ছাত্র- চিকিৎসক। বিজ্ঞান শিক্ষা তাকে দিয়েছে যুক্তিবাদী মন, প্রচলিত সংস্কার, বিশ্বাসকে পদে পদে যাচাই করে নেওয়ার উপযুক্ত মনন। আর সেই সঙ্গে তিরিশের দশকে এ নায়কের ব্যক্তিত্বে মিশেছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর দ্বিধাদ্বন্দ্ব, সংশয়। বলা বাহুল্য, এ দ্বিধা সংশয় ও যুক্তিবাদী তথা অন্তর্মুখী মনেরই প্রকাশ। সব মিলিয়ে উপন্যাসে শশী আত্মপ্রকাশ করেছে একালের মনন ও চিন্তাচেতনায় বিক্ষুব্ধ এক যন্ত্রণাবিদ্ধ অন্তর্মুখী নায়ক চরিত্ররূপে। এ অন্তর্মুখী নায়ককে কেন্দ্র করে সে উপন্যাসের অবয়ব গড়ে উঠেছে।
'পুতুল নাচের ইতিকথা' মূলত শশীর দৃষ্টিভঙ্গির পরিচায়ক। নানা বিচ্ছিন্ন ঘটনা জীবনের যে গভীর অর্থবহ তাৎপর্য তা শশীর মনের ভাবনাবাহিত প্রতিক্রিয়ারই রূপ। গ্রামের সবার সঙ্গেই শশীর ভাব রয়েছে। মানুষের বিপদে সে শত বাধা তুচ্ছ করে এগিয়ে যায়। এজন্য প্রাচীনপন্থি শশীর ডাক্তারিতে অবিশ্বাসী যাদব পণ্ডিতও তাকে স্নেহ করে, বিশ্বাস করে।
শশী বন্ধুবৎসল মনের মানুষ। কুমুদ তার বন্ধু। কুমুদের বাড়ি ছিল বরিশালে। শশী যখন কলকাতা মেডিকেল কলেজে পড়তে যায় তখন তার হৃদয় ছিল সংকীর্ণ, চিন্তাশক্তি ছিল ভোঁতা, রসবোধ ছিল স্থূল। জীবনযাপনের মোটামুটি একটি ছবিই ছিল ভবিষ্যৎ জীবন সম্পর্কে তার কল্পনার সীমা। কলকাতায় থাকার সময় শশীর অনুভূতির মার্জনা এনে দেয় তার বন্ধু কুমুদ। শশীর জীবনে পরিবর্তন এসেছিল কুমুদের কারণে।
উপন্যাসে সমকালীন যুবমানসের প্রতিফলন লক্ষণীয়। আপন অন্তর্মুখী জীবনের চারপাশে তার উর্ণনাভের মতো অজস্র ভাবনা ও অনুভূতির দুর্ভেদ্য জাল, যা শশীকে দুরন্ত বলিষ্ঠ খেয়ালি যাযাবর হতে পদে পদে বাধা দেয়, যা তাকে শেষ পর্যন্ত গ্রামীণ জীবনের শিকড়ের সঙ্গে চূড়ান্তভাবে জড়িয়ে ফেলে। নানা অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে শশী জীবনের জটিল, রহস্যময়, পঙ্কিলতার ধারণাকে উপলব্ধি করতে চেয়েছে। শশীর অক্লান্ত চেষ্টায় সেনদিদি আরোগ্য লাভ করে। কিন্তু তা নিয়ে কলঙ্কও রটে। গোপাল শশীকে যামিনী কবিরাজের বাড়ি যেতে নিষেধ করে। রোগীর ভিড়ে শশীও সেনদিদিকে দেখতে যাওয়ার সময় পায় না। এক সময় সে নিবিড়ভাবে এ গ্রাম্য জীবনের সঙ্গে মিশে যায়।
শশী জীবনকে প্রাণপণে শ্রদ্ধা করে। নিজের জীবনকে সে শ্রদ্ধা করে সবার চেয়ে বেশি। জীবনের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা শশীকে সাধারণ মানুষের জীবনের প্রতি আকৃষ্ট করেছে। শশীর চরিত্রে যে দুটি দিক আছে তার মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। যাদব পণ্ডিত সূর্যবিজ্ঞানে পারদর্শী। তিনি নিজের মৃত্যুর কথাও বলতে পারেন। তিনি আগামী রথের দিন দেহত্যাগ করবেন ঠিক হয়ে আছে। চতুর্দিক থেকে ভক্তের দল হাজির হলো। যাদব পণ্ডিতকে শেষ পর্যন্ত আফিম খেয়ে সস্ত্রীক আত্মহত্যা করতে হলো। লোকে ধন্য ধন্য করাতে শশী বুঝল "মিথ্যারও মহত্ত্ব আছে। হাজার হাজার মানুষকে পাগল করিয়া দিতে পারে মিথ্যার মোহে চিরকালের জন্য সত্য হইয়াও থাকিতে পারে মিথ্যা।" মানবচরিত্রের কত আশ্চর্য দিক আছে একে একে শশীর কাছে পরিস্ফুট হতে থাকে। মৃত্যুর পরে যাদব পণ্ডিতের টাকায় তার ইচ্ছানুসারে শশী একটি দাতব্য হাসপাতাল গড়ে তোলে। এতে শশীর জনপ্রিয়তাও আকস্মিকভবে বৃদ্ধি পায়।
উপন্যাসে দেখা যায়, দ্বিধান্বিত সত্তার জটিলতার রহস্য উন্মোচিত হয়েছে কুসুমের সঙ্গে তার সম্পর্কের মধ্য দিয়ে। বস্তুত উপন্যাসে কুসুমের দিক থেকে যে প্রবল উদ্যমতা, আগ্রহ, তীব্রতা ব্যক্ত হয়েছে শশীর দিক থেকে তা নিষ্প্রভ। সে তার শিক্ষা, সংস্কৃতি, সামাজিক মর্যাদা এবং ব্যক্তিত্বের অনিবার্য দূরত্ব নিয়ে কখনোই কুসুমের পরোক্ষ প্রণয় নিবেদনে সাড়া দেয়নি। আপন হৃদয়ের নিভৃত জগতে শশী কোনোদিন কুসুমকে আহ্বান করেনি। কেবল মৃদু স্নেহ সিঞ্চিত অবজ্ঞায় সে কুসুমের পাগলামিকে প্রশ্রয় দিয়েছিল মাত্র। অন্যদিকে, কুসুম পিতার সাথে চলে যাওয়ার স্থায়ী সিদ্ধান্তে শশী সচেতন হয় এবং দূরে কোথাও নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দেয়। শশী স্পষ্টই অনুভব করে, এ গ্রাম ছেড়ে কোথাও যাওয়ার শক্তি তার নেই। শশী কুসুমের মনের অতল রহস্যকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। তাইতো কুসুমকে বলে, "তোমার মন নাই কুসুম।" কুসুমের কাহিনির মধ্য দিয়ে শশী আরেকটি আশ্চর্য মানবচরিত্রকে প্রত্যক্ষ করে।
আধুনিক ব্যক্তিমানুষ শশী তার বুদ্ধি, চিন্তা, মনন দিয়ে অনেক কিছুই বুঝে। সে বুঝে তার পুতুল সত্তাকে, যদিও তাকে অতিক্রম করতে চায় নতুন কর্মোদ্যোগের দ্বারা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মনের দ্বিধা তাকে তাড়িত করে। বিষণ্ণ চিত্তে শশী তার বিদেশ যাওয়ার আয়োজন বাতিল করে দেয়। উপন্যাসের একেবারে শেষে শশী জীবন অভিজ্ঞতা ও বোধের দ্বারা বিষণ্ণ মনে অনুভব করে জীবনের গভীর মর্মস্পর্শী রূপ। পথ চলতে তার চোখে পড়ে খালের ধারে সেই বজ্রাহত বটগাছ, বিন্দুর জীবনকথা, শূন্য চালা, যাদব পণ্ডিতের জীর্ণ গৃহ, কুসুমের শূন্য বাড়ি, মৃত সেই প্রেমের স্মৃতিবহ পরিত্যক্ত তালবন, যা তাকে শূন্যতার দিকে নিয়ে যায়। তবুও আধুনিক জীবনমনস্ক ডাক্তার শশী অন্তহীন জীবনযাত্রার নতুন পথিক।

উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, 'পুতুল নাচের ইতিকথা' উপন্যাসে আধুনিক জটিল জীবনবোধের যে প্রতিফলন ঘটেছে, বলা বাহুল্য তার অনেকটাই উপন্যাসের নায়ক শশী চরিত্রের দর্পণে। মার্কসীয় সামন্ত সমাজ দৃশ্যমান না হলেও শশীর সমাজ সামন্ত সমাজ। বলা যায়, সমাজ ও সংস্কারের শৃঙ্খলের সুতায় বন্দি সে। সুতরাং বাংলা উপন্যাসে আধুনিক জীবন ভাবনা বিন্যাসের দিক থেকে 'পুতুল নাচের ইতিকথা' উপন্যাসের নায়ক এক অনন্য চরিত্র, এতে সন্দেহ নেই।
আপনারঅদৃশ্যমন্তব্য
Cancel