তিতাস ও তীরবর্তী মালো ও কৃষিজীবী মানুষের জীবনচিত্রই 'তিতাস একটি নদীর নাম' উপন্যাসের প্রধান ভিত্তি।”- আলোচনা কর। অথবা, তিতাস একটি নদীর নাম অবলম্বনে তিতাস-তীরবর্তী মানুষের জীবনচিত্রের বর্ণনা দাও

তিতাস ও তীরবর্তী মালো ও কৃষিজীবী মানুষের জীবনচিত্রই তিতাস একটি নদীর নাম উপন্যাসের প্রধান ভিত্তি।- আলোচনা কর। অথবা, তিতাস একটি নদীর নাম অবলম্বনে তিতাস-তীরবর্তী মানুষের জীবনচিত্রের বর্ণনা দাও
অদ্বৈত মল্লবর্মণের একটি বিখ্যাত উপন্যাস তিতাস একটি নদীর নাম। ঔপন্যাসিকের স্বীয় জীবনের অভিজ্ঞতাই এ উপন্যাসের সারাৎসার। গোেকনঘাটের তিতাস তীরবর্তী অঞ্চল যেখানে অদ্বৈত জন্মেছিলেন সেই মালোপাড়াই তার উপন্যাসের পটভূমি। মালো জীবনের গভীর ও গোপনতম ব্যথা ও বেদনার সুর এ উপন্যাসকে বাংলা সাহিত্যে বিশিষ্ট করে তুলেছে। তিতাস এ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র। তিতাস তীরবর্তী মানুষের জীবনে তিতাসের প্রভাব অসামান্য। তিতাস নিজে প্রাণী বা ব্যক্তি না হয়েও ব্যক্তির পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে।

'তিতাস একটি নদীর নাম' উপন্যাসে অদ্বৈত মল্লবর্মণ তিতাস তীরবর্তী মানুষের জীবনচিত্র এঁকেছেন। সেখানে পুরো জেলে পল্লির জীবনযাত্রাকে, জীবনের বিকাশ ও লুপ্ততাকে নিয়ন্ত্রণ করেছে তিতাস। তিতাস নদীকে কেন্দ্র করেই উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্র আবর্তিত হয়েছে। তিতাসের প্রবহমানতার সঙ্গে তার তীরবর্তী জনপদ একীভূত হয়ে গেছে। এ জনপদেরই একজন ছিলেন ঔপন্যাসিক। তার জীবন নিঃসৃত সত্য এ উপন্যাসের সর্বত্র বিস্তৃত হয়ে আছে। এ নদী যে মালোদের জীবনের সমগ্র অংশ জুড়ে রয়েছে সেকথা ঔপন্যাসিক চমৎকার পারঙ্গমতার সাথে তুলে ধরেছেন। উপন্যাসের শুরুতে তিতাসের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে-
"তিতাস একটি নদীর নাম। তার কূলজোড়া জল, বুকভরা ঢেউ, প্রাণভরা উচ্ছ্বাস। স্বপ্নের ছন্দের সে বহিয়া যায়।... মেঘনা-পদ্মার বিরাট বিভীষিকা তার মধ্যে নাই। আবার রমু মোড়লের মরাই, যদু পন্ডিতের পাঠশালার পাশ দিয়া বহিয়া যাওয়া শীর্ণ পল্লীতটিনীর চোরা কাঙালপনাও তার নাই।... তিতাস শাহী মেজাজে চলে। তার সাপের মত বক্রতা নাই, কৃপণের মতো কুটিলতা নাই। কৃষ্ণপক্ষের ভাঁটায় তার বুকের খানিকটা শুষিয়া নেয়, কিন্তু কাঙাল করে না। শুক্লপক্ষের জোয়ারের উদ্দীপনা তাকে ফোলায়, কিন্তু উদ্বেল করে না।” তিতাসের তেরো মাইল দূরে বিজয় নদী নামে একটি নদী আছে সেখানকার জেলেদের দুর্দশার অন্ত নেই। তিতাস তীরের মালোরা যারা সেখানে গিয়েছে তারা দেখেছে চৈত্রের খরায় নদী কত নিষ্করুণ হয়। রিক্ত মাঠের বুকে ঘূর্ণির বুভুক্ষা দেখতে দেখতে তারা ভেবেছে, তিতাস যদি কোনোদিন এমন করে শুকিয়ে যায়, তবে এর আগেই হয়তো তাদের বুক শুকিয়ে যাবে। বিজয়ের পারের মালোগোষ্ঠীকে তারা অভাগা ভাবে। কিন্তু তিতাসে জল! কত স্রোত! কত নৌকা! সবদিক দিয়াই সে অকৃপণ। তিতাস পাড়ের মালোরা ভাবে, "তিন কোন ঠেলা-জাল আবার একটা জাল। তারে হাঁটু জলে ঠেলিতে হয়, ওঠে চিংড়ির বাচ্চা। হাত তিনেক তো মোটে লম্বা। বিজয়ের বুকে তাই ডোবে না। তিতাসের জলে কত বড় বড় জাল ফেলিয়া তারা কত রকমের মাছ ধরে। এখানে যদি তিতাস নদী না থাকিত, বিজয় নদী থাকিত, তবে নাকের চারিদিক থেকে বায়ুটুকু সরাইয়া রাখিলে যা অবস্থা হয়, তাদের ঠিক সেইরকম অবস্থা হইত।"

তিতাস নদীর পাড়ের জেলেরা এবং তাদের পরিবার পরিজন নির্ভয়ে বসবাস করে। কেননা তিতাস বড় শান্ত। তিতাসের বুকে ঝড় তুফানের রাতেও স্বামী পুত্রদের পাঠিয়ে ভয় করে না। বউরা মনে করে স্বামীরা তাদের বাহুর বাঁধনেই আছে, মায়েরা ভাবে ছেলেরা ঠিক মায়ের বুকে মাথা এলাইয়া দিয়া শান্তমনে মাছ-ভরা জাল গুটাচ্ছে। তিতাসের তীর ঘেঁষে ছোট ছোট সব পল্লি। তারপর জমি। তাতে অঘ্রান মাসে পাকা ধানের মৌসুম। মাঘ মাসে সর্ষে ফুলের অজস্র হাসি। তারপর পল্লি, ঘাটের পর ঘাট। সে ঘাটে জীবন্ত ছবি। মা তার নাদুস-নুদুস ছেলেকে ডুবাইয়া চুবাইয়া তোলে। বউ- ঝিরা সব কলসী নিয়ে ডুব দেয়। অল্পদূর দিয়ে নৌকা যায়। সেসব নৌকায় বউরা হয়তো বাপের বাড়ি থেকে শ্বশুর বাড়ি কিংবা শ্বশুর বাড়ি থেকে বাপের বাড়ি আসা-যাওয়া করে। এভাবে তিতাসের সঙ্গে তিতাস পাড়ের মানুষের জীবন ওতপ্রোতভাবে জড়নো থাকে। তিতাস পাড়ের মানুষেরা, বিশেষত মালোরা তিতাসকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে। কবে কোনো দূরতম অতীতে তিতাসের পাড়ে তাদের বাপ পিতামহেরা ঘর বেঁধেছিল, একথা তারা ভাবতেই পারে না। তিতাস যেন চির সত্য, চির অস্তিত্ব নিয়ে তাদের চিরসঙ্গী। এ না হলে তাদের চলে না। এও যদি না হতো তাদের চলতো না। এ না থাকলে তাদের চলতে পারে না। জীবনের প্রতি কাজে তিতাস এসে উঁকি মারে। নিত্যদিনের ঝামেলার সাথে এর চিরমিশ্রণ। মালোদের ঘরের আঙিনা থেকে শুরু হয়েছে যত পথ তার সবই গিয়ে মিশেছে তিতাসের জলে।

তিতাসের পাড়ে সবখানেই গ্রাম নেই। এক গ্রাম ছেড়ে আরেক গ্রামে যেতে মাঝে পড়ে অনেক ধানিজমি, জমির চাষিরা ধানকাটা শেষ করে ভারে ভারে ধান এদিক-ওদিকের গ্রামগুলোতে নিয়ে চলে। তারা তিতাসের ঠিক পাড়ে থাকে না। থাকে একটু দূরে ভিতরের দিকে। সেখান হতে মাঘের গোড়ায় আবার তারা তীরে সর্ষে বেগুনের চারা লাগায়। তীরের যেখানে বালিমাটির চর সেখানে তারা আলুর চাষ করে। প্রচুর সকরকন্দ আলু হয় এ মাটিতে। তিতাসের তীর ছুঁয়ে বাতিঘর জেলেদের। তিতাস তাদের জীবিকার একমাত্র উৎস। তিতাসে মাছ ধরে তারা বেচে এবং খায়। তাদের বাড়ি পিছু একটা করে নৌকা ঘাটে বাঁধা থাকে। এই মাছ ধরে বিক্রি না করলে তাদের পেটে ভাত জোটে না।

তিতাস পাড়ের মালোদের উৎসব, অনুষ্ঠানও তিতাসকে ঘিরেই হয়। মালোপাড়াতে মাঘ মণ্ডলের ব্রততে কুমারী ছোট ছোট মেয়েরা ত্রিশদিন তিতাসের ঘাটে প্রাতঃস্নান করে পূজার অন্যান্য ক্রিয়াদি সম্পন্ন করে। তারা চৌয়ারি বানিয়ে তিতাসের জলে ভাসায়। দস্যি ছেলেরা চৌয়ারি ধরে। ঢোল-কাঁসি বাজে, নারীরা গীত গায়। এভাবে তিতাস তীরের মালোদের জীবনের প্রতি কাজে তিতাস জড়িয়ে থাকে। যদি কোনো ক্রমে তিতাসে মাছ না পাওয়া যায় তবে জীবিকার সন্ধানে তাদের দূরে যেতে হয়। কিশোর আর সুবল যেমন উজানিনগরে খলা বাইতে গিয়েছিল। তিতাস পাড়ের জেলেরা নৌকাবাইচের প্রতিযোগিতা ও করে। সবাই সেই 'নাও দৌড়ানি' দেখতে যায়। তিতাস পাড়ের মানুষদের দৈনন্দিন পানির প্রয়োজন মেটায় তিতাস। গৃহস্থালির কাজে তারা তিতাসের পানিই ব্যবহার করে। বউ-ঝিরা কলসী করে পানি নিয়ে বাড়ি ফেরে। তিতাসেই তাদের সকলের স্নান হয়। কিশোরের উন্মাদ অবস্থায়ও তাকে তিতাসে এনেই স্নান করিয়েছে। তিতাসের ঘাটে নারীরা দল বেঁধে স্নানে যায় এবং ঘাটে তারা গল্পগুজব করে। লবচন্দ্রের বউ উদয়তারা কথায় কথায় ছড়া বলে। মানুষের মৃত্যুর পর শ্রাদ্ধের সময়ও জড়িয়ে থাকে তিতাস। অনন্তর মা মরলে অনন্ত মায়ের শ্রাদ্ধের শেষ খাবার দেয় তিতাসের তীরেই, স্নানও করে।

তিতাসের সঙ্গে তিতাস তীরবর্তী মানুষের বিশেষত জেলেদের সম্পর্ক ছিল জীবিকার, জীবনের। সেই তিতাসে একদিন চর দেখা দিল। বড় বড় নদীতে এক তীর ভাঙে, আরেক তীরে চর পড়ে। কিন্তু তিতাসের ধর্ম তা নয়। তিতাসের কোনো তীরই ভাঙে না। কাজেই তার বুকে যখন চর পড়ল, সে চর দিনে দিনে জাগতে লাগলো, আয়তনে বাড়তে থাকল, চওড়া হলো বুক চিতিয়ে। বর্ষাকালে জল বেড়ে তিতাস কানায় কানায় পূর্ণ হয়। বর্ষা অন্তে সে জল সরে গেলে সেই চর বুক চিতিয়ে দাঁড়ায়। কোথায় যে গেল এত জল, কোথায় গেল তার মাছ! তিতাসের কেবল দুই তীরের কাছে দুইটি খালের মতো সরু জলরেখা প্রবাহিত রইল, তিতাস যে এককালে একটা জলভরা নদী ছিল তাঁরই সাক্ষী হিসেবে মালোদের এক একটা বুকজোড়া দীর্ঘনিঃশ্বাস বের হয়। তিতাস যেন তাদের নির্মম নিষ্ঠুর শত্রু হয়ে ওঠে। সম্পূর্ণ অনাত্মীয়ের মতো, নির্মম শত্রুর মতো ব্যবহার তার মালোদের সাথে। এতদিন সোহাগে আহ্লাদে বুকে করে রেখেছে। আজ যেন মালোদের সাথে তার সম্পর্ক চুকিয়ে নিষ্করুণ কণ্ঠে বলে দিচ্ছে, আমার কাছে আর এসো না, আমি তোমাদের আর কেউ না।

বর্ষাকালে আবার যখন তিতাস কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে ওঠে। প্রাণচঞ্চল মাছেরা আসে, সেই নতুন জলে মালোরা প্রাণভরে ঝাঁপাঝাঁপি করে। গা ডোবায়, গা ভাসায়। নদীর শীতল আলিঙ্গনে, নিজেদের ছেড়ে দিয়ে বলে, "তবে যে বড় শুকাইয়া গিয়াছিলে।" বলতে বলতে কেঁদে ফেলে। বড় যে পর পর লাগতো, কিন্তু এখন তা লাগে না। এত যদি স্নেহ, এত যদি মমতা তবে কেন এত নির্মম হয়েছিলে? কিন্তু বর্ষার স্থায়িত্বের একটা সীমারেখা থাকে। বর্ষা শেষ হলে আবার সেই চরটা নগ্ন হয়ে জেগে ওঠে। পরের বছর তো আয়তনে আরও বাড়ে। উজানের দূরদূরান্ত থেকে একেবারে মালোপাড়ার ঘাট পর্যন্ত সেই চর প্রসারিত হয়। শুধু গোকনঘাটের মালোদেরই দুরবস্থায় হয় না, তিতাস পাড়ের মালোদের সকল গ্রামেরই প্রায় এক দশা। গাছগাছালি আছে, কিছুদিন আগেও যেখানে যেখানে ঘর ছিল তার অনেকগুলোতে দেখা যায় শুধু ভিটা। ঘাটে আগে সারি সারি নৌকা ছিল, এখন আর নেই। যেখানে জাল শুকাতো সেখানে গরু চরছে। নগ্ন ভিটা দাঁড়িয়ে আছে দুয়েকটি বাড়ি যা আছে তারাও বড় ঘর বেচে ছোট ঘর তুলেছে। রাধানগর, কিষ্ট নগর, মনতলা, গোঁসাইপুর সবখানে একই অবস্থা। শুদকপুরের বনমালী মজুরি শুরু করে। মাছের পোনা চালান দেয়। কত মালো যে মারা যায় এবং না খেতে পেয়ে ঘরে বসে তার ইয়ত্তা থাকে না। বছর ঘুরতে না ঘুরতে মালোরা সম্পূর্ণ অচল হয়ে পড়ে। নদীর দুই তীর ঘেঁষে চর পড়ে। একটিমাত্র জলের রেখা অবশিষ্ট থাকে যাতে নৌকা চলে না। মেয়েরা স্নান করতে গেলে গা ডোবে না। জেলেদের নৌকাগুলো শুকনা ডাঙায় রোদে চৌচির হয়। মালোরা এক কাঁধে কাঁধ ডোলা, অন্য কাঁধে ঠেলা-জাল নিয়ে দলে দলে হন্যে হয়ে ঘোরে ডোবা, পুষ্করিণীর সন্ধানে। তাদের দেহ হাড্ডিসার, চোখ বসা। দু-চারটা মৌরালা মাছ উঠলে সেগুলো বেচে কয়েক আনা পেলে তাতে ঘরে চাল আসে, নতুবা আসে না। মনমোহন সারাদিন ঘুরে কিছু না পেয়ে শূন্য হাতে বাড়ি ফিরে। বউ, মা, বাবাসহ সবাই না খেয়ে থাকে। বউ শুকিয়ে কাঠ। অনেক মালো পরিবার গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে। যারা আগে গেছে তারা নৌকায় জিনিসপত্র নিয়ে গেছে, যারা পরে গেছে তারা সব ফেলেই গেছে। কতক গেছে ধানকাটায়, কতক গেছে বড় নদীর পাড়ে। কেউ কেউ শহরে থেকে বাজারে মালের বস্তা ঘাড়ে করে এনে দিলে চার আনা পায়। কিন্তু বস্তা বইতে বইতে তাদের কোমর ভেঙে ঘরে পড়ে • মৃত্যুর প্রতীক্ষা করে। উদয়তারার স্বামীরও এই অবস্থা হয়। সে লাঠির ওপর ভর না করে একপাত্র চলতে পারে না। কেবল জীর্ণ - কোটরপ্রবিষ্ট চোখ মেলে উদয়তারার দিকে চেয়ে থাকে।

তিতাস পাড়ের মালোদের জীবনে তিতাসের প্রভাব ছিল অপরিসীম। তিতাস নদীর বর্ণনা ঔপন্যাসিকের তুলিতে শান্ত মধুরতা দিয়ে শুরু হয়, কিন্তু কালের পরিণামী গ্রাস এখানকার মানুষকে - করে পর্যুদস্ত। এ নদীর পাড়ে বসবাসরত অবহেলিত, অবজ্ঞাত, শিক্ষা ও আধুনিক জীবনের সুবিধাবঞ্চিত গ্রামীণ মানুষের বসবাস। তিতাসকে কেন্দ্র করেই তাদের কষ্ট-বেদনা-হাসি- কান্না-ভালোবাসা উত্থিত হয় আবার মিলিয়ে যায়। তিতাস ছাড়া এর তীরবর্তী মানুষের জীবন কল্পনাতীত। নদীর কলতান, তার গতি ও পরিবর্তনের সমান্তরাল করে বিচিত্র মানুষের অখন্ড জীবন রূপ 'তিতাস একটি নদীর নাম' উপন্যাসে শিল্পরূপ লাভ করেছে।
আপনারঅদৃশ্যমন্তব্য
Cancel