নীতিবিদ্যার বিভিন্ন শাখার উল্লেখপূর্বক সদিচ্ছা ও শর্তহীন আদেশ সম্পর্কিত কান্টের মত উপস্থাপন কর

নীতিবিদ্যার বিভিন্ন শাখার উল্লেখপূর্বক সদিচ্ছা ও শর্তহীন আদেশ সম্পর্কিত কান্টের মত উপস্থাপন কর
শর্তহীন আদেশ একটি নৈতিক প্রত্যয়। কান্টের নৈতিক মানদণ্ড সম্পর্কিত মতবাদ হচ্ছে বিচারবাদ; আর এ বিচারবাদের ভিত্তি সুদৃঢ় করার ক্ষেত্রে যে তিনটি নৈতিক প্রত্যয় অনবদ্য ভূমিকা পালন করছে, শর্তহীন আদেশ সেগুলোর মধ্যে একটি। নীতিদর্শনের ইতিহাসে 'শর্তহীন আদেশ' প্রত্যয়টি তাই একটি প্রভাবশালী নৈতিক প্রত্যয় হিসেবে পরিচিত।

কান্টের সদিচ্ছার ধারণা: কান্ট বলেন, 'মানুষের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে দেখা যায় যে, তাদের মধ্যে অনেকগুলো বৃত্তি রয়েছে, যার মধ্যে ইচ্ছা একটি উল্লেখযোগ্য বৃত্তি। কান্টের মতে, এ ইচ্ছা নামক বৃত্তিটা কখনো নিজের দ্বারা পরিচালিত হয় না। একদিকে বুদ্ধি এবং অন্যদিকে প্রবৃত্তি দ্বারা পরিচালিত। মানুষ বৃদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন জীব বলে তার মধ্যে বুদ্ধি ও প্রবৃত্তির মিলন দেখা যায়। তবে মানুষের ইচ্ছা যখন বুদ্ধি দ্বারা চালিত হয় তখন তাকে 'সদিচ্ছা' বলে। নিম্নে কান্টের সদিচ্ছার ধারণা ব্যাখ্যা করা হলো:
১. একমাত্র সদিচ্ছাই নিরপেক্ষ সৎ বস্তু: "There is nothing in the বিশ্ব, বা এমনকি এটির বাইরেও যাকে যোগ্যতা ছাড়াই ভাল বলা যেতে পারে, ভাল ইচ্ছা ছাড়া।" - ইমানুয়েল কান্ট কান্টের মতে, যে ইচ্ছা আমাদের ফল লাভের আশা ছাড়াই কর্তব্যবোধে উদ্বুদ্ধ করে তাই সদিচ্ছা। পৃথিবীতে একমাত্র সদিচ্ছাই নিরপেক্ষ ও সৎ বস্তু। অন্য যা কিছু আমরা সৎ বলে মনে করি সেগুলো অপেক্ষা ভালো, অর্থাৎ এগুলোর ভালোত্ব অন্য কিছুর ওপর নির্ভরশীল।

২. সদিচ্ছা সর্বদাই স্বাধীন: কান্টের মতে, ইচ্ছা যখন প্রবৃত্তির দ্বারা পরিচালিত না হয়ে কেবল বুদ্ধির দ্বারা পরিচালিত হয় তখন সে ইচ্ছাকেই বলা হয় সদিচ্ছা। সদিচ্ছা সর্বদাই স্বাধীন। কোনোকিছুই এর গতিকে রোধ করতে পারে না।

৩. সদিচ্ছা শর্তহীনভাবে সৎ: কান্ট তার সদিচ্ছার ধারণাকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, "এ জগতের ভিতরে বাইরে সম্ভবত এমনকিছু চিন্তা করা যায় না, যা সদিচ্ছা নামক গুণ ছাড়া সৎ বলে অভিহিত হতে পারে।" সদিচ্ছা বিনা শর্তেই সৎ। জগতে একমাত্র সদিচ্ছাই নিজগুণে সৎ, অন্য যা কিছু আছে তা কেবল সদিচ্ছার গুণে সৎ।

৪. সদিচ্ছা বুদ্ধি ও কর্তব্যবোধ দ্বারা পরিচালিত: কান্টের মতে, সদিচ্ছা বুদ্ধি ও কর্তব্যবোধ দ্বারা পরিচালিত। আমি যদি কর্তব্যের খাতিরে কর্তব্য পালন করার জন্য আমার ইচ্ছাকে পরিচালনা করে থাকি তাহলে আমার এ ইচ্ছাকে সদিচ্ছা বলা যাবে। উদাহরণস্বরূপ, একজন বিক্রেতা যদি কর্তব্যের খাতিরে কর্তব্য করেন, অর্থাৎ ব্যবসায়ের মূলনীতি পালনের উদ্দেশ্যে পরিমাপ ঠিক রাখেন, তাহলে অবশ্যই তার এ ইচ্ছাকে সদিচ্ছা বলা যাবে।

৫. সদিচ্ছা ও কর্তব্য: কান্ট বলেন, সদিচ্ছা ও কর্তব্যের মধ্যে একটি ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র রয়েছে। যে ইচ্ছা কর্তব্য রক্ষার খাতিরে পরিচালিত হয়, সে ইচ্ছার নৈতিক মূল্য রয়েছে। আর যে ইচ্ছা কর্তব্য রক্ষার খাতিরে পরিচালিত নয়, সে ইচ্ছার কোনো নৈতিক মূল্য নেই।

কান্টের শর্তহীন আদেশ: কান্টের মতে, নৈতিক আদেশ শর্তহীন শর্তসূচক নয়। কান্টের মতে, আমি যদি বলার স্বার্থে সত্য কথা বলি কিংবা কোনোরূপ কামনার বশবর্তী না হয়ে কর্তব্যবোধের দ্বারা পরিচালিত হয়ে সত্য বলি তাহলে, 'সত্য কথা বলার' আদেশটি 'শর্তহীন আদেশ' বলে পরিগণিত হবে। কান্টের মতে, একটি কাজ ন্যায় হবে যদি এ কাজটি শর্তহীন আদেশ জাতীয় একটা নীতির ওপর ভিত্তি করে সম্পাদিত হয় এবং একটি কাজ অন্যায় হবে যদি তা শর্তহীন আদেশ জাতীয় নীতির ওপর ভিত্তি করে সম্পাদিত না হয়। শর্তহীন আদেশ হচ্ছে এমন এক ধরনের আদেশ, যা তার নিজ গুণেই গৃহীত হয়। কান্ট শর্তহীন আদেশকে নৈতিক নিয়ম হিসেবে আখ্যা দিয়ে বলেছেন, "শর্তহীন আদেশ কোনো গুণ বা শর্তের ওপর নির্ভর করে না। একে তার নিজের গুণেই পালন করতে হয়। শর্তহীন আদেশ এমন একটা আদেশ, যা নৈতিক কর্তার বিবেকবোধ তথা বিচারবুদ্ধি থেকে উৎসারিত হয়।" কান্টের মতে, শর্তহীন আদেশের কোনো আধেয় নেই। কোন কাজগুলো আমাদের সম্পাদন করা উচিত, কোন কাজগুলো থেকে আমাদের দূরে সরে থাকা উচিত শর্তহীন আদেশ এ সম্পর্কে আমাদের কিছুই বলে না। যেমন- শর্তহীন আদেশের একটি রূপ হচ্ছে 'কর্তব্যের জন্য কর্তব্য করা'। এ আদেশটি আমাদের এরূপ একটি আকার প্রদান করে যে, কাজটি যাই হোক না কেন তা কর্তব্যের জন্য কর্তব্য নীতিকে অনুসরণ করবে।

উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, কান্টের নৈতিক বিচারের মানদণ্ড সম্পর্কিত আলোচনায় 'সদিচ্ছা' একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যয়। তিনি নৈতিকতার স্বীকার্য সত্য হিসেবে যে ইচ্ছার স্বাধীনতার কথা বলেছেন, তা মূলত এ সদিচ্ছাকেই নির্দেশ করে। তিনি সদিচ্ছা থেকে উৎসারিত আচরণকেই সৎ আচরণ বলেছেন, যা নৈতিক নিয়মের অন্তর্ভুক্ত। তার সদিচ্ছা হলো বুদ্ধি স্বজ্ঞাত তথা বিবেক নির্দেশিত।
আপনারঅদৃশ্যমন্তব্য
Cancel