আর্স পোয়েটিকা গ্রন্থের আলোকে সাহিত্যের উৎকর্ষ সম্পর্কে হোরেসের মতের পরিচয় দাও। অথবা, হোরেসের 'আর্স পোয়েটিকা' অবলম্বনে তার সাহিত্য ও কাব্য ভাবনার পরিচয় দাও।
হোরেস ছিলেন ল্যাটিন কবিদের মধ্যে সর্বাধিক জনপ্রিয়। কাব্য রচনায় একাগ্র নিষ্ঠাই তাকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে স্থান করে দিয়েছিল। সামাজিক বিষয়গুলোকে তিনি এমনভাবে ভাষারূপ দিয়েছেন, যা আর কারও কবিতায় পাওয়া যায় না। তার কবিতায় এমন কতকগুলো বৈশিষ্ট্য ছিল যা গ্রিক কবিদের ছিল না, আধুনিক কবিদেরও অনেকেরই নেই। তার রচনা ছিল 'লুসেলিয়াসের শৈথিল্য, ক্যাটুল্লাসের বাহুল্য, প্রোপারটিয়াসের কৃত্রিমতা, ভার্জিলের অতি গম্ভীরতা ও ভিদের আত্মাভিমান, তিবুলুর বিষাদ, লুকানের কুরুচি' ইত্যাদি দোষ থেকে মুক্ত।
শিল্প সমালোচনার ইতিহাসে অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব হচ্ছেন হোরেস। তিনি শিল্পকর্মের অন্তর্নিহিত সংগতিকে একজন সৃজনশীল শিল্পীর প্রথম পাঠ হিসেবে গণ্য করতেন। 'আর্স পোয়েটিকা' গ্রন্থের শুরুতেই তিনি শৈল্পিক অসংগতির কয়েকটি - উদাহরণ উপস্থাপিত করেছেন। বলেছেন কোনো শিল্পী যদি - ঘোড়ার কাঁধে মানুষের মাথা বসিয়ে দেন কিংবা এমন কোনো রমণীর ছবি আঁকেন যার ঊর্ধ্বাংশ মনুষ্যমূর্তি এবং নিম্নাংশ কুৎসিৎ কোনো মাছের মতো তাহলে তা যেমন হাসির উদ্রেক করবে তেমনি কোনো গ্রন্থে যদি বাস্তববোধ এবং সংগতির অভাব থাকে তবে তা শিল্প হিসেবে ব্যর্থ হতে বাধ্য। অন্যদিকে, শিল্প যেন কেবল চক্ষুরিন্দ্রিয়কেই আকর্ষণ করার জন্য এখানে - সেখানে উজ্জ্বল, লালিম পঙক্তিমালা সংযোজন করেই সাফল্যের - দাবিদার না হয়। এগুলো যদি শিল্পীর উদ্দেশ্য এবং সে উদ্দেশ্যের শিল্পীত রূপের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ না হয় তবে তা শিল্পোত্তীর্ণ - বিবেচিত হবে না। শিল্পীকে দেখতে হবে তারই সমগ্রতায়, - অংশবিশেষের অপূর্ব কারুকার্যের সফলতায় নয়।
হোরেস উদাহরণ দিয়ে আবার বলেছেন, এ নগরীর এক প্রান্তে - একজন ভাস্কর রয়েছেন। যিনি কোঁকড়া চুল কিংবা নখকে অপূর্ব কুশলতায় ব্রঞ্জে রূপ দিতে পারেন। কিন্তু তার শিল্পকর্মের সমগ্র - আবেদন রসগ্রাহী নয় এ কারণে যে সম্পূর্ণ মানুষ্য মূর্তিকে তার সমগ্রতায় রূপায়ণের শৈল্পিক শক্তি তার নেই। সুতরাং নবীন শিল্পী সাহিত্যিকদের প্রতি তার উপদেশ-আপন প্রতিভার প্রকৃতি এবং শক্তি সম্পর্কে সম্যক অবহিত হও এবং সে অনুসারে শিল্পকর্মে ব্রতী হও। সমালোচনার ইতিহাসে হোরেসের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অবদান হচ্ছে শব্দের যোজনা সম্পর্কে তার গুরুত্বপূর্ণ উক্তি। শব্দকে নয় বছর ধরে পরিমার্জনা কর, তারপর তাকে যোজনা কর। কবিতায় হোরেসের এ উপদেশ নব্য ক্লাসিকীয় ইউরোপীয় - সাহিত্যিকদের জন্য একটি অবশ্য পালনীয় নির্দেশ। কারণ শব্দ ন প্রতিনিয়ত বদলাচ্ছে। এ নিরন্তর পরিবর্তনের প্রবাহকে অক্ষুণ্ণ ২ রেখে সাহিত্যিকের কর্তব্য হচ্ছে শব্দকে তার নতুন অনুষঙ্গো, নতুন স্বাদে উপস্থাপনা। ঘন অরণ্য যেমন প্রতিবছর শরতের আগমনে বৃক্ষ শাখায় পুরাতন পত্রাবলি বিসর্জন দিয়ে নব কিশলয়কে আবাহন করে শব্দও তেমনি পুরাতনের আবর্জনায় হারিয়ে যায়। তার জায়গায় আসে নতুন শব্দ, নতুন যৌবনের উদ্দীপনা উচ্ছলতা নিয়ে। কালের আবর্তে ভাষায় ব্যবহৃত শব্দাবলিও প্রতিনিয়ত হারিয়ে যাচ্ছে। নতুন শব্দ এসে সে জায়গায় অভিষিক্ত হচ্ছে। তাই তিনি রচনারীতিতে শব্দ চয়ন, কাব্য নির্মাণ, বিন্যাস, বাক্যের গঠনশৈলীর দিকে গুরুত্ব দিয়েছেন বেশি। তার মতে, শিল্পের মূল কথা হলো রচনারীতি বা প্রকাশ।
হোরেস মনে করেন, ভাষা এক সজীব প্রবাহ হয়ে তার ব্যবহারের নিত্যতায় অম্লান। কবি সমালোচক হোরেস শব্দের ব্যবহার সম্পর্কে সর্বপ্রথম নবীন লেখকদের সচেতনতাকে ব্যাপকভাবে জাগ্রত করার চেষ্টা করেন। উল্লেখ্য যে, তার আগে সমালোচনার দুই কৃতিপুরুষ প্লেটো এবং অ্যারিস্টটলের কেউই পেশাগতভাবে কবি ছিলেন না। সে অর্থে হোরেসই সর্বপ্রথম সমালোচক যিনি একাধারে কবি ও সমালোচক। এ সমালোচক কবি ছিলেন বলেই সম্ভবত কবিতার শরীরে শব্দের যোজনা সম্পর্কে এরূপ সুতীক্ষ্ণ চেতনার অধিকারী ছিলেন। তাই তিনি কবিদের প্রতি এমন উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন শব্দের ব্যবহারকে ঋজু করতে, ভব্য করতে, মসৃণ ও মার্জিত করতে।
কবিতায় আন্তরিকতা প্রসঙ্গে হোরেস বলেন কবিতায় শুদ্ধ সৌন্দর্য থাকলেই চলবে না, তাতে থাকতে হবে সম্মোহনী শক্তি। আর তা থাকতে হলে সাহিত্যিকের থাকা চাই আন্তরিকতা। যে অনুভূতির প্রকাশ ঘটবে কবিতায় সে অনুভূতি যদি কবির মনের রসে জারিত না হয় তবে তা পাঠকের মনে আবেদন জাগাতে সক্ষম হবে না। কবিতার বিষয়বস্তুর নির্বাচন সম্পর্কে হোরেস বলেন, হয় পুরাতনকে অনুসরণ কর পরম নিষ্ঠায় নতুবা এমন কিছু উদ্ভাবন কর যার একটা অন্তর্নিহিত ঐক্য আছে। নতুন চরিত্র সৃষ্টি করলে অবশ্যই স্মরণ রাখতে হবে যে, তা যেন শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সংগতিপূর্ণ হয়। তবে যিনি অভিজ্ঞ এবং জীবনবোধের গভীরতায় সম্পন্ন তিনি মানবজীবনের দিকে পরম দরদে তাকাবেন চরিত্র সৃষ্টির তাগিদে এটিই স্বাভাবিক। তার মডেল হবে মানবজীবনের এ প্রবহমান সুখ-দুঃখ, হাসিকান্না। আসল কথা হলো, হোরেসের মতে শিল্পসৃষ্টিকে হতে হবে সহজসরল ও সামঞ্জস্যপূর্ণ। তিনি নিজে কবি বলেই কাব্য রচনার সমস্যাকে আত্মসমালোচনার স্বরভঙ্গিতেই স্পষ্ট করে বলেছেন, "আমরা কবিরা কখনো সত্যের আপাতরূপেই বিভ্রান্ত হই। পরিমিত হতে গিয়ে অস্পষ্ট হয়ে পড়ি আবার কখনো প্রাঞ্জল বা মসৃণ করতে গিয়ে হারিয়ে ফেলি শক্তি আর উদ্দীপনা। কখনো বাগাড়ম্বের আতিশয্যে মেতে উঠি আবার কখনো পাছে কেউ হাসে সেই ভয়ে আর অতি সতর্কতায় কথা বলি মাটি ঘেঁষে।"
হোরেসের 'আর্স পোয়েটিকা' শুধু কাব্যবিষয়ের ও বিষয় উপস্থাপনার রীতি পদ্ধতির বিধি নির্দেশেই শেষ হয়নি। এর অন্তভাগে আলোচিত হয়েছে কবি চরিত্রের পারঙ্গমতা বা যোগ্যতাও। একদিক থেকে হোরেসও "সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি” এই কথাটি বুঝাতে গিয়ে প্রথমেই সেই সকল নকল কবিদের উল্লেখ করেছেন, যারা কবি বলতে শুধু বুঝেন কবির কিছু বাহ্য হাবভাব মাত্র। হোরেস জানাচ্ছেন, এসব কবি কবি ভাবওয়ালা লেখককুল হাবে-ভাবে নিজেদের 'কবিত্ব' প্রকাশ করতে চেয়ে না কাটে হাতের নখ, না ছাটে মাথার চুল, স্নানের বালাই না রেখে আর নির্জন স্থান খুঁজেই তাদের ধারণা তারা কবিপদ বাচ্য হয়ে সমাজে গভীরভাবে শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে উঠবেন। কিন্তু এসব বাহ্যলক্ষণের আড়ম্বর বা দেখনদারিকে প্রত্যাখ্যান করে হোরেস জোর দিয়েছেন কবির আত্মমূল্যায়ন এবং সাধারণ জ্ঞানের ওপর।
হোরেস স্পষ্টই কাব্যিক বৈশিষ্ট্যের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। কাব্যের উদ্দেশ্য সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে তিনি বলেছেন, কবির উদ্দেশ্য কিছু সুফল বা আনন্দ প্রদান অথবা সংযুক্তভাবে জীবনভিত্তিক কোনো প্রয়োজনীয় উপকরণসহ আনন্দ দান। তিনি কাব্যের স্পষ্টতা দীপ্তি এবং শক্তি বাস্তবধর্মিতা মানবিকতা ও মহত্ত্ব অর্জনের কথা বলেছেন। সেই সাথে সতর্ক করে দিয়েছেন যেন বিষয়কে অহেতুক পরিমিত করতে গিয়ে তা অস্পষ্টই হয়ে না আসে। অর্থাৎ স্পষ্টতা কাব্যের অন্যতম গুণ। হোরেস শিল্পের বাস্তবতার কথা বলেছেন অত্যন্ত জোরেশোরে। তিনি বলেন, কেউ যেন সতর্কতা বা অসতর্কতাবশত বাস্তবতাকে পরিহার না করে। আবার বাস্তবতা বা তথাকথিত গতানুগতিকতা থেকে উদ্ধারের নামে যেন আজগুবি অস্বাভাবিক কিছু না করা হয়। সব মিলিয়ে হোরেস সর্বগুণমণ্ডিত বাস্তবভিত্তিক সার্থক শিল্প সৃষ্টিকেই শিল্পের উদ্দেশ্য এবং লক্ষ্য বলে অভিহিত করতে চেয়েছেন।
হোরেস তার কাব্য ভাবনায় একই সাথে প্রতিভা ও চর্চার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন সমানভাবে। শিল্পস্রষ্টাকে যেমন প্রতিভাবান হতে হবে তেমনি তাকে গভীর নিষ্ঠার সাথে চর্চাও করতে হবে। অর্থাৎ প্রতিভা এবং শৈল্পিক সাধনার সমন্বয়ের ওপরই শিল্পের উৎকর্ষ নির্ভরশীল। হোরেস কবির আওতার অন্তর্গত কোনো বিষয় নির্বাচন এবং সেই নির্বাচিত বিষয়ের ওপর গভীর অনুশীলনের কথা বলেছেন। অনুশীলনকে তিনি এতই গুরুত্ব দিয়েছেন যে, কখনও কখনও দিন-রাত অনুশীলনের কথাও উল্লেখ করেছেন। কবিতা নির্মাণের সাথে তিনি ক্রীড়া নৈপুণ্যের তুলনা টেনে বলেছেন, কোনো ক্রীড়াবিদকে মাঠে ক্রীড়া নৈপুণ্য দেখাতে হলে বা বিজয়ী হতে হলে তাকে যেমন নানা প্রতিকূল পরিবেশ পরিস্থিতি মোকাবিলা করে মাঠে নামতে হয়। সেই সাথে নানা কুসর্গ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে হয় অর্থাৎ প্রয়োজন হয় আত্মসুদ্ধির। ঠিক তেমনি একজন সংগীতজ্ঞ বা যন্ত্রবাদককে যেমনি সাধনা করে নিজেকে উপযুক্ত করে আসরে নামতে হয়; একজন কবিকেও তেমনি উপযুক্ততা অর্জন করে কাব্য রচনা করতে হয়। রচিত কোনো কাব্যকে সাথে সাথে প্রকাশের ক্ষেত্রে হোরেস কঠিন বাধ্যবাধকতা আরোপ করেছেন তার কাব্যনির্মাণতত্ত্বে। কবি শিষ্যদের উদ্দেশ্যে তিনি স্পষ্ট বক্তব্য দিয়েছেন, "তোমরা কখনো যদি কিছু লিখ, তাহলে তা সমালোচক মাইসিয়াসকে, তোমার বাবাকে এবং আমাকে শোনাবে। তারপর কাগজগুলোকে নয় বছরের জন্য দূরে সরিয়ে রাখ। যা প্রকাশ করনি তা নষ্ট করতে পারবে যে কোনো সময়, কিন্তু একবার প্রকাশিত হলে তাকে আর ফিরিয়ে আনতে পারবে না।” কবিতাকে বার বার সংশাধেনের কথা উল্লেখ করেছেন তিনি তার কাব্যনির্মাণতত্ত্বের নানা জায়গায়। সেই সাথে কোনোকিছুর বিনিময়ে বা কারো দুর্বল বা আবেগময় মুহূর্তে কোনো শ্রোতা বা পাঠকের প্রশংসা সম্পর্কেও সতর্ক করে দিয়েছেন কাব্য নির্মাতাদের।
সমালোচক হিসেবে হোরেস কবিতার ফর্ম অর্থাৎ কবিতার রূপনির্মাণে বিভিন্ন নিয়মনীতির কঠোর অনুসারী ছিলেন। কবিতার দেহের সংগতি, শব্দপ্রয়োগে সচেতন কুশলতা, কবিতায় আন্তরিকতা ও ঔচিত্যবোধ এবং সর্বোপরি সাহিত্য উপকরণের ঘনিষ্ঠ পরিমার্জনা ইত্যাদি সম্পর্কে হোরেস ছিলেন আপসহীন। কারণ তিনি মনে করেন, শিল্পীর নৈপুণ্য ও দক্ষতাই শিল্পীকে ব্যতিক্রমী করে তোলে, নিভে যাওয়া আগুনের ধোঁয়া থেকে আগুন জ্বালানোর প্রেরণা জাগায়, চমক লাগানোর পথ বের করে।