সমাজবিজ্ঞানের জনক কে? তার সমাজ বিকাশে ত্রয়ীস্তর মতবাদ ব্যাখ্যা কর। অথবা, অগাস্ট কোঁৎ বর্ণিত ত্রয়স্তরের সূত্র আলোচনা কর।

সমাজবিজ্ঞানের জনক কে? তার সমাজ বিকাশে ত্রয়ীস্তর মতবাদ ব্যাখ্যা কর। অথবা, অগাস্ট কোঁৎ বর্ণিত ত্রয়স্তরের সূত্র আলোচনা কর।
সমাজবিজ্ঞানের জনক হিসেবে খ্যাত অগাস্ট কোঁৎ ফরাসি বিপ্লবের সন্তান। অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে ইউরোপের জ্ঞানের জগতে নবদিগন্তের সূচনা করেন। তিনি তত্ত্ব ও তথ্যের আলোকে দর্শনের সাহায্যে গড়ে তোলেন সমাজবিজ্ঞানকে। তার বিভিন্ন ধারণা ও তত্ত্বের মধ্যে ত্রয়ম্ভর সূত্র অন্যতম যা সমাজবিজ্ঞানকে বিকশিত করতে সাহায্য করেছে।

সমাজবিজ্ঞানের জনক অগাস্ট কোঁতের ক্রয়স্তর সূত্র : সমাজবিজ্ঞানের জনক অগাস্ট কোঁৎ সমাজবিজ্ঞানের ক্রমবিকাশে ব্যাপকভাবে ভূমিকা রেখেছেন। এয়স্তর মতবাদ বা সূত্র তার এক অনবদ্য কর্ম হিসেবে গণ্য। বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নতির সাথে মানব বিকাশের সম্পর্ক স্থাপনের গতিধারায় অগাস্ট কোঁৎ স্বতন্ত্র ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেন, যা ত্রয়স্তর সূত্র নামে খ্যাতি লাভ করে। সমাস বিকাশে ত্রয়ীস্তর মতবাদ বা সূত্র এয়স্তরের সূত্রের মূল বক্তব্য হচ্ছে, মানুষের প্রধান প্রধান ধারণাগুলো এবং জ্ঞানের প্রতিটি শাখা ধারাবাহিকভাবে তিনটি স্তরের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করে থাকে। নিম্নে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:

১. ধর্মতাত্ত্বিক স্তর: ধর্মতত্ত্ব সম্বন্ধীয় স্তর হচ্ছে অগাস্ট কোঁতের ত্রয়স্তর সূত্রের প্রথম স্তর। এ স্তরে মানুষ তার প্রতিটি কাজকে ধর্ম তথা অতিপ্রাকৃত শক্তির দৃষ্টিতে ব্যাখ্যা করে। মানুষ মনে করতো সবকিছু অতিপ্রাকৃত শক্তি দ্বারা সৃষ্ট, নিয়ন্ত্রিত এবং তাদের উদ্দেশ্যও সুনির্দিষ্ট। এ স্তরে মানবমনে বস্তুর প্রকৃতি বিশেষ করে বস্তুর উৎপত্তি, বস্তু কোথা থেকে এসেছে, এর উদ্দেশ্য কী প্রশ্ন দ্বারা পরিচালিত হতো। এ স্তরকে আবার তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যথা:
ক. একেশ্বরবাদ: সব সমাজের সব ঘটনার কারণ অতিপ্রাকৃত শক্তি। অর্থাৎ সমাজ ব্যবস্থায় চলমান ঘটনাসমূহ অতিপ্রাকৃত শক্তি দ্বারাই পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়। এ বিশ্বাসবোধ থেকেই একেশ্বরবাদের উৎপত্তি। এ অবস্থায় অতিপ্রাকৃত নিয়মনীতিকে শ্রদ্ধাভক্তি করতে থাকে। এ অবস্থায় এসে ধর্মীয় ধ্যানধারণায় ব্যক্তিগোষ্ঠীর মানসিক স্বাধীনতার বিকাশ ঘটে।
খ. বহু ঈশ্বরবাদ: এ স্তরে মানুষ অতিপ্রাকৃত শক্তির বিভিন্ন আধারকে বস্তুগত আকৃতি দানের চেষ্টায় লিপ্ত হয়। বিভিন্ন অতিপ্রাকৃত শক্তিকে ভিন্ন ভিন্ন আকৃতি দিয়ে পূজা অর্চনায় লিপ্ত হয়।
গ. বস্তুপূজা : এ ধাপে মানুষ অতিপ্রাকৃত বস্তুর শক্তির ধ্যানধারণার ওপর ভিত্তি করে সমাজ পরিচালনা করতো। প্রকৃতির ওপর মানুষের কোনো নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়নি, বরং মানুষকে প্রকৃতি নিয়ন্ত্রণ করতো।

২. অধিবিদ্যক স্তর : এ স্তরটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়। অগাস্ট কোঁৎ এ স্তরটিকে একেশ্বরবাদী স্তরও বলেন। মানুষ একেশ্বরবাদে পৌঁছানোর সাথে সাথে ধর্মীয় মানসিকতার ক্ষেত্রে স্বাধীনতা লাভ করে। অর্থাৎ এ স্তরে ধর্ম অন্যান্য সামাজিক প্রতিষ্ঠান থেকে আলাদা। কোঁতের মতে, এ স্তরটি শুরু হয়েছিল প্রায় ১৩০০ সালের কাছাকাছি সময়ে এবং তা অপেক্ষাকৃত স্বল্পকাল স্থায়ী ছিল। এ স্তরটি ছিল পরিবর্তনসূচক এবং আগের স্তর ও পরের স্তরের মধ্যে সেতুবন্ধের কাজ করেছিল। সমাজবিজ্ঞানী অগাস্ট কোঁৎ মনে করেন, এ স্তরে মানুষ অধিকতর চিন্তাচেতনায় সমৃদ্ধ হতে থাকে এবং চেতনার বিকাশ ঘটায়। মানুষ তার অস্তিত্বকে উপেক্ষা করে বাস্তব কর্মের ফল ও ভূমিকা সম্পর্কে সজাগ ও সচেতন হতে থাকে। এ স্তরটি পূর্বোক্ত ধর্মতত্ত্বের স্থায়ী রূপান্তর নয়, বরং ক্ষণস্থায়ী রূপান্তর। এ স্তরে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড দেবতা কর্তৃক পরিচালিত নয়। একটি বিশেষ শক্তি অথবা অজ্ঞাত কোনো ক্ষমতা দ্বারা পরিচালিত। 

৩. দৃষ্টবাদী স্তর : দৃশ্যমান বাস্তব ও যুক্তি পর্যবেক্ষণ হলো এ স্তরের মূল উৎস। মানুষ যখন ঐশ্বরিক, অতিপ্রাকৃত ও অলৌকিক শক্তির অস্তিত্বকে উপেক্ষা করে বাস্তব জ্ঞানের সাহায্যে জগৎ ও জীবনকে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা করার প্রয়াস পায়। এ স্তরে মানুষ অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের আশ্রয় ও পর্যবেক্ষণ দ্বারা ঘটনার সাথে প্রকৃত বিষয়ে পারস্পরিক সম্পর্ক ও যোগাযোগ স্থাপনের মধ্য দিয়েই জ্ঞানের উৎস খুঁজে পায়। দৃষ্টবাদী স্তর মূলত পর্যবেক্ষণ ও যুক্তির স্তর। দৃষ্টবাদী স্তরের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো বিজ্ঞানের বিশ্বাস। ঘটনার কার্যকারণ সম্পর্ককে বৈজ্ঞানিক উপায়ে ব্যাখ্যা করার প্রয়াস চালানো হয়।

উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, অগাস্ট কোঁতের এয়স্তর সূত্রটি সমাজবিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যয়। তাই সমাজবিজ্ঞানী অগাস্ট কোঁতের এয়স্তর সূত্রের ওপর ভিত্তি করে সমাজবিজ্ঞান বিষয়ের শাখা ও প্রশাখা প্রসারিত হয় যা এখনো বিদ্যমান। আজও সমাজতাত্ত্বিকগণ জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে অগাস্ট কোঁতের নাম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে থাকেন। কারণ সমাজবিজ্ঞনের ভিত্তি তিনিই প্রদান করেন।
আপনারঅদৃশ্যমন্তব্য
Cancel