অনুকরণ কী? এরিস্টটলের অনুসরণে আলোচনা কর। অথবা, এরিস্টটলের সাহিত্যতত্ত্বের পরিচয় দাও
এরিস্টটল বলেছেন, 'সাহিত্য জীবনের বিশুদ্ধ অনুকরণ।' তার মতে, কাব্য, নাটক, ভাস্কর, চিত্র, নৃত্য এ সমস্তই জীবনের অনুকৃতি বা সৃষ্টি। তিনি 'Poetics' এর ১ম..
প্লেটোর যোগ্য শিষ্য, দার্শনিক ও চিন্তাবিদ এরিস্টটল (খ্রিস্টপূর্ব ৩৮৪-৩২২) সাহিত্য সমালোচনার আদিপুরুষ বা জনক বলে অভিহিত। তিনি প্লেটোর শিল্পতত্ত্বকে নতুন বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা বিচার করে যেভাবে শিল্পের স্বরূপ নির্ণয় করেছেন, ইউরোপে বহু শতাব্দী ধরে সে আদর্শই একমাত্র সাহিত্যাদর্শ হিসেবে গৃহীত হয়েছে। তার 'পোয়েটিকস্' (আনু. খ্রিস্টপূর্ব ৩৩০) গ্রন্থে তিনি শুধু গ্রিক সাহিত্য বা গ্রিক সাহিত্যের প্রকরণাদি নিয়ে আলোচনা করেননি; করেছেন বিশ্বসাহিত্যের কতিপয় চিরন্তন ও মৌলিক বিষয় এবং প্রশ্নের আলোচনা। ফলে গ্রন্থটি লাভ করেছে সর্বজনীনতা। এতে এরিসটটল শিল্পসাহিত্যের মৌলিক বিষয়গুলোকে উপস্থাপন করেছেন গ্রিক সাহিত্যের দর্পণে। এজন্যই তিনি সাহিত্য সমালোচকদের পথনির্দেশক এবং গুরু বলে স্বীকৃত হয়ে আসছেন।
এরিস্টটল বিশুদ্ধ ও সৌন্দর্যের দিক থেকে সাহিত্য বিচার করেছেন। সাহিত্য ও শিল্পকে সমাজ বা নীতির প্রয়োজনে না কালয়ে তাকে মানবজীবনের আনন্দালোকের গোপন করে এরিস্টটল সাহিত্যতত্ত্বের মূল বুনিয়াদ পাকা করে গেছেন। তিনি প্রমাণ করতে চেয়েছেন, সাহিত্যের প্রভাব মূলত শুভ। সাহিত্য মূলত সত্যনির্ভর এবং সাহিত্য এক ধরনের চিত্তসংস্কার। আর তিনি মনে করেন, সাহিত্যের বিচার হবে তার নিজস্ব নিয়মে, অন্য কোনো আরোপিত নিয়মে নয়।
সাহিত্য জীবনের প্রতিরূপ। মানবজীবনের চিরন্তন ও শাশ্বত রূপকে তুলে ধরাই সাহিত্যের ধর্ম। পার্থিব জীবনের যাবতীয় সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা সাহিত্যে প্রতিফলিত হয়। তাই এরিস্টটল তার বিখ্যাত গ্রন্থ 'Poetics' এ সাহিত্যতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে তিনটি প্রধান তত্ত্ব বিজ্ঞাপিত করেছেন, যা বিশেষভাবে মৌলিক বলে সর্বযুগে স্বীকৃত হয়েছে। সেগুলো হলো: ১. বিভিন্ন শিল্পের পারস্পরিক যোগ; ২. অনুকরণ এবং ৩. পরিশুদ্ধকরণ বা ক্যাথারসিস।
গ্রিক ভাষায় 'কবি' স্রষ্টা হিসেবে পরিচিত। কবি যেহেতু সৃষ্টি করেন, সেহেতু তিনি স্রষ্টা। আবার যিনি স্রষ্টা, তিনিই কবি; সেই অর্থে বিশ্বস্রষ্টাও কবি। যেকোনো কবি শিল্পীই তাই স্রষ্টা। ভাস্কর, নাট্যকার, চলচ্চিত্রকার সব স্রষ্টাই সে অর্থে কবি। সত্যজিৎ রায়ের কালজয়ী চলচ্চিত্র পথের পাঁচালীকে বলা হয় 'পোয়েমস্ ইন সেলুলয়েড', দ্যা-ভিঞ্চির চিত্রকে বলা হয় 'পোয়েমস্ ইন ক্যানভাস', মাইকেল অ্যাঞ্জেলের ভাস্কর্যকে বলা হয় 'পোয়েমস্ ইন রর্ক'। পোয়েটিকস এমনি এক কবি যা ঘন্টা দ্বারা রচিত সাহিত্যের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ। এর মধ্যে রয়েছে চিরন্তন সাহিত্যের সমালোচনা। যার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে সাহিত্যতত্ত্ব।
এরিস্টটল বলেছেন, 'সাহিত্য জীবনের বিশুদ্ধ অনুকরণ।' তার মতে, কাব্য, নাটক, ভাস্কর, চিত্র, নৃত্য এ সমস্তই জীবনের অনুকৃতি বা সৃষ্টি। তিনি 'Poetics' এর ১ম অধ্যায়ে বলেছেন, "মহাকাব্য, ট্র্যাজেডি, কমেডি এবং দিসুরামব কাব্য, বাঁশি বাজানো, সিতারা বাজানো-এ সবকিছুকেই সাধারণভাবে বলা চলে অনুকরণ।" [অনুবাদ: শিশির কুমার দাশ।
এরিস্টটল দেখিয়েছেন যে, বিভিন্ন শিল্পের মধ্যে যোগাযোগ রয়েছে। শুধু তফাত হচ্ছে রচনার মাধ্যম (Medium), বিষয়বস্তু (Ovject) ও অনুকরণরীতি (Mode of imitation) তিনটি বৈশিষ্ট্য এক শিল্পকে অপর শিল্প থেকে পৃথক করে তোলে। এখানে তিনি প্লেটোকে অতিক্রম করে সমস্ত শিল্পের মধ্যে অন্তরঙ্গ যোগসূত্র খুঁজে পেয়েছেন। প্লেটো যেমন চিত্রবিদ্যার সাহায্যে সাহিত্যকে আক্রমণ করেছিলেন, এরিস্টটল সে পথে না গিয়ে প্রত্যেক শিল্পবস্তুর মধ্যে প্রকাশের পার্থক্য সত্ত্বেও অভ্যন্তরীণ ঐক্য আবিষ্কার করেছেন।
এরিস্টটলের মতে, সাহিত্যের অন্যতম প্রধান বিষয় অনুকরণ। তবে অনুকরণ বলতে তিনি প্লেটোর মতো বস্তুজগতের যুবর অনুকৃতি বুঝাননি। তিনি দেখিয়েছেন, ট্র্যাজেডিতে বাস্তব মানুষের উৎকৃষ্টতর চরিত্র অঙ্কিত হয়, আর কমেডিতে অঙ্কিত হয় নিকৃষ্টতর চরিত্র। বাস্তবের চেয়ে উৎকৃষ্ট বা নিকৃষ্ট হলে তাকে বাস্তবের অবিকল অনুকরণ বলা চলে না, তা বাস্তব অতিক্রম করে যায়। ট্র্যাজেডির চরিত্র বাস্তবের চেয়ে বড়। সুতরাং বুঝা যাচ্ছে, এরিস্টটল 'Mimesis' বা 'অনুকরণ' বলতে বাস্তবের অবিকল অনুকরণ বুঝাননি। তিনি সাহিত্যকে সংগীত ও নৃত্যের সাথে তুলনা করেছেন। এরিস্টটল দেখান যে, সংগীত ও নৃত্যের মতো সাহিত্যও ঠিক রাস্তবের অনুকরণ করে না, বাস্তব বিচারী ভাব সংবেদ সৃষ্টি করে। এ কারণে এরিস্টটলের 'Mimesis' কে কেউ কেউ 'কল্পনার সাহায্যে নতুন সৃষ্টি' বলেছেন। অর্থাৎ প্রকৃতির হুবহু নকল না করে প্রকৃতির মধ্যে যে সম্ভাবনা আছে তাকেই কল্পনার দ্বারা নতুন করে সৃজনই 'অনুকরণ' বা 'Mimesis'.
অনুকরণ মানুষের স্বভাবগত। প্রাণিজগতে মানুষ সর্বাপেক্ষা অনুকরণশীল এবং অনুকরণের সাহায্যে আনন্দ পাওয়া মানুষের স্বভাব। মানুষ শিখতে চায় এবং অনুকরণাত্মক কাজে আনন্দ পায়। যেসব লৌকিক বিষয় থেকে আমরা বেদনা পেয়ে থাকি, যেমন- অতি নিকষ্ট জীবজন্তু কিংবা শবদেহ সেসব বিষয়ই যখন শিল্পে অতি যথাযথ ও নিখুঁত প্রতিরূপে অনুকৃত হতে দেখি তখন আমরা আনন্দ পাই। সুতরাং বলা যায়, অনুকরণ মানুষের স্বভাবের মধ্যে নিহিত। ঠিক সেরকম ছন্দ ও সুষমাবোধও মানুষের সহজাত। কবির স্বভাব অনুসারে কাব্যের শ্রেণি দু'রকমের। গভীর প্রকৃতির লেখকরা মহত্ত্বপূর্ণ ঘটনা এবং মহৎ ও বীর লোকদের ক্রিয়াকলাপ অনুকরণ করে সাহিত্য রচনা করেন। লঘু প্রকৃতির লেখকরা অনুকরণ করেন লঘু চরিত্র ও লঘু কার্যকলাপের। সাহিত্যে এর প্রভাবে দেখা দেয় মহাকাব্য, ট্র্যাজেডি, ব্যঙ্গ কবিতা ও কমেডির ধারা। হোমার, সফোক্লিস প্রমুখ মহৎ কবি ও নাট্যকারগণ প্রাচীন বীরদের মহত্বপূর্ণ বীরত্বের কাহিনি অনুকরণ করে মহাকাব্য ও ট্র্যাজেডি রচনা করেন। অপরদিকে, ব্যঙ্গ কবিতার রচয়িতা লঘু প্রকৃতির লোকদের জীবন অনুকরণ করে ব্যঙ্গ কবিতা ও কমেডি রচনা করেন। এভাবে অনুকরণের মাধ্যমেই সাহিত্যের বিভিন্ন ধারার সূত্রপাত হয়।
প্লেটো বলেছিলেন, সাহিত্য ও শিল্প মানুষকে দূষিত করে। এরিস্টটল এর প্রতিবাদে 'Katharsis' শব্দটি প্রয়োগ করে দেখাতে চেয়েছেন যে, সৎ সাহিত্য মানুষকে কলুষিত করে না। তার মতে, ট্র্যাজেডি দেখে আমাদের চিত্ত মলিনতামুক্ত হয় এরই নাম 'পরিশুদ্ধকরণ' বা 'ক্যাথারসিস'।
এরিস্টটলের মতে, ট্রাজেডির দ্বারা আমাদের চিত্তে করুণা ও ভীতি উদ্রিক্ত হয়ে মমতা লাভ করে। ট্র্যাজেডি দর্শন করার পর আমাদের মনের মধ্যে করুণা ও ভীতি জাগে। যার ফলে আমাদের মন তখন মমতা লাভ করে। এখানে এরিস্টটল বলতে চেয়েছেন, আমাদের মনের মধ্যে নিহিত আবেগের জাগরণ ট্র্যাজেডির একটা বড় কাজ। জীবনে যা আমাদের বিচলিত করে, উত্তেজিত করে, তা ট্র্যাজেডির মধ্য দিয়ে উদ্বুদ্ধ হলে মনে আনে প্রশান্তি ও স্নিগ্ধতা।
অর্থাৎ ট্র্যাজেডির করুণা, ভীতি, আতঙ্ক এ বিষয়গুলোর পূর্ণরূপ দেখে বা শুনে দর্শক শ্রোতার হৃদয়ে একপ্রকার পরিতৃপ্তিকর অনুভূতির সৃস্টি হয়। এটাই মহৎ সাহিত্যের লক্ষণ।
এরিস্টটলের কাছে সাহিত্য শিল্প জীবনের অনুকরণ। বাস্তব জীবনের ঘটনাই রচনাকৌশলের দ্বারা রসবস্তু হয়ে ওঠে। সাহিত্যিক একটা বাস্তব ঘটনাকে মানসিক রূপ দেন এবং সে মানসিক ভাববস্তুকে তিনি বিশেষ ধরনের রচনাকৌশলের সাহায্যে প্রকাশ করেন। সুতরাং রচনাকৌশলের দ্বারাই বাস্তব উপাদান সাহিত্যে পরিণত হয়। যেমন- একটা হত্যাকাণ্ড ঘটে গেল- সেটা হলো বাস্তব। তাকে যখন কবি বা নাট্যকার কবিতা - বা নাটকের মাধ্যমে বর্ণনা করবেন, তখন তা সাহিত্য হয়ে - উঠবে। এ সাহিত্য সত্য, আর সত্য থেকেই আনন্দের বিকাশ। - কারণ সাহিত্য শুধু সুন্দরের নয়, অসুন্দরেরও অনুকরণ। - অসুন্দরের অনুকরণও আনন্দ দেয়। এরিস্টটল শুধু আনন্দদায়ক বলেই কাব্যকে সম্মানিত করেননি; তাকে মূল্য দিয়েছেন তা জীবনের সর্বজনীন সত্যকে প্রকাশ করে বলে। তার মতে, নীতি দিয়ে কাব্যকে বিচার করা যায় না। কবি সত্য বলেছেন, কি - মিথ্যা বলেছেন এটা স্থির করা সমালোচকের দায়িত্ব নয়। সমালোচকের কাজ হলো, মিথ্যা কথা কবি কিভাবে সুন্দর করে বলতে পেরেছেন এবং তা সর্বজনীন সত্যে উত্তীর্ণ হয়েছে কি না সেটা জানা। তিনি মনে করেন, যদি কোনো ঘটনা বাস্তবে নাও ঘটে থাকে আপত্তি নেই, যদি ঘটনা সম্ভাব্য হয়, কাহিনির ভিতরের যুক্তিজালের মধ্য দিয়ে অনিবার্য হয়ে ওঠে তাহলেই তাকে 'সত্য' বলে মানব।
উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে এ কথাই প্রতীয়মান হয় যে, সাহিত্য মানবজীবনকে প্রকাশ করে, ঠিক অনুকরণ করে না। বস্তু যখন । সাহিত্যে প্রকাশিত হয় তখন তা সাহিত্যিকের মন এবং সাহিত্যের বাহনের মধ্য দিয়ে আসে। সাহিত্যিক তাকে বিশেষ ধরনের রচনাকৌশলের সাহায্যে প্রকাশ করেন। সুতরাং - এরিস্টটলের অনুকরণকে বাস্তবের অনুকরণ না বলে বরং - বাস্তবের পুনর্গঠন বলা চলে। অর্থাৎ অনুকরণ নয় সৃষ্টিই হচ্ছে সাহিত্যের মূলকথা এবং শিল্পতত্ত্ব সম্বন্ধে এরিস্টটলের এ এ কথাটিই সর্বাধিক মৌলিক বলে স্বীকৃত।