লঙ্গিনুসের সাবলাইম তত্ত্বের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোচনা কর
প্রাচীনকালের সাহিত্যবিচার বা সাহিত্য নির্মাণতত্ত্বের যারা নতুন এবং যুগান্তকারী ধারার প্রবর্তক তাদের মধ্যে লঙ্গিনুস অন্যতম। অনুবাদক ও টীকাকার টি. এস. ডোরেস্ মন্তব্য করেছেন, বিষয়বস্তুর ধরন এবং বিশ্লেষণ প্রকৃতি দেখে একে খ্রিষ্টীয় প্রথম শতকের রচনা বলে ধারণা করা হয়। তার | রচিত Peri hypsos এর বিষয়বস্তু, উপস্থাপনা ইত্যাদি থেকে এটা স্পষ্ট যে, তারই বিদগ্ধমনা বন্ধু ও শিষ্য রোমদেশীয় = টেরেটিয়ানাস এর অনুরোধে তিনি এ কালে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন - এবং তিনি তা করেছিলেন তার পূর্ববর্তী সিসিলিয়াসের একটি - নিবন্ধের আলোচনা প্রসঙ্গে।
লঙ্গিনুসের 'Peri hypsos' বা 'On the sublime' গ্রন্থের সম্পূর্ণ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। উদ্ধারকৃত রচনা চুয়াল্লিশটি অধ্যায়ে বিভক্ত। এ গ্রন্থে মূলত রোমান্টিকতার দৃষ্টিকোণ থেকেই সাহিত্যের আদর্শ সম্পর্কে আলোচিত হয়েছে। সেদিক থেকে লঙ্গিনুসের এ গ্রন্থকে সাহিত্যধারায় রোমান্টিকতার সূচনা গ্রন্থ বলা যায়। এ গ্রন্থের মূল কথা হলো সাহিত্য জীবনের অনুকরণ হলেও শুধু জীবন উপস্থাপনাই সাহিত্যের একমাত্র উদ্দেশ্য নয়; সাহিত্যকে যথাযথ সাহিত্য হয়ে উঠতে প্রয়োজন গভীর ধ্যান এবং অলংকার সহযোগে ভাষাকে নবরূপ প্রদান করা। এর মাধ্যমেই সাহিত্য হয়ে উঠতে পারে মহামহিমান্বিত সুন্দরতম এক শিব।
সাহিত্য জীবনের অনুকরণ হলেও শুধু জীবন উপস্থাপনাই সাহিত্যের একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। কাব্য বা সাহিত্য যথাযথরূপে সার্থক হয়ে উঠতে প্রয়োজন গভীর ধ্যান এবং অলংকার সহযোগে ভাষাকে নব রূপ প্রদান করা। এর মাধ্যমে সাহিত্য হয়ে উঠতে পারে মহামহিমান্বিত সুন্দরতর এক শিল্প বিশেষ। শিল্পকে এ মহামহিমান্বিত এবং সুন্দরতর হওয়া লঙ্গিনুস 'Sublime' অভিধায় অভিহিত করেছেন। তার মতে, সাহিত্যের সার্থকতার একমাত্র অবলম্বন 'Sublime', লঙ্গিনুস Sublime কে সাহিত্যের - একমাত্র লক্ষণ হিসেবে গণ্য করেছেন। এ Sublime বলতে তিনি বুঝিয়েছেন, ভাষার এমন প্রাধান্য ও সৌন্দর্য, যা ভালো বাগ্মীর মতো এক মুহূর্তেই পাঠককে মন্ত্রমুগ্ধ করতে পারে। যার মাধ্যমে লেখকও গৌরবের সুউচ্চ শিখরে আরোহণ করতে পারেন। লঙ্গিনুসের ভাষায়, "রচনার উৎকর্ষ শ্রেয়তর দক্ষতা ও বিশিষ্ট প্রকাশভঙ্গির মধ্যে খানিকটা নিহত; সে গুণ থাকলেই কেবল বিখ্যাত ও শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করা এবং চিরন্তন খ্যাতির শীর্ষে আসীন হওয়া সম্ভব।” অর্থাৎ শিল্পসাহিত্যের সর্বক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের একমাত্র মাধ্যম হলো Sublimity.
লঙ্গিনুস তার 'Sublime' তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত করেছেন হোমার থেকে ডিমসথিনিস পর্যন্ত গ্রিক সাহিত্য বিশ্লেষণ করে। সে সাথে তিনি সমাজ ও সাহিত্যের মধ্যে যোগাযোগ কোথায় সে বিষয়েও আলোকপাত করেছেন। লঙ্গিনুস 'On the Sublime' গ্রন্থে সাহিত্যের স্টাইল বা রচনারীতি, সাহিত্য বিচারের মাপকাঠি ও মূলতত্ত্ব, ক্লাসিকতার ব্যাখ্যা, সাহিত্যে নীরসতা, মেকিত্ব, সমালোচনা, সাহিত্যে অলংকারের ব্যবহার, সাহিত্যিক যশ, বুদ্ধির ধৈর্য ও মুক্তি, অভ্রান্ত অন্তর্দৃষ্টির সাহায্যে শিল্পের মূলতত্ত্ব ইত্যাদি বিষয়ে সংহত, যুক্তিপূর্ণ ও সাহিত্য গুণান্বিত আলোচনা করেছেন। সাহিত্য সম্বন্দ্বে লঙ্গিনুসের মূল কথা হলো মহৎ শিল্পসাহিত্য তাকে বলা যাবে, যা পাঠককে অনুপ্রাণিত কম সক্ষম। একবার নয়, বার বার পাঠে পাঠককে বার বারই অনুপ্রাণিত করবে, আনন্দ দেবে। একবার পড়লেই যে সাহিত্য পাঠের সাধ মিটে যায় তাকে শিল্পহীন সাহিত্য বলা যায়। উৎকৃষ্ট সাহিতা কেবল রসজ্ঞ বা বিদচ্ছদের জন্য নয়; বরং সর্বজনীন ও সর্বকালের। লঙ্গিনুসের ভাষায়, "যেসব সাহিত্যকর্ম চিরকাল সব পাঠককে আনন্দ দেয় তার মধ্যেই যথাযথ সত্য এবং সৌন্দর্য নিয়ে রচনার উৎকর্ষ বিরাজমান থাকে।"
সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য হিসেবে লঙ্গিনুস আনন্দ, শিল্পসৌন্দর্য, মহত্ত্বকে শিল্পের ফলশ্রুতি বলেছেন। কারণ সাহিত্য ও শিল্প আমাদের মহৎলোকে নিয়ে যায়, নতুন আনন্দলোকে প্রতিষ্ঠিত করে। সাহিত্যের এ আনন্দদানের লক্ষণের কথা অনেক সমালোচক বললেও সাথে সাথে তারা শিক্ষাদানের (Cavet) কথাও বলেছেন। কিন্তু লঙ্গিনুস শিক্ষাদান (Cavet) কে সাহিত্য বিচার থেকে সম্পূর্ণরূপে বাদ দিতে চেয়েছেন। তার মতে, সাহিত্য আমাদের বিশুদ্ধ আনন্দ দেবে এবং মহত্তর সৌন্দর্যলোকে নিয়ে যাবে- এছাড়া সাহিত্যের আর কোনো কাজ নেই। সাহিত্যের এ বৈশিষ্ট্যকে লঙ্গিনুস অপার্থিব আনন্দ বলেছেন। এ অপার্থিব আনন্দ শিক্ষার জন্য যতটা, তার চেয়ে অনেক বেশি আনন্দ উপভোগের জন্য। তিনি সাহিত্যের মধ্যে তিনটি বৈশিষ্ট্যের কথা বলেছেন। এগুলো হলো উপভোগ (Appreciation), মহত্তর জীবনবোধ (Sublime), এবং আনন্দলোকে অভিসার (Transport)। তার মতে, সাহিত্য পাঠ শিক্ষার জন্য নয়, উপভোগ বা আনন্দের জন্য। এ আনন্দ হলো মহৎ শিল্প ও চিত্তবোধের আনন্দ এবং সে মহৎ আনন্দ উপভোগের জন্য মানুষের উর্ধ্বতর চিত্তসত্তায় উপমন। সাহিত্য সম্পর্কে লঙ্গিনুসের এ অভিমতই পরবর্তীকালে বিশুদ্ধ আনন্দবাদ বা রোমান্টিকতা অভিধায় অভিহিত হয়েছে।
লঙ্গিনুস মনে করেন, সাহিত্য পাঠকেরা মনে আনন্দ সঞ্চার করতে পারছে কি না, এককথায় সাহিত্যে Sublime এর লক্ষণ আছে কি না তাই একমাত্র বিচার্য বিষয়। কারণ সাহিত্যের উদ্দেশ্য হবে লেখকের মনে মহৎ চিন্তা ও বিশুদ্ধ আবেগ সৃষ্টি করা। এরকম আবেগমুগ্ধ সাহিত্যিকের মন থেকে যে সাহিত্য সৃষ্টি হবে তাতে মহৎ শিল্প লক্ষণ থাকবে এবং ঐ মহৎ সাহিত্য পাঠকের মনে এমন একটা আবেগ ও উত্তেজনা সৃষ্টি করবে, যার মাধ্যমে পাঠক স্বীয় সীমাবদ্ধ চেতনা থেকে সৌন্দর্য ও আনন্দের উচ্চতর সভায় উন্নীত হবেন এবং ব্যাপকতায় উজ্জীবিত হবেন। যদিও লঙ্গিনুস পাঠকের উপভোগ্যতাকেই সাহিত্যের গুণাগুণ নির্ণয়ের একমাত্র মাপকাঠি বলে স্থির করেছিলেন। তবে তিনি শুধু পাঠকচিত্তের সম্মতি বা অনুরাগকেই শিল্পগুণের একমাত্র নিয়ামক শক্তি বলে মনে করেননি, তিনি সাহিত্য বিচারে পরিপক্ক বৃদ্ধি এবং অভিজ্ঞতাকেও স্বীকৃতি দিয়েছেন। তার কথায়, “সাহিত্য বিচারের যোগ্যতা অর্জন হলো। দীর্ঘ অভিজ্ঞতার শ্রেষ্ঠ অর্জন।"
লঙ্গিনুস সাহিত্যের মূল বিষয় হিসেবে 'Sublime' কে গ্রহণ করে সাহিত্যের স্বরূপ সম্বন্দ্বে কতিপয় সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন। তার মতে, Sublime শুধু মহৎ নয়; সাহিত্যে সুন্দর ও মহৎ দুই-ই চাই। এজন্য তিন মহৎ বিষয়বস্তু, আবেগ ও অনুপ্রেরণা, অলংকার সন্নিবেশ, উপযুক্ত ছন্দ, মহত্ত্বব্যঞ্জক রচনারীতি, সাহিত্যিক যশ ইত্যাদির প্রতিও গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তিনি সাহিত্যের রীতিকে প্রধান্য দিয়েছেন। 'On the Sublime গ্রন্থে তিনি সাহিত্যে রূপক, অতিসায়োক্তি, বক্রোক্তি ইত্যাদি ব্যবহারের ওপরও গুরুত্ব দিয়েছেন। রূপক অলংকারকে ললিনুস 'রচনাশৈলীর সৌন্দর্য' হিসেবে অভিহিত করেছেন। তার মতে, "অলংকারমণ্ডিত ভাষ্য ঐশ্বর্য দ্যোতনার এক স্বাভাবিক উৎস এবং রূপক ব্যবহার রচনার উৎকর্ষে যথেষ্ট ভূমিকা রাখে। অর্থাৎ রূপকের যথার্থ ব্যবহার কাব্যকে সার্থকতা দান করে। পরোক্ষ বা বক্রোক্তির প্রসঙ্গে বলেছেন, "আমার ধারণা, রচনার উৎকর্ষ সাধনে পরিক্রমণ অলংকারের ভূমিকা সম্পর্কে কেউ আপত্তি করবেন না।” সাহিত্যে অলংকার ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব দিলেও সর্বক্ষেত্রে লঙ্গিনুস পরিমিতিবোধের দিকে লক্ষ রাখতে বলেছেন। তার ভাষায়, "একজনকে অবশ্যই সবসময় জানতে হবে কোথায় সীমানা টানতে হয়।" অর্থাৎ অলংকারের ব্যবহার যেমন সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে, সুষমামন্ডিত করে তেমনি এসবের আধিক্য সাহিত্যকে শ্রীহীন ও আকর্ষণহীন করে তুলতে পারে।
লঙ্গিনুস সাহিত্যের অন্যতম নিকৃষ্ট ত্রুটি বলে উল্লেখ করেছেন সাহিত্যে নীরসতাকে। তার মতে, সাহিত্য সমালোচনাকেও রসোত্তীর্ণ হতে হবে। তিনি মনে করেন, যত্রতত্র ছন্দের মাত্রাতিরিক্ত প্রয়োগও রচনার উৎকর্ষতা নষ্ট হয়ে যায়। কোনো বেঠিক বা মেকি বিষয়ের উপস্থাপনাকে তিনি 'Sublimity' অর্জনের ক্ষেত্রে বড় বাধা বলে বিবেচনা করেছেন। পাশাপাশি সাহিত্যে মনন, ভাষা, বাক্য গঠন ইত্যাদির যথাযথ প্রয়োগের ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেছেন যে, এগুলোর যথার্থ ব্যবহার সাহিত্যকে সার্থক করে তোলে। লঙ্গিনুস বলেছেন, "সাহিত্যে আমরা এমন কিছু চাই, যা মানুষকে অতিক্রম করে যায়।" কারণ শিল্পকৌশলের ফল এবং রচনাশৈলীর বৈশিষ্ট্যের সমন্বয়ে সাহিত্য পূর্ণ সৌন্দর্য লাভ করে। তবে সাহিতা সম্বন্দ্বে তিনি যাত কথাই বলুন না কেন, সাহিত্যের আদর্শ সম্বন্ধে তার অভ্রান্ত আশঙ্কার মনোভাব সম্পর্কে লঙ্গিনুস সর্বদা অবহিত এবং নানা কথার মধ্যে সেকথাটিই তিনি বার বার প্রকাশ করেছেন। তিনি মনে করেন, শ্রেষ্ঠ সাহিত্য আমাদের মনকে আলোড়িত করবে, উত্তেজিত করবে, মহত্তর করবে, উর্ধ্বতর সত্তায় নিয়ে যাবে, ভাবগত উন্মত্ততায় আকৃষ্ট করবে। আর এটিই হলো লঙ্গিনুষের সাহিত্য বিষয়ক মৌলিক সিন্ধান্ত।
লঙ্গিনুস সাহিত্যবিষয়ক নানা প্রসঙ্গের অবতারণা করেছেন। এ থেকে বুঝা যায়, তিনি যেকোনো প্রাচীন সমালোচকের চেয়ে আধুনিক। রচনারীতি, আবেগ, সৌন্দর্য, বক্তব্যের বিষয় সাহিত্যিকের একাগ্রতা প্রভৃতি সম্পর্কে তার মতামত ও যৌক্তিকতার আধুনিকতা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণীয়। তার মতো বিবর্তনের মধ্য দিয়েই সাহিত্যে কলাকৌশলবাদী ধাধার সৃষ্টি হয়েছে বলে অনেকে মত প্রকাশ করেছেন। কারণ সাহিত্যও সাহিত্যের আদর্শ সম্বন্দ্বে লঙ্গিনুসের তার মনোভাব ও বস্তুবাই তাকে স্মরণীয় ও বরণীয় করে রেখেছে।