সাহিত্য-সমালোচনায় ঐতিহাসিক পদ্ধতির গুরুত্ব সম্পর্কে আলোচনা কর। অথবা, সাহিত্য সমালোচনায় ঐতিহাসিক পদ্ধতির প্রয়োগ ও গুরুত্ব লেখ।
সমালোচনার ক্ষেত্রে ইতিহাসমূলক সাহিত্য সমালোচনা পদ্ধতি হলো সেই রীতি যেখানে যুগচিত্ত পরিবেশ পরিপার্শ্ব এবং ইতিহাসে সম্ভাব্য স্থান নির্ণয় প্রভৃতির সম্যক আলোচনা থাকে সেখানে ঐতিহাসিক পদ্ধতি আছে বলা হয়। অন্য কথায় দেশ ও কালের উল্লেখযোগ্য ঘটনাসমূহের অবিকল বর্ণনাই ইতিহাস রচনার ইতিহাস ও পটভূমিকার প্রতি নিবন্ধ থেকে সমালোচক যে সমালোচনা করেন তাকে ইতিহাসমূলক সমালোচনা বলা হয়
পাশ্চাত্যে ইতিহাসমূলক সাহিত্য সমালোচনা পদ্ধতির প্রবর্তন করেছিলেন হিপোলাইত তেইন (Taine)। মার্কিন সংকলকদ্বয় হ্যান্ডি ও ওয়েস্টব্রুকের Twentieth Century Criticism (১৯৭৪) এ Historical Criticism অংশে তেইন ছাড়া অন্যান্য সমালোচকদের মধ্যে ছিলেন ট্রিলিং, এডমন্ড উইলসন, পিয়ার্স, এলম্যান প্রমুখ। তেইনের আগে ভিকোর ইলিয়াড ওডিসি মহাকাব্য দুটির আলোচনায় কিংবা হেগেলের Philosophy of History শীর্ষক বক্তৃতায় সাহিত্য ও নিত্য পরিবর্তনশীল দেশ-কাল-সমাজের মধ্যকার সম্পর্কের কথা ছিল। তেইনের সমকালীনদের মধ্যে সাঁৎ ব্যুভ মূলত ঐতিহাসিক ও সামাজিক প্রেক্ষিতে সাহিত্যিকের ব্যক্তিমানসের বৈচিত্র্য সন্ধানের কথা বলেছিলেন।
সাহিত্য সমালোচনার ক্ষেত্রে হিপোলাইত তেইনের তিনটি অনুধাবনীয় সূত্র হচ্ছে: Race (জাতি), Milieo (দেশ) এবং Moment (সময়)। তেইনের রীতিকে অনেকে 'সাহিত্যে সমাজতত্ত্ব' রীতি নামে আখ্যায়িত করেন এবং তাকে এ রীতির প্রবর্তক বলে মান্য করা হয়। তেইন পরবর্তী সময়ে আরও অনেকেই এ পদ্ধতি সারাবিশ্বেই ব্যবহার করেছেন এবং সংগত কারণেই কিছুটা
পরিবর্তনও আনেন। এক্ষেত্রে লিওলেন ট্রিলিংয়ের অবদানও
উল্লেখযোগ্য। বলা হয়ে থাকে, ঐতিহাসিক সমালোচনা পদ্ধতি
লিওলেন ট্রিলিংয়ের হাতে পূর্ণতা পায়। বাংলা সাহিত্যে বিনয় ঘোষ
এ রীতিতে সমালোচনার ধারায় অন্যতম পথপ্রদর্শক। অরবিন্দ
পোদ্দারের 'বঙ্কিম মানস', সীতাংশু মৈত্রের 'যুগন্ধর মধুসূদন',
রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর 'মহাকাব্যের লক্ষ্মণ' ঐতিহাসিক পদ্ধতির সমালোচনা।
ঐতিহাসিক সমালোচনা পদ্ধতি ইতিহাসকে ব্যবহার করে সাহিত্যকর্মটিকে ভালো করে বুঝাতে চেষ্টা করে। কারণ ইতিহাসকে তারা গ্রহণ করে সজীব বস্তুরূপে, সচল প্রবাহরূপে অবশ্যই অতীতের কোনো মৃত বা পরিত্যক্ত স্মৃতিচিহ্নরূপে নয়। তারা মনে করেন, ইতিহাস আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকে সাহিত্যবস্তুর অভ্যন্তরে। শিল্পসাহিত্য তাদের কাছে একটি ঐতিহাসিক শিল্প। তাই সাহিত্যবিচারও সবসময়ই একটি ঐতিহাসিক বীক্ষা বা বিশ্লেষণ। ঐতিহাসিক সমালোচক প্রধানত দুটি দিকে মনোযোগ দেন। এক. রচনাকালীন সময়ের সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক অবস্থা কীভাবে লেখাকে প্রভাবিত করেছে। দুই. এ পটভূমি বদলে যাওয়ার পরে সাহিত্যকর্মটির মূল্য বদলে যায় কি না।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'পথের পাঁচালি'র ইন্দির ঠাকুরণের দাম্পত্যজীবনকে কিছুতেই বুঝা যাবে না, যদি না জানি সেসময়ের হিন্দুসমাজের রীতিনীতি। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের একটি উপন্যাসে একজন বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ কীভাবে তিন যুবতি বোনকে একত্রে বিয়ে করে তা বুঝা যাবে না, যদি ঐসময়ে হিন্দুসমাজের ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রভাবটি না জানি। ব্রাহ্মণ্যবাদ না জানলে 'হৈমন্তী' গল্পের হৈমন্তীর অকালমৃত্যুর কারণ বুঝা যাবে না। সেসময়কার সমাজজীবন না বুঝলে একান্নবর্তী পরিবার ও নিকটাত্মীয়দের অবস্থান বুঝা যাবে না। হৈমন্তীর জীবনে সঙ্কট আসে তার স্বামীর দূর সম্পর্কিত এক বৃদ্ধ আত্মীয়ার প্রশ্নকে ঘিরে : 'বউমার বয়স কতো?' জেন অস্টিন ইংরেজি সাহিত্যের একজন লেখিকা। ১৭৯৫ সালের পটভূমিতে রচিত তার একটি উপন্যাসে ধনী পিতার কন্যাসন্তানের দুরবস্থার কথা চিত্রিত হয়েছে। ধনী পিতার সন্তান হয়েও কন্যা নিঃস্ব, কারণ তখনো ইংল্যান্ডে পিতার মৃত্যুর পর কন্যাসন্তান পিতার সম্পত্তির উত্তরাধিকার হতো না। এ আইনটি না জানলে কিছুতেই ঐ মেয়েটির সামাজিক বা মনোজাগতিক অবস্থাটি বিশ্লেষণ সম্ভব নয়।
লেখকের কাজ হচ্ছে গল্প কিংবা উপাখ্যান বলার মধ্য দিয়ে ইতিহাসের কাঠামোর মধ্যে যে বৈপরীত্যগুলো আছে সেসব সামনে আনা। উপাখ্যানের অংশ, গল্পের অংশ কাজটির সাহিত্যিক মূল্য তৈরি করে। এ উপখ্যান, গল্প, রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করা যায় না, বিচার করা যায় না প্রগতিশীল কিংবা প্রতিক্রিয়াশীলতার মাপকাঠিতে, বরং মাপকাঠি হচ্ছে কতদূর পর্যন্ত গল্পটি, উপাখ্যানটি মতাদর্শিক অবস্থানের ভিতর পর্যবসিত করা সম্ভব হয় না। সেজন্য টলস্টয় কিংবা রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে লেখক তার যুগের, সময়ের বৈশিষ্ট্য কতদূর ধরতে সক্ষম হয়েছেন, এ মাপকাঠিই বিচার্য। টলস্টয় কিংবা রবীন্দ্রনাথ জন্মেছেন অভিজাত হয়ে, ফিউডাল অভিজাত শ্রেণির সদস্য হিসেবে মৃত্যুবরণ করেছেন। প্রয়াস পেয়েছেন অনভিজাত শ্রেণির শ্রেণি পরিপ্রেক্ষিতের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করতে। টলস্টয় কিংবা রবীন্দ্রনাথ চিত্রিত করেছেন তাদের সময়ের সংক্ষুব্ধতা। একই সঙ্গে উদ্ভিদ্যমান ব্যবস্থার সব দিক ধরতে পারেননি। ধনতন্ত্রের পরিবৃদ্ধি সম্বন্ধে তারা অনুভূতিপ্রবণ ছিলেন, যে ধনতন্ত্র জমিদার ও কৃষকের অস্তিত্ব প্রশ্ন সংকুল করেছে। তবু তারা বুর্জোয়াদের ক্ষমতার সব দিক ধরতে পারেননি কিংবা ধরতে চাননি।
টলস্টয়ের ক্ষেত্রে দেশজ ধনতন্ত্রের স্বরূপ এবং রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে কলোনিয়াল ধনতন্ত্রের স্বরূপ খণ্ডিতভাবে ধরা দিয়েছে। এ খণ্ডিতকরণের প্রধান উপাদান তাদের দুজনের ঈশ্বরবোধ।
টলস্টয় অর্থোডক্স ক্রিশ্চিয়ানিটির মধ্য দিয়ে তার ঈশ্বরকে সম্পর্কিত করেছেন চাষিদের সঙ্গে, ঈশ্বর কিংবা অভিজাতরা তাদের নির্যাতন করেছে, নির্যাতন থেকে তাদের মুক্তি দেয়নি।
রবীন্দ্রনাথও ব্রাহ্মবাদের মধ্য দিয়ে তার ঈশ্বরকে সম্পর্কিত করেছেন চাষিদের সঙ্গে, ব্রাহ্মবাদের ঈশ্বর তাদের নির্যাতন করেছে, নির্যাতন থেকে তাদের মুক্তি দেয়নি। ঈশ্বর এবং দেশজ ধনতন্ত্র ঈশ্বর এবং কলোনিয়াল ধনতন্ত্রের মধ্যে তারা দুজনই ঘুরপাক খেয়েছেন, এসবই ঐতিহাসিক বাস্তবতা ও সাহিত্যের মধ্যে কাজ করেছে। এখান থেকেই উদ্ভূত হয়েছে তাদের সাহিত্যিক স্টাইল, নিষ্ঠুর সত্য উচ্চারণ করার ক্ষমতা। 'ওয়ার অ্যান্ড পিস' এবং 'আনা কারেনিনা'; 'গোরা' এবং 'যোগাযোগ' তার উদাহরণ। এসব বই ঐতিহাসিক বাস্তবতার ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ, পুরুষ ও নারীর অবস্থানের ক্ষেত্রে লেখকের বাছাইয়ের বোধ সমাজের বিভিন্ন বৈপরীত্যের ক্ষেত্রে পক্ষ নেওয়ার প্রয়াস এবং এভাবে লেখক হিসেবে নিজেদের বেড়ে চলার হিসাবনিকাশ।
সাহিত্য সমালোচনা হচ্ছে সাহিত্য ও ঐতিহাসিক বাস্তবতার মধ্যকার সম্পর্ক বুঝার প্রয়াস। এ প্রয়াসে যুক্ত সাহিত্য ক্ষেত্রে মতাদর্শের ক্রিয়াশীলতার তাত্ত্বিকতা। সাহিত্য সমালোচনার অন্যদিক হচ্ছে নান্দনিক তত্ত্বের সঙ্গে বোঝাপড়া করা। বোঝাপড়াটা রাজনৈতিক তত্ত্বের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। সম্পর্কের ভিত্তি টেক্সট ও ঐতিহাসিক পর্বের যোগাযোগ। এতটা ঐতিহাসিকতার মধ্যে বিভিন্ন মনোভঙ্গির যোগাযোগ বিশ্লেষণ করা জরুরি। যেমন- লেনিনের টলস্টয়বিষয়ক কাজ। লেনিনের রাজনৈতিক তত্ত্ব ও ১৯০৫ এর রাশিয়ার রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে একটা সম্পর্ক আছে। সম্পর্কটা একত্র করেছে তত্ত্বের দু'ধরনের ফর্ম: সাহিত্যের নান্দনিক তত্ত্ব ও রাজনীতির ঐতিহাসিকতা। একটা সাহিত্যিক টেক্সট যে পর্বের সঙ্গে যুক্ত, সেই যুক্ততা লেখকের সৃষ্টিশীল জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত নাও হতে পারে। ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ততাকে স্বতঃস্ফূর্ততার মধ্যে পর্যবসিত করা সবসময় সম্ভব হয় না। কাজ এবং কার্য কিংবা লেখকের মধ্যে সময়ের ফারাক থাকতে পারে। রবীন্দ্রনাথের 'গোরা' কিংবা তারাশঙ্করের 'হাসুলিবাঁকের উপকথা' কিংবা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'পুতুল নাচের ইতিকথা' কিংবা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর 'কাঁদো নদী কাঁদো'র উল্লেখ করা যায়। এসব কাজে, টেক্সটে, লেখক তার সময়ের সেকেন্ডারি ঝোঁকের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেছেন কিংবা অতীতের যেসব ঝোঁক টিকে আছে তার সঙ্গে নিজেকে সম্পর্কিত করেছেন। টেক্সটিতে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে বিশেষ পর্বের ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক, নান্দনিক লক্ষণগুলো। , কিন্তু মনে রাখতেই হবে সম্পর্কটা নেহাৎ প্রতিচ্ছবি নয়।
ইতিহাসের পর্ব এবং সাহিত্যিক টেক্সটের যোগাযোগ আলাদা, এর মধ্যে ফাঁক থাকে। ইতিহাসের পর্ব তৈরি করে একসার মতাদর্শ, সেক্ষেত্রে সাহিত্যের কাজ ধরা যাক 'বিষাদসিন্ধু' কিংবা 'খোয়াবনামা' কিংবা 'বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ', একটা নির্দিষ্ট শ্রেণি পরিপ্রেক্ষিতের মধ্যে পর্যবসিত করা যায় না, টেক্সটি একটি কিংবা দুটি মতাদর্শিক ঝোঁক থেকে উৎসারিত বলে 'সত্যের' স্টেটাস পেয়ে যায়। সেজন্য সাহিত্যের কাজ লেখকের শ্রেণি পরিপ্রেক্ষিতের ওপর নির্ভরশীল হওয়া সত্ত্বেও ইতিহাসের দিক থেকে অসম্পূর্ণ এবং কাজটি কোনো জ্ঞান তৈরি করে না। সাহিত্য এ অর্থে জ্ঞান নয়। জ্ঞান হতে হলে সব মতাদর্শিক ঝোঁক গ্রহণ করতেই হবে, জীবন্ত অভিজ্ঞতার পরপারে পৌঁছতেই হবে। সাহিত্যে এভাবে সম্পূর্ণ ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ প্রদান করে না, প্রদান করে একটা দৃষ্টিভঙ্গি। যে দৃষ্টিভঙ্গি আংশিক এবং খণ্ডিত। সাহিত্য সমালোচনায় সেজন্য দৃষ্টিভঙ্গি, দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে তার অবস্থান না।
ঐতিহাসিক সমালোচনা যেসময়ে গল্প, কবিতা তথা সাহিত্যকর্মটি রচিত হয়েছে সেসময় এবং সাহিত্যকর্মে বিধৃত সময় দুটি সময়কেই বিশ্লেষণ করতে চায়। আবার যেসময়ে পাঠক লেখাটি পড়ে, সেসময়টাও সমালোচকের একটি আগ্রহের বিষয়। সাহিত্যের বিষয় এবং সাহিত্যে ব্যবহৃত নির্দিষ্ট বা বিশেষ শব্দ, উপমা, রূপক, প্রতীক, চিত্রকল্প, চরিত্র, পরিণতি ইত্যাদির অর্থ, প্রয়োগ ও বিশ্লেষণ তাদের গবেষণার বিষয়। সাহিত্যকর্মে উপস্থাপিত চরিত্র বুঝার জন্য চরিত্রের স্থান, কাল ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা বুঝা জরুরি বলে মনে করেন। অনেক সময় লেখকের উদ্দেশ্য বুঝা যায় না, যদি না যেসময়ে লেখা হয়েছে, সেসময়টির রীতিনীতি বা সামাজিক সাংস্কৃতিক রীতিনীতি না বুঝা যায়।