বাংলা সাহিত্য-সমালোচনার পথ নির্মাণে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অবদান আলোচনা কর। অথবা, সাহিত্যতাত্ত্বিক ও সমালোচক হিসেবে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কৃতিত্বের মূল্যায়ন কর।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৮-১৮৯৪) উনিশ শতকের বাংলার প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক, সাহিত্যিক, কবি। তার রচনা বঙ্কিম রচনাবলি নামে বিখ্যাত, কারণ তিনি তার লেখায় ভিন্ন স্বাতন্ত্র্য সৃষ্টি করেছেন। বাংলা উপন্যাস ও বাংলা গদ্যসাহিত্যের উৎকর্ষ সাধনে বঙ্কিমচন্দ্রের অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তার সম্পাদিত বঙ্গদর্শন পত্রিকার মাধ্যমে একটি নতুন লেখক গোষ্ঠীর আবির্ভাব ঘটে। তারা সাময়িকী সাহিত্যের বিষয়বস্তু এবং রচনাশৈলীর দিক থেকে নতুন আদর্শ স্থাপন করেন। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য উভয় সাংস্কৃতিক জীবনের তুলনামূলক আলোচনার মাধ্যমে বঙ্কিমচন্দ্র এক বিশিষ্ট জীবনদর্শন স্থাপনের চেষ্টা করেছেন।
সাহিত্য ও সাহিত্য সমালোচনা- এদের মধ্যে প্রকৃত সম্পর্ক কী, রসস্রষ্টা ও রসপ্রমাতা- এরা কি 'অভিন্নভাবে' সংযুক্ত অথবা উভয়ের মধ্যে জ্ঞাতিশত্রুতা আছে। রসের জন্ম হৃদয়ে, সমালোচনার জন্ম মস্তিষ্কে। কিন্তু সমালোচকও কিঞ্চিৎ পরিমাণে রসস্রষ্টা; তা না হলে সাহিত্যবিচার, শুধু নৈয়ায়িক লাঠিবাজিতে পরিণত হবে। সমালোচক অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় প্রদত্ত কথাগুলো তার সমালোচনার কথাসাহিত্যে বলেছেন- রসস্রষ্টাও কিঞ্চিৎ পরিমাণে সমালোচক ও বিচারক বটে, তা না হলে রসসৃষ্টি উদ্দাম আবেগে দিগভ্রষ্ট হয়ে যাবে।
সমালোচনা বা সাহিত্য বিচার বলতে সাধারণত আমরা কী নির্দেশ করে থাকি, আগে তার স্বরূপ লক্ষণ জানার চেষ্টা করা উচিত, তা না হলে সবকিছুই পণ্ডশ্রম বলে গণ্য হবে। আমরা দেখলাম সাহিত্য বিচারের মূল কথা হলো মূল্য বিনির্ণয়। বিশেষ গ্রন্থ বা কবিপ্রকৃতির স্বরূপ নির্ণয় করতে হলে এ মূল্যের স্বরূপ আগে বুঝে নিতে হবে। তাহলে সমালোচক বা রসপ্রমতা কোনো কোনো মূল্যমানের সাহায্যে সাহিত্যের গুণাগুণ নির্ণয় করেন। তিনভাবে এ বিচার বা মূল্যায়ন হওয়া সম্ভব। যথা: ১. ব্যাখ্যান, ২. বিচার ও ৩. রসোপভোগ।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সাহিত্য সমালোচনায় প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত যে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন তা অত্যন্ত বিস্ময়কর। বঙ্কিমচন্দ্র তার সাহিত্যজীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সাহিত্য ভাবনায় জড়িত ছিলেন। তিনি তার কিছু কিছু প্রবন্ধে সরাসরি সাহিত্যতাত্ত্বিক মতামত পেশ করেছেন। তবে বেশিরভাগ প্রবন্ধেই তিনি সাহিত্যিক সম্পর্কে সমালোচনা করতে গিয়ে তার নব নব সাহিত্যচিন্তার উদ্ভব ঘটিয়েছেন। সমালোচনার সূত্রে তিনি সাহিত্যতত্ত্ব নিয়ে হাজির হয়েছেন।
বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্যবিষয়ক প্রবন্ধগুলোকে দুটি ভাগে ভাগ করা
যায়। যথা: সাহিত্য রূপকল্প (Form) ও সাহিত্য সমালোচনা (Criticism)। এই দুই শ্রেণির প্রবন্ধের আলোকে সাহিত্যতত্ত্ব ও সাহিত্য সমালোচনার বিভিন্ন স্থানে বঙ্কিমের কর্তৃত্ব অনেকাংশে বেশি।
বঙ্কিমচন্দ্র এমন একজন খ্যাতিমান সমালোচনা সাহিত্যিক যার
প্রসঙ্গে মোহিতলাল মজুমদার জ্বলে উঠেছেন যখন দেখেছেন বঙ্কিমচন্দ্রের কোনো কোনো উপন্যাসকে ঐতিহাসিক উপন্যাসের পর্যায়ভুক্ত করা হয়েছে। কেননা বঙ্কিম তো ঐতিহাসিক উপন্যাস লেখেননি, সেকথা তিনি নিজেই বলেছেন, তবুও বঙ্কিম উপন্যাসকে ঐ ঐতিহাসিক উপন্যাসের পর্যায়ভুক্ত করার অর্থ নিন্দাত্মক সমালোচনার সুযোগ লাভ সেখানে রোমান্সের ফেনিল আতিশয্য যতটা, ততটাই তথ্যানুগামিতার অভাব।
সমালোচনা সাহিত্যতাত্ত্বিক বঙ্কিম 'গীতিকাব্য' প্রবন্ধে গীতিকাব্যের লক্ষণ ও স্বরূপ নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করেছেন। এ প্রবন্ধটি
সংক্ষিপ্ত হলেও বঙ্কিমচন্দ্রের সূক্ষ্ম চিন্তা ও গভীর মননধর্মের পরিচয় সুস্পষ্টভাবে পরিস্ফুট হয়েছে অত্যন্ত নিপুণভাবে। গীতিকাব্য সম্পর্কে বঙ্কিম বলেছেন, "বক্তার ভাবোচ্ছ্বাসের পরিস্ফুটন মাত্র যাহার উদ্দেশ্য, তাহাই মূলত গীতিকাব্য।"
বহুস্বর জীবনের ব্যক্ত স্তরের গল্প ও নিহিত স্তরের বক্তব্য বিশ্লেষণে বঙ্কিমের উপন্যাস সমালোচকের আলোচনার কাঠামো। প্রায় এ কথাই বলেছিলেন মোহিতলাল মজুমদার যখন তিনি বঙ্কিম উপন্যাসকে নানা শিরোনামে চিহ্নিত হতে দেখেছেন। "সকল সত্যকার সাহিত্য স্রষ্টার মতো (বঙ্কিমচন্দ্র) তাহার স্বকীয় কবিদৃষ্টি এবং জগৎ ও জীবন সম্বন্দ্বে তাহার নিজের আত্মিক রস্কোপলব্ধির প্রেরণায় যাহা রচনা করেছিলেন-
"জাতি (Class) হিসেবে তাহাদের নাম যাহাই হউক, তাহাদের সেই বিশেষ রূপের নাম বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস ছাড়া আর কিছুই হইতে পারে না।"
বঙ্কিমচন্দ্র বাঙ্গালা ভাষা প্রবন্ধে সাহিত্যের ভাষা সম্পর্কে বিভিন্ন অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তার মতে, রচনার প্রথম ও - প্রধান গুণ হলো সরলতা ও প্রাঞ্জলতা। এজন্য তিনি যেকোনো ভাষার শব্দ ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলেন- "বলিবার কথাগুলো পরিস্ফুট করিয়া বলিতে হইবে। যতটুকু বলিবার আছে সবটুকু বলিবে, তজ্জন্য- ইংরেজি, ফারসি, আরবি, সংস্কৃত, গ্রাম্য, বন্য যে ভাষার শব্দ প্রয়োজন তাহা গ্রহণ করিবে, অশ্লীল ভিন্ন কাহাকেও ছাড়িবে না।"
সাহিত্য সমালোচনার সূত্রে বঙ্কিমচন্দ্র উত্তর চরিত্র প্রবন্ধে সাহিত্যতত্ত্বমূলক কিছু তত্ত্ব কথা প্রকাশ করেছেন। এখানে তিনি সাহিত্যের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, কবির গুণ সম্পর্কে বলেন, "কবির প্রধান গুণ সৃষ্টি ক্ষমতা। যে কবি সৃষ্টিক্ষম নহেন, তাহার রচনার অন্য অনেক গুণ থাকলেও বিশেষ প্রশংসা নাই।"
তিনি কাব্যের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেন, "কাব্যের উদ্দেশ্য নীতিজ্ঞান নহে, কিন্তু নীতিজ্ঞানের যে উদ্দেশ্য কাব্যেরও সে উদ্দেশ্য।" ধর্ম ও সাহিত্য প্রবন্ধে বঙ্কিমচন্দ্র বলেছেন, "সাহিত্যের জন্য সাহিত্য নয়, ব্যক্তিত্বের কোন বিশিষ্ট আনন্দের জন্যও সাহিত্য নয়, ধর্মের জন্যই সাহিত্য।"
বাঙ্গালা ভাষা প্রবন্ধে ও সমালোচনা সাহিত্যের প্রথম কীর্তিমান স্রষ্টা বঙ্কিমচন্দ্র। তিনি মনে করেন, ভারতীয় আর্য ও অনার্য জাতির বিবাদের ফলে সৃষ্টি হয়েছে রামায়ণ ও মহাভারত।
পরবর্তীকালে সুখী ও কৃতী ভারতবাসীরা ধর্ম ও দর্শনশাস্ত্রে মনোযোগ দেয়। সেই ধর্মমোহের ফলে পুরাণ সৃষ্টি হয়। তবে ধর্মের স্রোতের পাশাপাশি বিলাসিতার স্রোত এবং এর পাশাপাশি কালিদাসের কাব্য নাটকাদির সৃষ্টি হয়েছে। বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্য
সমালোচনা মুখ্য প্রবন্ধসমূহের মধ্যে শকুন্তলা, মিরন্দা এবং দেসদিমোনা প্রবন্ধটিও বিশেষ উল্লেখযোগ্য এবং বাংলা ভাষার একটি শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ বলে চিহ্নিত। কালিদাসের অভিজ্ঞান শকুন্তলম এর শকুন্তলা চরিত্রকে শেক্সপিয়রের Tempest ও Othelo এর
যথাক্রমে মিরন্দা ও দেসদিমোনা চরিত্রদ্বয়ের সাথে তুলনা করা
হয়েছে। এ প্রবন্ধের শেষে বঙ্কিমচন্দ্র বলেছেন, শকুন্তলা অর্ধেক মিরন্দা, অর্ধেক দেসদিমোনা। সমালোচনা সাহিত্যে চরিত্রের এমন তুলনামূলক আলোচনার সাক্ষ্য পাওয়া দুর্লভ। এছাড়াও উত্তর চরিত্র বঙ্কিমের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্য সমালোচনাত্মক দীর্ঘ প্রবন্ধ। সরস
বিশ্লেষণ ও গভীর রসবোধের সার্থক সম্মিলনে প্রবন্ধটি সমুজ্জ্বল। উত্তর চরিত্র প্রবন্ধে আদ্যোপান্ত বিশ্লেষণ করেছেন। এ বিশ্লেষণে তিনি পাশ্চাত্য, গ্রিক, রোমান সাহিত্য সমালোচনার রীতিতে গ্রহণ করেছিলেন। সেই সাথে প্রাচ্য অলংকারশাস্ত্রের সম্মিলনে বঙ্কিম প্রগতিশীল এক সাহিত্য সমালোচনার জগৎ আবিষ্কার করলেন।
বঙ্কিমচন্দ্রের ওপরে রচিত সুবোধচন্দ্রের গ্রন্থটি রবীন্দ্র গ্রন্থালোচনার মতোই চিন্তাসমৃদ্ধ। নানা দৃষ্টিকোণের সমন্বয় সেখানে ঘটেছে। সাতটি পরিচ্ছেদে বঙ্কিম- প্রতিভার মূল্যায়ন তিনি করেছেন।
সাহিত্য রচনার পিছনে দেশের বা মনুষ্যজাতির মঙ্গলসাধন অথবা সৌন্দর্য সৃষ্টিতে সক্রিয় থাকা উচিত বলে বঙ্কিমচন্দ্র জানিয়েছিলেন। বঙ্কিমের নিজের সাহিত্যে এই নীতি কতখানি প্রযুক্ত, সেদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে সুবোধচন্দ্র বললেন, "বঙ্কিমচন্দ্র বিশ্বব্রহ্মান্ডের অন্তরালে অনির্বচনীয় শৃঙ্খলার অস্তিত্বে বিশ্বাসী ছিলেন এবং পার্থিব জগতে এই অনির্বচনীয় ঐক্যের প্রকাশ ও প্রতিক্রিয়ার রূপ আঁকিতে চেষ্টা করিয়াছেন।" অবশ্য বয়স এবং অভিজ্ঞতায় তার এ ধারণার পরিবর্তন এসেছে। তিনটি পর্বে বঙ্কিম উপন্যাসকে বিভক্ত করে সুবোধচন্দ্র বলেছেন, বঙ্কিম তার প্রথম পর্বের উপন্যাসে (দুর্গেশনন্দিনী, কপালকুণ্ডলা, মৃণালিনী) নিয়তির অনতিক্রমণীয় বিধানের মধ্যে মানবজীবনের সমস্যার সূত্র বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছিলেন। দ্বিতীয় যুগে (চন্দ্রশেখর, রজনী, কৃষ্ণকান্তের উইল, রাজসিংহ) মানবের শক্তিতে ক্রমশ আস্থাবান বঙ্কিমচন্দ্রের নিয়তির অলঙ্ঘ্যতা সম্পর্কে বিশ্বাস যেন শ্লথ হয়েছে বলে সুবোধচন্দ্রের ধারণা। এবং প্রথম পর্বের উপন্যাসে (দেবী চৌধুরানী, সীতারাম, আনন্দমঠ) বঙ্কিমচন্দ্রের ধর্মতত্ত্বের বৈশিষ্ট্য সূচিত।
গ্রন্থের দ্বিতীয় অধ্যায়ে (উপন্যাস-রূপকথা-রোমান্স: "বঙ্কিমী রীতি) কথাশিল্পের তিনটি রীতির উল্লেখ করে সুবোধচন্দ্র বঙ্কিম- রচনাকে প্রধানত রোমান্সের অন্তর্গত করেছেন। বঙ্কিমচন্দ্র প্রধানত রোমান্স রচনা করেছেন।" রোমান্সের শর্ত মেনে বাস্তবের ভিত্তিভূমি যেমন সেখানে আছে, তেমনি 'বিস্ময়কর ও অলৌকিকের' উল্লেখও চোখে পড়ে। ইতিহাস এবং দৈবশক্তি থেকে এই রোমান্সের উপাদান সংগ্রহ করেছেন বঙ্কিমচন্দ্র। সুবোধচন্দ্র না বলে পারেননি যে, বঙ্কিমচন্দ্র অনেক ক্ষেত্রে সম্ভাব্যতা ও সংগতির সীমা লঙ্ঘন করিয়া আজগুবি গল্প রচনা করেছেন। এর উদাহরণ মৃণালিনী, চন্দ্রশেখর, বিষবৃক্ষ। কখনো কখনো মানবচরিত্রের মহিমাও উপন্যাসে রোমান্সের পর্যায়ভুক্ত। যেমন- কৃষ্ণকান্তের উইল এবং রজনী। রোমান্সের মধ্যে হাস্যরসের অনুপ্রবেশও সার্থক বলে সুবোধচন্দ্র মনে করেন নি, যদিও তার মতে বঙ্কিমচন্দ্র শ্রেষ্ঠ হাস্যরসিক। "বঙ্কিমচন্দ্র সেইখানেই উচ্চাঙ্গের সৃজনী প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন যেখানে ঐতিহাসিক ভূমিকা, অনৈসর্গিক নিয়তি, নৈসর্গিক শোভা ও হৃদয়ের গতিবেগ প্রাবল্যে নরনারীর কাহিনি বিস্তৃতি ও গভীরতা লাভ করিয়াছে।"
বঙ্কিম উৎপন্যাসের গঠনকৌশলও সুবোধচন্দ্রের আলোচনার অন্তর্ভুক্ত। দুই দিক থেকে সেই বিচার তিনি করেছেন, প্রথমত, উপন্যাস কাহিনির সঙ্গে নাট্য-কাহিনির মিশ্রণ কীভাবে হয়েছে, দ্বিতীয়ত, উপন্যাসের আখ্যায়িকার জটিল অংশের মধ্যে ঐক্যসূত্র কীভাবে গ্রাথিত। উপন্যাসের মধ্যে নাট্যঘটনার আগমন প্রসঙ্গে শরৎচন্দ্রের কথা এনে সুবোধচন্দ্র এ ব্যাপারে বঙ্কিমের সঙ্গে তার ঐকা-পার্থক্য চিহ্নিত করেছেন। কমলাকান্তের দপ্তর, মুচিরাম গুড়ের জীবনচরিত, লোকরহস্য, বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে হাস্যরসিক বঙ্কিমচন্দ্রকে তিনি তুলে ধরেছেন। কিন্তু এও তার কাছে গোপন ছিল না যে, সেই হাসির পিছনে নীতিশিক্ষক বঙ্কিমচন্দ্রের শাসনতর্জনী বিদ্যমান। সুবোধচন্দ্র লিখেছেন, "বঙ্কিমচন্দ্র যাহাদিগকে ব্যঙ্গ করিয়াছেন তাহাদের প্রতি তাহার কোনো সহানুভূতি ছিল না। কমলাকান্তের সুতীব্র বেদনাবোধ আছে, কিন্তু তাহা বিদুপের মধ্যে করুণরসের সঞ্চার করিতে পারে নাই। এই নির্মমতা বঙ্কিমচন্দ্রের দৃষ্টিকে কোথাও ঝাপসা হইতে দেয় না। এখানেই শরৎচন্দ্রের সঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্রের হাস্যরসের পার্থক্য। শরৎচন্দ্র মানুষকে নিয়ে পরিহাস করলেও অনেক সময়েই তা সমবেদনার শিশিরে আর্দ্র।"
বঙ্কিমচন্দ্রের ইংরেজি রচনা রাজমোহনস্ ওয়াইফকে সুবোধচন্দ্র আলোচনার মধ্যে এনেছেন। প্রশ্ন করেছেন, "ইহা কি শৈশবের হামাগুড়ির মতো বিস্মরণীয়? বঙ্কিমচন্দ্রের প্রতিভা যে পথ বাহিয়া পরিণতি লাভ করেছে, ইহার মধ্যে কি তাহার পূর্বাভাস পাওয়া যায়?" পাওয়া যায় বলেই সুবোধচন্দ্রের বিশ্বাস। তাই রোমান্স রচনা এবং চরিত্রসৃষ্টির প্রতি বঙ্কিমচন্দ্রের আকর্ষণ এখানে লক্ষণীয়। তবে তার পরিণত রচনার মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্বের যে চিহ্ন বর্তমান, এখানে তা সম্পূর্ণভাবে অনুপস্থিত।
রবীন্দ্রনাথের মতো বৃহৎ আকারের গ্রন্থ বঙ্কিমচন্দ্র নয় এবং তা হওয়া সম্ভবও ছিল না। কারণ ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্রই সুবোধচন্দ্রের চিন্তার কেন্দ্রস্থলে বিরাজিত। সামান্য কিছু জায়গা নিয়েছে 'কমলাকান্ত', 'লোকরহস্য' এবং 'মুচিরাম গুড়'। ফলে পুরো গ্রন্থজুড়ে বিষয় এবং আঙ্গিকের নিরিখে বঙ্কিম উপন্যাসের বিশ্লেষণ করেছেন সুবোধচন্দ্র। আবেগ কিংবা ভাবালুতা এখানে প্রশ্রয় পায়নি এবং সেই কারণেই নীতির দ্বারা শাসিত বঙ্কিমচন্দ্রের রচনাকে সমালোচনার চোখে দেখা তার পক্ষে সহজ হয়েছে। এই গ্রন্থে বিশ্লেষণাত্মক সমালোচনারীতির প্রখর প্রয়োগ আমরা দেখেছি। এর পিছনে ছিল সুবোধচন্দ্রের মনোভূমিতে সক্রিয় ইংরেজি সমালোচনা রীতি। গ্রন্থশেষে একটা কথা মনে না জেগে পারে না, বঙ্কিমচন্দ্রের প্রতিভার সামগ্রিক মহিমা সুবোধচন্দ্রের এই গ্রন্থে উপযুক্ত মূল্য পায়নি। বিশ্লেষণ করলে বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসে ত্রুটি আবিষ্কার করা শক্ত নয়, কিন্তু সেই সকল ত্রুটি সত্ত্বেও বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস পাঠকৃচিত্তকে যেভাবে মথিত ও অভিভূত করে, তার রহস্যরূপ সুবোধচন্দ্রের এই গ্রন্থে পাই মা। বঙ্কিমচন্দ্রের বিরাট প্রতিভার মূল্যায়নে সুবোধচন্দ্রের মতো মননশীল মানুষ সার্থক হননি, একথা বিস্ময়কর হলেও সত্য।
উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বঙ্কিমচন্দ্রকে সাহিত্য- সম্রাট বলা হয়ে থাকে। তিনি বাংলা সাহিত্যের প্রথম সমালোচক ও সাহিত্যতাত্ত্বিক। তার পূর্বে কিছু সাহিত্য সমালোচনা হলেও মূলত তার মাঝেই যথার্থ সমালোচনার চিন্তাচেতনা, তাত্ত্বিকতা প্রভৃতি দেখা যায়। তার লেখার প্রধান অভিপ্রায় হলো শিল্পসৃষ্টি এবং মানবকল্যাণ। তিনি সাহিত্যিকে জীবনের সাথে যুক্ত করতে চেয়েছেন। তার সমগ্র সাহিত্যিবিষয়ক প্রবন্ধে ও সমালোচনা কর্মে এ বিষয়টি বা সাহিত্য ভাবনাটি বিশেষভাবে লক্ষণীয়।