সাহিত্যতাত্ত্বিক ও সমালোচক হিসেবে প্রমথ চৌধুরীর মূল্যায়ন কর
সাহিত্য সমালোচক এবং মৌলিক সাহিত্যিকের সগৌরব পরিচয়ে পরিচিত প্রমথ চৌধুরী। তিনি ভাষাবিদ: ভাষা আন্দোলনের নায়ক, বিশিষ্ট গদ্যরীতির প্রবর্তক, তীক্ষ্ণ চিন্তায় পূর্ণ ধারালো প্রবন্ধ লেখক, সফল সনেট রচয়িতা, বুদ্ধিজীবিত চরিত্রযুক্ত গল্পকার। প্রমথ চৌধুরীর রচনার প্রধান গুণ পরিণত বৈদগ্ধ্য। তার প্রথম রচনা জয়দেব সম্পর্কিত প্রবন্ধেও কোনো অপরিণতির লক্ষণ নেই। তার সমালোচনার অন্যতম লক্ষণ বিভিন্ন মনোভাব ও বিচার পদ্ধতির সমাবেশ।
প্রমথ চৌধুরী বাংলা সাহিত্যে ক্লাসিকাল সমালোচনারীতির শ্রেষ্ঠ প্রবক্তা। তার আদর্শ ফরাসি সাহিত্য। কারণ ফরাসি সাহিত্য শুধু ক্লাসিকাল নয়, রিয়ালিস্টিকও এবং সে কারণেই প্রমথ চৌধুরী ফরাসি সাহিত্যের প্রতি অনুরক্ত। তার কথায়, “ফরাসি সমালোচকদের তুল্য সমালোচক পৃথিবীর অপর কোনো দেশে জন্মগ্রহণ করেনি এবং ফরাসি পর্যালোচনার বিষয় কেবলমাত্র সাহিত্য নয়, সমগ্র জীবন।” তাছাড়া প্রমথ চৌধুরীর সব আলোচকই তার ওপর ভারতচন্দ্রের রেখাপাত বড় করে উল্লেখ করেছেন। প্রমথনাথ বিশী বলেন, "চৌধুরী মহাশয়ের ওপরে সবচেয়ে বেশি প্রভাব বোধকরি রায়গুণাকর ভারতচন্দ্রের। ভারতচন্দ্রের কাব্য তাঁহার বুদ্ধিবৃত্ত স্বভাবকে দিগদর্শন করাইয়াছিল; কারণ প্রাচীন বাংলা কবিদের মধ্যে ভারতচন্দ্র নিজেও বুদ্ধিবৃত্ত লেখক ছিলেন।” প্রমথ চৌধুরীর লেখা 'ভারতচন্দ্র' প্রবন্ধটি নানা বিদুপ ও অপপ্রচারের হাত থেকে ভারতচন্দ্রকে উদ্ধারের প্রশংসনীয় প্রয়াস।
আধুনিক সমালোচকের মতে, প্রমথ চৌধুরী কর্তৃক 'ভারতচন্দ্র' প্রবন্ধ প্রকাশের পিছনে ঐতিহাসিক কারণ বর্তমান; এ প্রবন্ধে ভারতচন্দ্র যে গুরুত্বের সঙ্গে উল্লিখিত, তাতে প্রমথ চৌধুরীর মনোভূমিতে তার স্থান বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না। ভারতচন্দ্রের রচনাগত অশ্লীলতা প্রসঙ্গে প্রমথ চৌধুরীর বক্তব্য বিস্ফোরক: ভারতচন্দ্রের অশ্লীলতার মধ্যে আর্ট থাকলেও অন্যদের আছে শুধু নেচার, যথা রামপ্রসাদ। কিন্তু ঐ অশ্লীলতাকে ঢেকে আছে হাস্যরস, তাকেই উচ্চমূল্য দিয়ে প্রমথ চৌধুরী ভারতচন্দ্রের পক্ষ নিয়ে বলেছেন, "হাস্যরস যে অনেক ক্ষেত্রে শ্লীলতার সীমালঙ্ঘন করে, তার পরিচয় আরিস্টফেনিস থেকে আরম্ভ করে আনাতোলা ফ্রান্স পর্যন্ত সকল হাস্যরসিকের লেখায় পাবেন।" তিনি আরও বলেছেন, "ভারতচন্দ্রের সাহিত্যের প্রধান রস কিন্তু আদিরস নয়, কারণ এ রসের জন্মস্থান হৃদয় নয় মস্তিষ্ক, জীবন নয় মন।" ভারতচন্দ্রের হাসিকে তিনি 'বীরের হাসি' বলেছেন এবং প্রকন্দ শেষে তিনি লিখেছেন, "এ হাসি হচ্ছে সামাজিক জড়তার প্রতি প্রাণের বক্রোক্তি, সামাজিক মিথ্যার প্রতি সত্যের বক্রোক্তি।" এক্ষেত্রে সামাজিক মিথ্যার প্রতি সত্যের বক্রোক্তির একটিই কারণ বর্তমান এবং তা সমাজশোধন। এ বিষয় প্রমথ চৌধুরী নিশ্চুপ এবং এখানেই তার স্ববিরোধিতা।
প্রমথ চৌধুরী তার মতকে দার্শনিক ভিত্তির ওপরে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। বিজ্ঞান প্রত্যক্ষ জ্ঞানের ওপর নির্ভরশীল, কিন্তু তার অতিরিক্তও। সাহিত্যে প্রত্যক্ষ জ্ঞানই একমাত্র জ্ঞান; প্রত্যক্ষ সত্য ছাড়া সাহিত্যে অন্য কোনো সত্য নেই। প্রত্যক্ষ জ্ঞানের সাহায্যেই সৃষ্টির রহস্যের মধ্যে প্রবেশ করা যায়, বৈজ্ঞানিক যুক্তিতে নয়। 'সৃষ্টির এই যে রহস্য যা কাব্যের বিষয়, তা অনুভূতিসাপেক্ষ নয়।' এ সুপরিচিত দৃষ্টান্তের সাহায্যে প্রমথ চৌধুরী প্রত্যক্ষ জ্ঞান, অনুভূতি ও সৃষ্টি রহস্যে অনুপ্রবেশের সংযোগ দেখাতে চেষ্টা করেছেন। 'ঈশা বাস্যমিদং সর্ব্বং যৎকিঞ্চ জগত্যাং জগৎ' -একথা তারই কাছে সত্য, যার কাছে এটি প্রত্যক্ষ সত্য। কেননা কোনোরূপ আঁকের সাহায্যে কিংবা মাপের সাহায্যেও সত্য পাওয়া যায় না। একত্বের জ্ঞান অনুভূতিসাপেক্ষ। এ যুক্তি গ্রাহ্য হতে পারে না, কারণ মিস্টিক অনুভূতি ও প্রত্যক্ষ অনুভূতি বা জ্ঞান এক জিনিস নয়। কিন্তু এ বিষয় প্রমথ চৌধুরীর মনের তথা সমালোচনার পরিচয় বহন করে।
অনুভূতি ও প্রত্যক্ষ জ্ঞানের ওপর জোর দিলেও প্রমথ চৌধুরী বৃদ্ধির প্রাধান্য অস্বীকার করেননি। বুদ্ধি বলতে তিনি ব্যবহারিক বুদ্ধি, বৈজ্ঞানিক বুদ্ধি ও দার্শনিক বুদ্ধি সবটাই বুঝেছেন। প্রথম কথা, ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষ ও বুদ্ধিলব্ধ জ্ঞান পরস্পর সম্পর্কিত; ইন্দ্রিয় ও বুদ্ধি একে অপরের মধ্যে অনুপ্রবিষ্ট, সেজন্য বুদ্ধির আলোকে আমাদের রসবোধও স্বচ্ছতা ও উজ্জ্বলতা লাভ করে। ফরাসি দার্শনিক দেকার্তকে অনুসরণ করে তিনিও বলেছেন, "যে জ্ঞান আমাদের জাগ্রত বুদ্ধির আয়ত্ত এবং যা ন্যায়শাস্ত্রের বিরুদ্ধ নয়, তাই হচ্ছে যথার্থ সত্য।” অন্যত্র তিনি দাবি করেছেন, সাহিত্য মানুষের সমগ্র মনের প্রকাশ; এর মধ্যে মানুষের দর্শন বিজ্ঞান, ধর্মনীতি, আশা- আকাঙ্ক্ষা সবকিছুই প্রকাশ পায়; 'জ্ঞানের ভাষা, কর্মের ভাষা ও ভক্তির ভাষা, এই ত্রিধারার ত্রিবেনীসংগম হয়।' তিনি জার্মান সাহিত্য ও দর্শনের প্রতি তেমন অনুরাগ বোধ করেননি, কারণ এর ভাব ও ভাষা ঘোলাটে রকমের। ফরাসি দর্শন ও সাহিত্যের প্রতি তার ভক্তির কারণ ফরাসি সাহিত্য ও দর্শন বৃদ্ধিতে উজ্জ্বল। তাছাড়া ফরাসি সাহিত্য মগ্নচৈতন্যে বিশ্বাস করে না, যা ইন্দ্রিয়ের অগোচর আর যা বুদ্ধির অগম্য তার বড় একটা সন্ধান করে না। এ প্রকার মনোভাবের জন্যই প্রমথ চৌধুরী কাব্যের গঠন পারিপাট্য, ভাষার কৌশলের প্রতি বেশি মনোযোগ দিয়েছেন। এটিই ভারতচন্দ্রের প্রতি তাকে আকৃষ্ট করেছে; তিনি ভারতচন্দ্রের মতো কৃষ্ণগাগরিক, ভাষার কারুশিল্পী।
প্রমথ চৌধুরী শুধু কৃষ্ণনাগরিক নন, রাবীন্দ্রিকও। তিনি রবীন্দ্রনাথের খুব কাছের লোক, রবীন্দ্রনাথের কাব্যের অনুরাগী পাঠক এবং রবীন্দ্রনাথের দ্বারা প্রভাবিত। তার মতে, রবীন্দ্রনাথের কাব্যের ঐশ্বর্য কলানৈপুণ্যের ফল নয়, তার অলংকার সমৃদ্ধি অপৃথক যত্নের দ্বারা নির্বর্তিত, অনায়াসলব্ধ। রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যবিষয়ক প্রবন্ধেও রসের উৎসের সন্ধান করেছেন, রূপের অন্তরালে অরূপকে পেতে চেয়েছেন। কিন্তু কাব্যের মধ্যে যে Mystery, Magic বা Mysticism আছে প্রমথ চৌধুরীর তার প্রতি একটা স্বাভাবিক বিরোধিতা ছিল। প্রমথ চৌধুরীর দুটি বিখ্যাত প্রবন্ধ 'বস্তুতন্ত্রতা বস্তুকি' এবং 'চিত্রাঙ্গদা' রবীন্দ্র বিরোধিতার জবাব।
অর্থনীতিবিদ রাধাকমল মুখোপাধ্যায়ের 'সাহিত্য বাস্তবতা' রচনাকে সরাসরি আঘাতের প্রয়াস প্রমথ চৌধুরীর 'বস্তুতন্ত্রতা বস্তু কি' প্রবন্ধে চোখে পড়ে। সেখানে সন্ধানী দৃষ্টিতে তিনি রাধাকমল উল্লিখিত 'বস্তুতন্ত্রতা' শব্দটির উৎস চিহ্নিত করে বলেছেন, "রাধাকমলবাবুর বস্তুতন্ত্রতা ইউরোপের গত শতাব্দীর মেটিরিয়ালিজমের অস্পষ্ট প্রতিধ্বনি বই আর কিছু নয়।" এবং "রাধাকমলবাবু প্রমুখ লেখকদের বস্তুতান্ত্রিকতা ইউরোপের রিয়ালিজম ব্যতীত আর কিছুই নয়।" অর্থাৎ ইউরোপীয় রিয়ালিজম এবং মেটিরিয়ালিজমের চিন্তাগত সমন্বয় ঘটেছে রাধাকমলের 'বস্তুতান্ত্রিকতা' সম্পর্কিত আলোচনায়। রাধাকমলের আরও একটি বক্তব্য 'যুগধর্মের প্রকাশ করাই সাহিত্যের ধর্ম' প্রমথ চৌধুরী মানতে নারাজ। তার মতে, 'যুগধর্ম' নামে বিশেষ কোনো ধর্ম হয় না। একই যুগে নানা বিরোধী ধর্মের পরিচয় লভ্য। মনের একাংশ কালবিশেষের অধীন হলেও অন্য অংশ মুক্ত, স্বাধীন। তার সিদ্ধান্ত, জীবনের প্রকাশ সাহিত্যে, তাই "রিয়ালিজমের পুতুলনাচ এবং আইডিয়ালিজ ছায়াবাজি উভয়ই কাব্যে অগ্রাহ্য।"
কবিতার বিচিত্র সংজ্ঞাও প্রমথ চৌধুরীর কলমে আমরা পেয়েছি: "এ যুগের কবিতা হচ্ছে হৃদয়ের স্বগতোক্তি, সুতরাং সে উক্তি একটি দীর্ঘশ্বাসের চাইতে দীর্ঘ হতে পারে না।” কবিতার পরে এসেছে ছোটগল্প। 'টীকা ও টিপ্পনি' প্রবন্ধে ছোটগল্পের পরিচয় সূত্রে সমালোচক প্রমথ চৌধুরী বলেছেন, "আমার মতে ছোটগল্প প্রথমে গল্প হওয়া চাই, তারপরে ছোট হওয়া চাই।” তথ্য ও যুক্তির সমন্বয়ে ঋদ্ধ প্রমথ চৌধুরীর এ আলোচনাটি। প্রমথ চৌধুরী খোলা চোখে দেখেছেন সংস্কৃত ও ইংরেজির অনাবশ্যক প্রভাবে বাংলা কীভাবে রুদ্ধগতি। 'বীরবলের হালখাতা' গ্রন্থের 'কথার কথা' রচনায় সেকথা জানিয়ে বলেছেন, "ইংরেজি সাহিত্যের ভাব, সংস্কৃত ভাষার শব্দ ও বাঙ্গালা ভাষার ব্যাকরণ এই তিন চিজ মিলিয়ে যে খিচুড়ি তয়ের করি, তাকেই আমরা বাঙ্গালা সাহিত্য বলে থাকি। ... বিদেশের ভাব ও পুরাকালের ভাষা, এই দুয়ের আওতার ভিতর পড়ে বাঙ্গালা সাহিত্য ফুটে উঠতে পারে না।” তবে বাংলা ভাষাকে একঘরে করে রাখারও পরিপন্থি তিনি। কারণ "বিদেশি ভাষা ও সাহিত্যের চর্চা ছেড়ে দিলে মানুষকে মনোরাজ্যে ... কুনো হয়ে পড়তে হয়।"
রবীন্দ্রনুরাগী অথচ প্রখর ব্যক্তিত্বশালী প্রমথ চৌধুরী সাহিত্যবিচারে বিশ্লেষণপন্থি ও তীক্ষ্ণ বুদ্ধিজীবী হলেও রসই তার অন্বেষ্টব্য রবীন্দ্রনাথ যাকে 'অপ্রয়োজনের আনন্দ' বলেছেন, বীরবল তাকেই 'সাহিত্যে খেলা' নাম দিয়েছেন। তার তীক্ষ্ণ ও তির্যক সমালোচনা মননশীলতার চূড়ান্ত রূপ বলে বাংলা সমালোচনা সাহিত্যে চিরদিন নন্দিত হবে। ভারতচন্দ্র, রামমোহন, বাংলা সাহিত্য, ফরাসি সাহিত্য, য়ুরোপীয় সাহিত্যে রেনেসাঁসের প্রভাব সর্বোপরি বাংলা সাহিত্যের ভাষা সমস্যা সম্বন্ধে তিনি যে মন্তব্য করেছেন ও নতুন পথের সন্ধান দিয়েছেন, তাতে তাকে একটি ব্যক্তিবিশেষ বলে ধরে একটি ইনস্টিটিউশনরূপে গণ্য করা উচিত। সব মিলিয়ে বাংলা সমালোচনা সাহিত্যে তিনি নিঃসন্দেহে বিরল ব্যক্তিত্ব।