দর্শনের সাথে বিজ্ঞান ও নীতিশাস্ত্রের সম্পর্ক আলোচনা কর। অথবা, দর্শনের সাথে বিজ্ঞান ও নীতিশাস্ত্রের সম্পর্ক বর্ণনা কর।
জগৎ ও জীবনের স্বরূপ ও মূল্যাবধারণ করাই দর্শনের কাজ। জগৎ ও জীবনের জটিল বিষয় নিয়ে দর্শন আলোচনা করে থাকে। মানুষের দুটি বৃত্তির মধ্যে একটি হলো জীববৃত্তি অন্যটি বুদ্ধিবৃত্তি। বুদ্ধিবৃত্তির কারণেই মানুষ সৃষ্টির সেরা জীবের মর্যাদা লাভ করেছে। আর এ বুদ্ধিবৃত্তির মাধ্যমে জগৎ ও জীবনের মৌলিক সমস্যাবলি সমাধানের যে প্রচেষ্টা তাকে দর্শন বলে। আর প্রকৃতির তথা জ্ঞানের একটি নির্দিষ্ট শাখা সম্পর্কে সুশৃঙ্খল জ্ঞানই হলো বিজ্ঞান। দর্শন ও বিজ্ঞান বিভিন্ন বিষয়ের দিক থেকে সম্পর্কিত এবং উভয়ের সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ।
শাব্দিক অর্থে দর্শন: দর্শনের ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো 'Philosophy'
যা গ্রিক শব্দ 'Philos' এবং 'Sophia' থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে। 'Philos' শব্দের অর্থ অনুরাগ এবং 'Sophia' শব্দের অর্থ জ্ঞান। সুতরাং 'Philosophy' শব্দটির অর্থ হলো জ্ঞানের প্রতি অনুরাগ। এ জ্ঞান বলতে সামগ্রিকভাবে জগৎ এবং মানুষের জীবনকেন্দ্রিক জ্ঞানকে বুঝায়।
দর্শন : দর্শন বলতে এমন একটি বিদ্যাকে বুঝায় যা সামগ্রিকভাবে জগৎ ও জীবনের স্বরূপ ব্যাখ্যা ও তার মূল্য নির্ধারণ করে। জ্ঞান ও সত্যের অনুসন্ধানে যুক্তি চিন্তনের মাধ্যমে দর্শন জগৎ ও জীবন সম্পর্কিত সমস্যাবলির যুক্তিসম্মত সমাধানের প্রচেষ্টা চালায়। মূলত দর্শন জগৎ ও জীবন সম্পর্কে মানুষের ধারণা ও বিশ্বাসগুলোর যৌক্তিকতা বিচার করে বিশ্বজগৎ সম্পর্কে যুক্তিযুক্ত ও সুসংবদ্ধ ধারণা প্রদান করে। ভাবাবেগের পরিবর্তে সুষ্ঠু চিন্তা ও বিচারবিশ্লেষণের মাধ্যমে কোনো মৌলিক সমস্যার ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রচেষ্টাই দর্শন।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা:
গ্রিক দার্শনিক প্লেটো (Plato) এর মতে, "চিরন্তন এবং বস্তুর মূল স্বরূপের জ্ঞানলাভ করাই দর্শনের লক্ষ্য।"
গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটল (Aristotle) এর মতে, "যে বিজ্ঞান তার আদি সত্তার স্বরূপ এবং এ স্বরূপের অঙ্গীভূত বৈশিষ্ট্যসমূহ অনুসন্ধান করে তাই হলো দর্শন।"
প্রখ্যাত দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট (Immanuel Kant) তার 'Critique of Pure Reason' গ্রন্থে বলেন, "Philosophy is the science and criticism of knowledge".
দার্শনিক মতে, "দর্শন হলো পরম ভাবের বিজ্ঞান।"
দার্শনিক প্যাট্রিকের মতে, "Philosophy has been defined as the attempt by use of scientific methods to understand the world in which we live." [Introduction to Philosophy, P-10]
বার্ট্রান্ড রাসেল (Bertrand Russell) তার 'History of Western Philosophy' গ্রন্থে বলেন, "দর্শন ধর্মতত্ত্ব ও বিজ্ঞানের মধ্যবর্তী প্রদেশ।”
বিজ্ঞান (Science): বিজ্ঞান হলো প্রকৃতির কোনো একটি শাখা সম্পর্কে সুশৃঙ্খল, সুসংবদ্ধ ও পদ্ধতিগত আলোচনা। যা বস্তু সম্পর্কে একটা পদ্ধতিগত ও সুষ্ঠু জ্ঞান আমাদের মধ্যে জাগ্রত করে তাই বিজ্ঞান। বিজ্ঞান সম্পর্কে থমাস হাক্সলি বলেন, "বিজ্ঞান হলো পরীক্ষিত, সুশৃঙ্খল ও লৌকিক জ্ঞান বা সহজবুদ্ধির সমষ্টি।” অর্থাৎ, বিজ্ঞান হলো কোনো বিষয় বা বস্তু সর্ম্পকে স্পষ্ট ও সুশৃঙ্খল জ্ঞান।
•
দর্শনের সাথে বিজ্ঞানের সম্পর্ক: জ্ঞানের দুটি প্রধান শাখা হিসেবে বিজ্ঞান ও দর্শনের মধ্যে তিন ধরনের সম্পর্ক লক্ষ করা যায়। যথা: ১. সাদৃশ্যের, ২. বৈসাদৃশ্যের ও ৩. নির্ভরশীলতার। দর্শনের সাথে বিজ্ঞানের সম্পর্ক আলোচনা করতে হলে এ বিষয়গুলো আলোচনা করা প্রয়োজন।
দর্শন ও বিজ্ঞানের মধ্যকার সাদৃশ্য: দর্শন ও বিজ্ঞানের মধ্যকার সাদৃশ্য নিম্নে দেওয়া হলো:
ক. দর্শন ও বিজ্ঞান উভয়ের জনক থেলিস: দর্শন ও বিজ্ঞান উভয়ের জনক খিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের মাইসেলীয় গ্রিক দার্শনিক থেলিস।
খ. উৎপত্তিগত সাদৃশ্য: দর্শন ও বিজ্ঞান উভয়েরই উৎপত্তি ঘটেছে
জ্ঞানের প্রতি অনুরাগ থেকে। দর্শনের উৎপত্তিগত অর্থ হলো জ্ঞানের
প্রতি অনুরাগ, আর বিজ্ঞানের উৎপত্তিগত অর্থ জ্ঞান বা জ্ঞানবিদ্যা।
গ. লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যগত সাদৃশ্য: দর্শন ও বিজ্ঞান উভয়েরই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো সত্যের অনুসন্ধানের মাধ্যমে মানবতার কল্যাণসাধান।
ঘ. সমালোচনার দিক থেকে: দর্শন ও বিজ্ঞান উভয়েই সমালোচনা সাদরে গ্রহণ করেছে। বিজ্ঞানের যেমন- টলেমির ভূকেন্দ্রিক মতের সমালোচনা করে কোপারনিকাসের সূর্যকেন্দ্রিক মতবাদের উৎপত্তি লক্ষ করা যায়। দর্শনেরও তেমনি, বুদ্ধিবাদ, অভিজ্ঞতাবাদের মতো পরস্পর বিরোধী মতবাদের অনেকে সমালোচনা করে।
দর্শন ও বিজ্ঞানের মধ্যকার বৈসাদৃশ্য: দর্শন ও বিজ্ঞান উভয়েই মানব কল্যাণের প্রচেষ্টা করলেও এদের মধ্যে কতিপয় বিষয়ে বৈসাদৃশ্য লক্ষ করা যায়। এখানে প্রধান কয়েকটি বৈসাদৃশ্য নিম্নে তুলে ধরা হলো:
ক. দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে বৈসাদৃশ্য: দর্শনের দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাপক ও বিস্তৃত। এ সম্পর্কে কেয়ার্ড বলেন, "There is no province of human experience, there is nothing in the whole releam of reality which lies beyond the domain of philosophy or philosophical investigation does not extend." অর্থাৎ, মানব অভিজ্ঞতার এমন কোনো রাজ্য নেই যা দর্শনের আওতাভুক্ত নয় বা যেখানে দার্শনিক আলোচনা হয়নি।
পক্ষান্তরে, বিজ্ঞান প্রকৃতির কোনো নির্দিষ্ট শাখা সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট জ্ঞানলাভের চেষ্টা করে। যেমন- পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন বিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান ইত্যাদি।
খ. বস্তুর পরিমাণগত দিক বনাম গুণ ও পরিমাণগত দিক : বিজ্ঞান
কেবলমাত্র বস্তুর পরিমাণগত দিক নিয়ে আলোচনা করে। এ আলোচনা বর্ণনামূলক। অন্যদিকে, দর্শন বস্তুর গুণগত ও পরিমাণগত উভয় দিক নিয়ে মূল্যায়নমূলক আলোচনা করে।
গ. গ্রহণযোগ্যতার দিক থেকে: দর্শনের চেয়ে বিজ্ঞানের পরিসর
ক্ষুদ্র হলেও বিজ্ঞানের জ্ঞান দর্শন জ্ঞানের চেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য। অপরপক্ষে, দর্শনের পরিসর বিজ্ঞানের পরিসরের চেয়ে ব্যাপক হলেও বিজ্ঞানের তুলনায় কম গ্রহণযোগ্য।
ঘ. পদ্ধতিগত দিক থেকে: দর্শন সত্য অর্জনের জন্য বিচারমূলক ও
অনুধ্যানী পদ্ধতির ওপর নির্ভরশীল। আর বিজ্ঞান সত্য অর্জনের জন্য পরীক্ষণ, পর্যবেক্ষণ, বিশ্লেষণ ও সার্বিকীকরণ পদ্ধতির ওপর নির্ভর করে।
দর্শন ও বিজ্ঞানের মধ্যকার নির্ভরশীলতার সম্পর্ক: দর্শন ও
বিজ্ঞানের মধ্যে কতিপয় বিষয়ে পার্থক্য থাকলেও এ দুটি জ্ঞানের শাখা একে অপরের ওপর নির্ভরশীলতার সম্পর্কে আবদ্ধ। দর্শন জগৎ জীবনের যে সামগ্রিক ব্যাখ্যা দেয় তার জন্য বিজ্ঞানের সরবরাহকৃত মালমসলার প্রয়োজন। আবার বিভিন্ন আবিষ্কারকে মূল্যায়ন করা দর্শনের কাজ।
উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনায় পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, দর্শন ও
বিজ্ঞানের মধ্যে কতিপয় সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য থাকলেও এদের মধ্যে মূলত কোনো মৌলিক পার্থক্য নেই; বরং এরা নিজের অর্থপূর্ণতার জন্য একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। এজন্য ওয়েবার বলেন, "দর্শন ছাড়া বিজ্ঞান ঐক্যহীন সমষ্টিমাত্র, আত্মাহীন দেহ; বিজ্ঞান ছাড়া দর্শন হলো দেহহীন আত্মা।” অর্থাৎ, দর্শন ও বিজ্ঞান একে অপরের প্রতিযোগী নয় বরং পরিপূরক। সুতরাং বলা যায় যে, দর্শন ও বিজ্ঞানের সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। একটি ছাড়া অপরটির অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না।