দর্শনের সংজ্ঞার্থ দাও। দর্শনের বিষয়বস্তু আলোচনা কর। অথবা, দর্শন কী? দর্শনের বিষয়বস্তু আলোচনা কর। দর্শন কীভাবে বিজ্ঞানের সঙ্গে সম্পর্কিত?
জগৎ ও জীবন সম্পর্কে মানুষের মনে যেসব মৌলিক প্রশ্নের উদয় হয় তার সদুত্তর দেওয়ার চেষ্টা করে দর্শন। দর্শন বুদ্ধি, যুক্তি, চিন্তা ও বিচারবিশ্লেষণের মাধ্যমে পরমসত্তা, জগৎ ও জীবনের সাথে জড়িত সমস্যাবলির সূক্ষ্ম ও যুক্তিসম্মত ব্যাখ্যা প্রদান করে। দর্শন শুধু মৌলিক সমস্যার সমাধানই করে না; বরং বিচারবিশ্লেষণের মাধ্যমে জগৎ ও জীবনের সুষ্ঠু ব্যাখ্যা প্রদান ও মূল্যায়নের চেষ্টা করে। অন্যদিকে, দর্শনের পরিধি বলতে দর্শন যেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করে সেগুলো সবই দর্শনের আলোচনার পরিধি বা বিষয়বস্তু। মানুষের অভিজ্ঞতার সব দিক এবং বিশ্বসত্তার সব অংশ দর্শনের বিষয়বস্তুর অন্তর্ভুক্ত। দর্শন বহুমুখী জ্ঞানের অপূর্ব সমন্বয়। দর্শনের স্বরূপ বা প্রকৃতি জানতে হলে তার আলোচ্য বিষয়ের মাধ্যমে জানতে হবে।
শাব্দিক অর্থে দর্শন: দর্শনের ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো
'Philosophy' যা গ্রিক শব্দ 'Philos' এবং 'Sophia' থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে। 'Philos' শব্দের অর্থ অনুরাগ এবং 'Sophia' শব্দের অর্থ জ্ঞান। সুতরাং 'Philosophy' শব্দটির অর্থ হলো জ্ঞানের প্রতি অনুরাগ। এ জ্ঞান বলতে সামগ্রিকভাবে জগৎ এবং মানুষের জীবনকেন্দ্রিক জ্ঞানকে বুঝায়।
দর্শন : দর্শন বলতে এমন একটি বিদ্যাকে বুঝায় যা সামগ্রিকভাবে জগৎ ও জীবনের স্বরূপ ব্যাখ্যা ও তার মূল্য নির্ধারণ করে। জ্ঞান ও সত্যের অনুসন্ধানে যুক্তিচিন্তনের মাধ্যমে দর্শন জগৎ ও জীবন সম্পর্কিত সমস্যাবলির যুক্তিসম্মত সমাধানের প্রচেষ্টা চালায়। মূলত দর্শন জগৎ ও জীবন সম্পর্কে মানুষের ধারণা ও বিশ্বাসগুলোর যৌক্তিকতা বিচার করে বিশ্বজগৎ সম্পর্কে যুক্তিযুক্ত ও সুসংবদ্ধ ধারণা প্রদান করে। ভাবাবেগের পরিবর্তে সুষ্ঠু চিন্তা ও বিচারবিশ্লেষণের মাধ্যমে কোনো মৌলিক সমস্যার ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রচেষ্টাই দর্শন।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা:
গ্রিক দার্শনিক প্লেটোর মতে, "চিরন্তন এবং বস্তুর মূল স্বরূপের জ্ঞানলাভ করাই দর্শনের লক্ষ্য।"
গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটল এর মতে, “যে বিজ্ঞান তার আদি সত্তার স্বরূপ এবং এ স্বরূপের অঙ্গীভূত বৈশিষ্ট্যসমূহ অনুসন্ধান করে তাই হলো দর্শন।"
প্রখ্যাত দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট তার 'Critique of Pure Reason' গ্রন্থে বলেন, "Philosophy is the science and criticism of knowledge."
দার্শনিক হেগেলের মতে, "দর্শন হলো পরম ভাবের বিজ্ঞান।"
বার্ট্রান্ড রাসেল তার 'History of Western Philosophy' গ্রন্থে বলেন, "দর্শন ধর্মতত্ত্ব ও বিজ্ঞানের মধ্যবর্তী প্রদেশ।”
দর্শনের বিষয়বস্তু: নিম্নে দর্শনের বিষয়বস্তু আলোচনা করা হলো:
১. জ্ঞানবিদ্যা: দর্শনের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা হলো জ্ঞানবিদ্যা। দর্শনের যে শাখায় জ্ঞানের উৎপত্তি, সীমা, যথার্থতা ও সম্ভাবনা সম্পর্কে আলোচনা করা হয় তাকে বলা হয় জ্ঞানবিদ্যা। দর্শন জীবজগৎ ও ঈশ্বরের স্বরূপ সম্পর্কে আলোচনা করে। কিন্তু তার পূর্বে দার্শনিককে এরূপ জ্ঞানলাভের সম্ভাব্যতা সম্পর্কে বিচার করে দেখতে হয়। জ্ঞানের উৎস কী, জ্ঞানলাভের উপায় কী, কতটুকু জ্ঞানলাভ সম্ভব, জ্ঞানের উৎপত্তি কীভাবে হয়, যথার্থ জ্ঞানের শর্ত কী কী, জ্ঞানের সীমা কতদূর, জ্ঞানের সত্য ও মিথ্যা কীভাবে নিরূপণ করা যায়- জ্ঞানসম্পর্কিত এরূপ প্রশ্নগুলো দর্শনের পরিধিভুক্ত। সুতরাং বলা যায়, জ্ঞানবিদ্যা দর্শনের মূল বিষয়বস্তু।
২. রূপবিদ্যা বা বিশ্বতত্ত্ব : পরিদৃশ্যমান জগতের রূপ নিয়ে যে
শাখায় আলোচনা করা হয় তাকে রূপবিদ্যা বলে। দর্শনের এ শাখায় বিশ্বজগতের পরিদৃশ্যমান দিকের অনুসন্ধান করা হয়। জড়, প্রাণ, মন প্রভৃতি সম্পর্কে জানতে হলে এগুলোর পরিদৃশ্যমান সম্পর্কে জ্ঞান থাকা অত্যাবশ্যক। বস্তু মানুষের সামনে যেভাবে উপস্থিত হয় তা হলো বস্তুর বাহারূপ। বস্তুর বাহারূপ কিংবা পরিদৃশ্যমান নিয়ে যে শাখা আলোচনা করে তাকে রূপবিদ্যা বা বিশ্বতত্ত্ব হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। দর্শনের এ শাখা রূপবিজ্ঞান নামে আখ্যায়িত হয়ে থাকে। দেশ, কাল, জড়, প্রাণ, বিশ্বজগতের উৎপত্তি, ক্রমবিকাশ, অর্থাৎ সৃষ্টি, বিবর্তন ইত্যাদি সম্পর্কিত আলোচনা দর্শনের পরিধিভুক্ত।
৪. আদর্শবিদ্যা বা মূল্যবিদ্যা: দর্শনের একটি প্রধান শাখা হলো
আদর্শবিদ্যা। দর্শনের যে শাখায় কোনো বিষয়ের মূল্য নির্ধারণ করে তাকে আদর্শবিদ্যা বলে। আদর্শবিদ্যা মূল্যসম্পর্কীয় বাক্যের স্বরূপ এবং সত্য, সুন্দর ও কল্যাণের পরম আদর্শগুলোর স্বরূপ ব্যাখ্যা করে। জগৎ ও জীবের মূল্যাবধারণ করতে গিয়ে দর্শনে আদর্শ বা মূল্য কী, মূল্যের স্বরূপ কী, মূল্য ব্যক্তিগত না বস্তুগত, মূল্যসত্তার সম্পর্ক কী, মূল্যের শ্রেণিবিভাগ ও তাৎপর্য কী, মূল্যগুলো কী কল্পনাপ্রসূত না বাস্তব, ঈশ্বরের সাথে মূল্যের সম্পর্ক কী, সত্য সুন্দর ও কল্যাণ আদর্শ কি স্বতন্ত্র না ঈশ্বরের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়, জগতের সাথে ঈশ্বরের সম্পর্ক কী ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা করা হয়।
৫. মনোদর্শন: মন বা আত্মার স্বরূপ, দেহ ও মনের সম্পর্ক, ইচ্ছার স্বাধীনতা, আত্মার অমরত্ব ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করে মনোদর্শন। মনোদর্শন সাম্প্রতিককালে দর্শনের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখায় পরিণত হয়েছে। ইচ্ছার স্বাধীনতা, আত্মার অমরত্ব প্রভৃতি বিষয়ের আলোচনা ছাড়া দর্শনের আলোচনা পূর্ণাঙ্গ হতে পারে না। মনোদর্শন এমন কতিপয় বিষয় নিয়ে আলোচনা করে যেগুলো মনোবিজ্ঞানের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ।
৬. নীতিদর্শন: দর্শনের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা হলো নীতিদর্শন।
দর্শনের এ শাখায় ব্যক্তির কল্যাণের প্রকৃতি নিয়ে আলোচনা করা হয়। ন্যায়নীতির আসলে কি বস্তুগত কোনো তাৎপর্য আছে কি না, নীতিবোধের উৎস কী, নৈতিকতার প্রয়োজনীয়তা কী, প্রতিবেশীর সাথে মানুষ ভালো না মন্দ আচরণ করবে, ভালো কী প্রভৃতি প্রশ্ন নিয়ে নীতিদর্শন ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে।
দর্শনের সাথে বিজ্ঞানের সম্পর্ক: জ্ঞানের দুটি প্রধান শাখা
হিসেবে, বিজ্ঞান ও দর্শনের মধ্যে তিন ধরনের সম্পর্ক লক্ষ করা যায়। যথা: ১. সাদৃশ্যের, ২. বৈসাদৃশ্যের ও ৩. নির্ভরশীলতার। দর্শনের সাথে বিজ্ঞানের সম্পর্ক আলোচনা করতে হলে এ বিষয়গুলো আলোচনা করা প্রয়োজন।
দর্শন ও বিজ্ঞানের মধ্যকার সাদৃশ্য: নিম্নে দর্শন ও বিজ্ঞানের মধ্যকার সাদৃশ্য দেওয়া হলো:
ক. দর্শন ও বিজ্ঞান উভয়ের জনক থেলিস: দর্শন ও বিজ্ঞান উভয়ের জনক খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের মাইসেলীয় গ্রিক দার্শনিক থেলিস।
খ. উৎপত্তিগত সাদৃশ্য: দর্শন ও বিজ্ঞান উভয়েরই উৎপত্তি ঘটেছে জ্ঞানের প্রতি অনুরাগ থেকে। দর্শনের উৎপত্তিগত অর্থ হলো জ্ঞানের প্রতি অনুরাগ, আর বিজ্ঞানের উৎপত্তিগত অর্থ জ্ঞান বা জ্ঞানবিদ্যা।
গ. লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যগত : দর্শন ও বিজ্ঞান উভয়েরই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো সত্যের অনুসন্ধানের মাধ্যমে মানবতার কল্যাণসাধান।
দর্শন ও বিজ্ঞান উভয়েই
মানবকল্যাণের প্রচেষ্টা করলেও এদের মধ্যে কতিপয় বিষয়ে বৈসাদৃশ্য লক্ষ করা যায়। এখানে প্রধান কয়েকটি বৈসাদৃশ্য নিম্নে তুলে ধরা হলো:
ক. দৃষ্টিভঙ্গি: দর্শনের দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাপক ও বিস্তৃত। এ সম্পর্কে
কেয়ার্ড বলেন, "There is no province of human experience, there is nothing in the whole reealm of reality which lies beyond the domain of philosophy or philosophical investigation does not extend." অর্থাৎ, মানব অভিজ্ঞতার এমন কোনো রাজ্য নেই যা দর্শনের আওতাভুক্ত নয় বা যেখানে দার্শনিক আলোচনা হয়নি।
পক্ষান্তরে, বিজ্ঞান প্রকৃতির কোনো নির্দিষ্ট শাখা সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট জ্ঞানলাভের চেষ্টা করে। যেমন- পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন বিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান ইত্যাদি।
খ. বস্তুর পরিমাণগত দিক বনাম গুণ ও পরিমাণগত দিক: বিজ্ঞান কেবল বস্তুর পরিমাণগত দিক নিয়ে আলোচনা করে। এ আলোচনা বর্ণনামূলক। অন্যদিকে, দর্শন বস্তুর গুণগত ও পরিমাণগত উভয় দিক নিয়ে মূল্যায়নমূলক আলোচনা করে
গ. গ্রহণযোগ্যতা: দর্শনের চেয়ে বিজ্ঞানের পরিসর ক্ষুদ্র হলেও বিজ্ঞানের জ্ঞান দর্শন জ্ঞানের চেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য। অপরপক্ষে, দর্শনের পরিসর বিজ্ঞানের পরিসরের চেয়ে ব্যাপক হলেও বিজ্ঞানের তুলনায় কম গ্রহণযোগ্য।
ঘ. পদ্ধতিগত : দর্শন সত্য অর্জনের জন্য বিচারমূলক ও অনুধ্যানী পদ্ধতির ওপর নির্ভরশীল। আর বিজ্ঞান সত্য অর্জনের জন্য পরীক্ষণ, পর্যবেক্ষণ, বিশ্লেষণ ও সার্বিকীকরণ পদ্ধতির ওপর নির্ভর করে।
দর্শন ও বিজ্ঞানের মধ্যকার নির্ভরশীলতার সম্পর্ক: দর্শন ও
বিজ্ঞানের মধ্যে কতিপয় বিষয়ে পার্থক্য থাকলেও এ দুটি জ্ঞানের শাখা একে অপরের ওপর নির্ভরশীলতার সম্পর্কে আবদ্ধ। দর্শন জগৎ জীবনের যে সামগ্রিক ব্যাখ্যা দেয় তার জন্য বিজ্ঞানের সরবরাহকৃত মালমসলার প্রয়োজন। আবার বিভিন্ন আবিষ্কারকে মূল্যায়ন করা দর্শনের কাজ।
উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে,
জগৎ ও জীবন সম্পর্কে মানুষের মনে যেসব মৌলিক প্রশ্নের উদয় হয় তার সদুত্তর দেওয়ার চেষ্টা করে দর্শন। দর্শন বুদ্ধি, যুক্তি, চিন্তা ও বিচারবিশ্লেষণের মাধ্যমে পরমসত্তা, জগৎ ও জীবনের সাথে জড়িত সমস্যাবলির সূক্ষ্ম ও যুক্তিসংগত ব্যাখ্যা প্রদান করে। দর্শনের পরিধি ব্যাপক ও বিস্তৃত। জগৎ ও জীবনের প্রায় সব বিষয় নিয়ে আলোচনা করে থাকে দর্শন। দর্শন এক বহুমুখী জ্ঞানের সমন্বয়। দর্শন মানবজীবনের সব বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করে বিধায় এর বিষয়বস্তু অন্যান্য বিষয় থেকে ব্যাপক।