জ্ঞানববিদ্যা কী? জ্ঞানের উৎপত্তি বিষয়ক মতবাদ হিসেবে অভিজ্ঞতাবাদ আলোচনা কর। অথবা, জ্ঞানের উৎপত্তিবিষয়ক মতবাদ হিসেবে অভিজ্ঞতাবাদ আলোচনা কর।
জ্ঞানের উৎপত্তিবিষয়ক উল্লেখযোগ্য যে কয়টি মতবাদ রয়েছে সেগুলোর মধ্যে অভিজ্ঞতাবাদ অন্যতম। যে মতবাদ অভিজ্ঞতাকেই জ্ঞানার্জনের একমাত্র গ্রহণীয় মাধ্যম বলে মনে করে তাই অভিজ্ঞতাবাদ। বুদ্ধিবাদী দর্শনের এক প্রত্যক্ষ প্রতিবাদরূপে অভিজ্ঞতাবাদের উদ্ভব। অভিজ্ঞতাবাদ ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষণের পথ ধরে আরোহমূলক পদ্ধতিতে জ্ঞানের উৎস অনুসন্ধানে ধাপে ধাপে অগ্রসর হয়।
► জ্ঞানবিদ্যা: দর্শনের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখার নাম হলো
জ্ঞানবিদ্যা। বর্তমান সময়ে জ্ঞানবিদ্যা দর্শনে একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। দর্শনের যে শাখা জ্ঞানের উৎপত্তি, স্বরূপ, শর্ত, বৈধতা, সম্ভাবনা, সীমা প্রভৃতি নিয়ে আলোচনা করে তাকে জ্ঞানবিদ্যা বলে। জ্ঞান কি আদৌ সম্ভব, পরমসত্তার জ্ঞান কি সম্ভব, জ্ঞানের শর্ত কী, জ্ঞানের স্বরূপ কী, কীভাবে জ্ঞানের উৎপত্তি হয় এবং জ্ঞানের সীমা কতদূর, জ্ঞান সম্পর্কিত এ প্রশ্নগুলো আলোচনা করে জ্ঞানবিদ্যা। এ আলোচনা দর্শনশাস্ত্রেও প্রয়োজন। অর্থাৎ দর্শন যে জ্ঞানলাভ করতে চায় তা যথার্থ হবে কি না তাই জ্ঞানবিদ্যা নির্ধারণ করে। সতেরো শতকের শেষভাগে দর্শন আলোচনার জন্য ইউরোপীয় দার্শনিকগণ জ্ঞানবিদ্যার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। কারণ দার্শনিকগণ মনে করেন, জ্ঞানের বিশ্লেষণের ওপর ভিত্তি করে দার্শনিক সিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠিত হওয়া উচিত। কিন্তু আধুনিক যুগের মারভিন, হল্ট, মন্টেগু, পেরি প্রমুখ বাস্তববাদী দার্শনিকরা জ্ঞানবিদ্যার প্রতি গুরুত্ব প্রদান করেন না। কোনো কোনো দার্শনিক দর্শনের সমস্যাবলি আলোচনার ক্ষেত্রে জ্ঞানবিদ্যার প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেন। তারা জ্ঞানবিদ্যা ও দর্শনকে অভিন্ন বলে মনে করেন। আবার কোনো কোনো দার্শনিক জ্ঞানবিদ্যার প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেন না। তাই দার্শনিক আলোচনার ক্ষেত্রে জ্ঞানবিদ্যা অপ্রয়োজনীয় একথা বলা যায় না।
► জ্ঞানের উৎপত্তি বিষয়ক মতবাদ হিসেবে অভিজ্ঞতাবাদ:
"Empiricism is that epistemological position according to which the ultimate source of our ideas is experience." [Dr. Abdul Matin: An Outline of Philosophy. P-81] ফ্রান্সিস বেকন, লক, বার্কলি ও হিউম জ্ঞানের বিচারবিশ্লেষণের পর এ সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, সংবেদন এবং অনুভূতি থেকে জ্ঞানের উৎপত্তি হয়। সংবেদনের মাধ্যমে আমরা বহির্জগতের বস্তু সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করি। অন্তর্দর্শনে আমরা নিজেদের মানসিক অবস্থার পরিচয় পাই। সংবেদনে আমরা যে বস্তুবিকাশের জ্ঞান পাই তার থেকে আরোহ পদ্ধতির সাহায্যে সর্বজনীনকরণের দ্বারা সাধারণ সত্য ও সাধারণ ধারণার জ্ঞানলাভ করি। তাদের মতে, অমূর্ত সাধারণ সত্যও অভিজ্ঞতার মাধ্যমে লাভ করা যায়। সুতরাং জ্ঞান সম্পূর্ণভাবে অভিজ্ঞতার মাধ্যমেই অর্জন করা যায়। প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক ডেমোক্রিটাস, প্রোটাগোরাস, জর্জিয়াস এবং আধুনিক দার্শনিক ফ্রান্সিস বেকন, জন লক, বার্কলি, হিউম, মিল, বেইন, স্পেন্সার প্রমুখ অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিক। আধুনিক পাশ্চাত্য দর্শনে বেকন, লক, বার্কলি এবং হিউমকে অভিজ্ঞতাবাদের প্রধান ধারকরূপে উল্লেখ করা যায়। নিম্নে তাদের মতবাদ ব্যাখ্যা করা হলো:
ফ্রান্সিস বেকন: ফ্রান্সিস বেকনের মতে, অভিজ্ঞতার মাধ্যমেই অর্থাৎ প্রত্যক্ষণের ওপর নির্ভর করেই আমরা জ্ঞানের উপকরণ সংগ্রহ করি। তিনি তার 'Novum Organum' গ্রন্থে বলেন, মানুষ যদি সত্যিকারের জ্ঞানকে পেতে চায় তাহলে প্রথমে তাকে দুটি বিষয়ের ওপর লক্ষ রাখতে হবে। প্রথমটি হলো মানুষকে তার মন থেকে সবরকমের বিচারহীন কল্পনা দূর করে পরিষ্কার ও মুক্ত মন নিয়ে চিন্তা করতে হবে। দ্বিতীয়টি হলো প্রকৃতিকে জিজ্ঞাসাবাদ করে প্রকৃতির মধ্য থেকে এক গূঢ় সত্য বের করার চেষ্টা করতে হবে। যাহোক, সত্যিকারের জ্ঞানকে পাওয়ার জন্য বেকন উপর্যুক্ত দুটি বিষয়কে অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভর করার কথা বলেন। তিনি বলেন, নির্ভুল প্রত্যক্ষণ বা পর্যবেক্ষণই হলো জ্ঞানের প্রতিপাদ্য বিষয়।
জন লক: জন লকের অভিজ্ঞতাবাদের উদ্ভব ঘটেছে ডেকার্টের
বুদ্ধিবাদ তথা সহজাত ধারণার সরাসরি প্রতিক্রিয়া হিসেবে। লক ডেকার্টের সহজাত ধারণার অসারতা প্রমাণের মধ্য দিয়ে তার অভিজ্ঞতাবাদ প্রচার করেন। তার মতে, “অভিজ্ঞতাই হলো সকল ধারণা এবং জ্ঞানের একমাত্র উৎস।" তিনি অভিজ্ঞতাবাদকে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে বলেন, জন্মের সময় মানুষের মন একটা সাদা কাগজের মতো থাকে। অভিজ্ঞতাবাদের মাধ্যমেই বাইরের বস্তুর ছাপ মনে এসে পতিত হয়। লকের মতে, আমাদের সব ধারণার উৎপত্তি হয় অভিজ্ঞতা থেকে। এ অভিজ্ঞতা আসে দুটি পথের মাধ্যমে। এর একটি হলো সংবেদন এবং অপরটি হলো অন্তর্দর্শন। সংবেদনের মাধ্যমে আমরা কেবল বস্তুর বাইরের অংশ বা বাইরের গুণ সম্পর্কে ধারণা লাভ করে থাকি। অন্যদিকে, অন্তর্দর্শনের মাধ্যমে আমরা আমাদের মানসিক ক্রিয়াকলাপ যেমন- চিন্তন, প্রত্যক্ষণ, বিশ্বাস ইত্যাদির ধারণা পেয়ে থাকি।
জন লকের মতে, ধারণা দুপ্রকার। যথা: সরল ধারণা ও জটিল ধারণা। বিভিন্ন বাস্তব বস্তু বা ঘটনার ধারণা হলো সরল ধারণা। অন্যদিকে, প্রত্যাংশ, দ্রব্য এবং সম্বন্ধ প্রভৃতির ধারণা হলো জটিল ধারণা। লক বস্তুর যে গুণ রয়েছে তার আধার হিসেবে দ্রব্যের অস্তিত্ব স্বীকার করেন। লক অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিক হয়েও ঈশ্বর, আত্মা প্রভৃতির ধারণা স্বীকার করেন।
জর্জ বার্কলি: একজন অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিক হিসেবে বার্কলি মনে করেন, জ্ঞানের একমাত্র উৎস সংবেদন এবং ধারণা। বার্কলি 'ধারণা' সম্পর্কে বলেন, জগতের বিভিন্ন বস্তু ধারণারই সমষ্টি, ধারণাই আসল। ধারণার বাইরে কোনোকিছুরই অস্তিত্ব নেই। অভিজ্ঞতাবাদের ভিত্তি সুদৃঢ় করতে গিয়ে বার্কলি বলেন, যা কিছু অস্তিত্বশীল, তা প্রত্যক্ষনির্ভর। অর্থাৎ পৃথিবীতে কেবল সেই বস্তুটিরই অস্তিত্ব রয়েছে, যাকে প্রত্যক্ষ করা হয়েছে। যা প্রত্যক্ষ করা যায় না তা অস্তিত্বশীল নয়। বস্তুর যাবতীয় গুণকে বার্কলি গৌণ গুণ হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেন, বস্তুর এ গৌণ গুণ ব্যক্তির মনের ওপর নির্ভরশীল। তিনি বস্তুর গুণের প্রকারভেদ অস্বীকার করেন। তার মতে, বস্তুর সকল প্রকার গুণই গৌণ গুণ। জড় প্রত্যক্ষ করা যায় না বলে বার্কলি জড়ের অস্তিত্বকে অস্বীকার করেছেন। বার্কলি একজন অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিক হয়েও ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রত্যক্ষ করা যায় না বলে তিনি 'ঈশ্বর অস্তিত্বশীল' বলে মত প্রকাশ করেছেন।
ডেভিড হিউম: অভিজ্ঞতাবাদের একজন একনিষ্ঠ প্রচারক ডেভিড
হিউম। তার মতে, যা কিছু আমরা জানি, তার সবই আমরা আমাদের অভিজ্ঞতা বা প্রত্যক্ষণের মাধ্যমে জানি। জ্ঞানের সব উপাদানই অভিজ্ঞতা বা প্রত্যক্ষণ থেকে আসে। হিউমের মতে, প্রত্যক্ষণ দুই রকমের। যথা: ১. ইন্দ্রিয়জ এবং ২. ধারণা। ইন্দ্রিয়জ হলো জীবন্ত, প্রাণবন্ত ও স্পষ্ট প্রত্যক্ষণ। অন্যদিকে, ধারণা হলো ইন্দ্রিয়জের একটু অস্পষ্ট ও ক্ষীণ রূপ। হিউমের মতে, ইন্দ্রিয়জ হলো সংবেদনের মাধ্যমে বাইরের বস্তুর যে ছাপ আমাদের মনে আসে এ ইন্দ্রিয়জ পরবর্তীকালে মনে ধারণা হিসেবে টিকে থাকে। হিউমের মতে, জ্ঞানের উপকরণ জোগান দেয় ইন্দ্রিয় ছাপ ও ধারণা। প্রাথমিক পর্যায়ে ইন্দ্রিয়জ ও ধারণা সরল ও বিচ্ছিন্ন অবস্থায় থাকে। জ্ঞান হয় এদের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে। অনুষঙ্গের তিনটি নিয়মের সাহায্যে সম্পর্কগুলো গঠিত হয় যেমন- সাদৃশ্য নিয়ম, পারম্পর্য নিয়ম এবং কার্যকারণ নিয়ম। হিউম বলেন, ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা ছাড়া জ্ঞান সম্ভব নয়। সুতরাং মন, দ্রব্য, ঈশ্বর, আত্মা সম্পর্কে যেহেতু আমাদের কোনো ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা হয় না, সেহেতু তাদের অস্তিত্বকে আমরা স্বীকার করতে পারি না। হিউম দেখান যে, সকল জ্ঞানই সম্ভাব্য। সার্বিক এবং নিশ্চিত জ্ঞান অসম্ভব।
সমালোচনা: জ্ঞানের উৎপত্তিবিষয়ক মতবাদ হিসেবে অভিজ্ঞতাবাদ সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। অভিজ্ঞতাবাদের বিরুদ্ধে যেসব সমালোচনা রয়েছে সেগুলো নিম্নরূপ:
১. হিউমের মতে, কোনো জ্ঞানই নিশ্চিত নয়, সম্ভাবনামূলক। তিনি বলেন, সকল জ্ঞান যদি অনিশ্চিত, সম্ভাবনাময় এবং সন্দেহাত্মক হয় তবে তা সংশয়বাদ ও সন্দেহাত্মক অর্থাৎ সন্দেহের উর্ধ্বে নয়।
২. বেকনের মতে, অভিজ্ঞতার সাহায্যেই আমরা জ্ঞানের উপকরণ সংগ্রহ করি। অভিজ্ঞতা জ্ঞানের একটি উৎস, অভিজ্ঞতাবাদ জ্ঞানের একটিমাত্র উৎসকে স্বীকার করায় এটি একটি একপেশে মতবাদে পরিণত হয়েছে।
৩. লক বস্তু ও ধারণা মধ্যে পার্থক্য দেখিয়ে বলেছেন, আমরা সরাসরি ধারণাই জানি। ধারণা যে বস্তু তাকে আমরা পরে জানি। যদি তাই হয় তবে ধারণাই সরাসরি সত্য। ধারণার অস্তিত্বই আমরা পাই। বস্তুর অস্তিত্ব নয়।
৪. লক ধারণার ও জ্ঞানের মধ্যে পার্থক্য করেছেন। কিন্তু কোনো বস্তু সম্পর্কে ধারণা থাকার অর্থই তার সম্পর্কে জ্ঞান থাকা। কোনো বস্তু সম্পর্কে আমাদের ধারণা আছে, অথচ তার সম্পর্কে জ্ঞান নেই এটি অবাস্তব।
উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, অভিজ্ঞতাবাদীরা অভিজ্ঞতাকেই জ্ঞানলাভের একমাত্র উৎস হিসেবে অভিহিত করেছেন। আসলে শুধু অভিজ্ঞতা দ্বারা জ্ঞানলাভ হয় না। জ্ঞানলাভের জন্য অভিজ্ঞতার পাশাপাশি বুদ্ধিরও ভূমিকা রয়েছে। আর এজন্য জ্ঞানের উৎপত্তিসংক্রান্ত মতবাদ হিসেবে অভিজ্ঞতাবাদ ব্যাপক সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। কিন্তু তাই বলে অভিজ্ঞাবাদের আদৌ কোনো গুরুত্ব নেই এমনটি বলা যাবে না।