জৈবিক সংহতি কী? এমিল ডুর্খেইমের সমাজ পরিবর্তনের ব্যাখ্যায় জৈবিক সংহতির ভূমিকা আলোচনা কর
ফরাসি সমাজবিজ্ঞানী এমিল ডুর্খেইমের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব হলো 'শ্রমবিভাজন তত্ত্ব'। শ্রমবিভাজন তত্ত্ব মূলত সামাজিক সংহতিসংক্রান্ত ডুর্খেইমের প্রথম রচনা। সামাজিক সংহতিকে সমাজের জন্য এক অপরিহার্য শর্ত হিসেবে ধরে তিনি যান্ত্রিক ও জৈবিক সংহতির মাধ্যমে সামাজিক পরিবর্তনের ধারা উন্মোচনের প্রয়াস পেয়েছেন। সমাজস্থ মানুষের পক্ষে জীবনধারণের কাজসমূহ যে একা করা সম্ভব নয় তা তিনি তার তত্ত্বে তুলে ধরেছেন।
জৈবিক সংহতি : জৈবিক সংহতি হচ্ছে বৈসাদৃশ্যের ঐকমত্য অর্থাৎ এখানে সামাজিক ব্যক্তিবর্গের মধ্যে চিন্তাচেতনা, আচার আচরণ, মূল্যবোধের মধ্যে খুব একটা সাদৃশ্য নেই। তারা একে অন্যের থেকে স্বতন্ত্র এমন ঐকমত্য সেখানে বিদ্যমান। এ সংহতিকে জৈবিক বলার কারণ এর কাজ। এ সংহতির মূল সমাজে ব্যক্তির বৈসাদৃশ্যের মধ্যে নিহিত। এটা সমাজের সদস্যদের মধ্যে স্বাধীনতার সৃষ্টি করে। সমাজে শ্রমবিভাজন বৃদ্ধির সাথে সাথে এ ধরনের সংহতির উদ্ভব ঘটে। এটা আধুনিক বিজ্ঞান ও শিল্প সমাজের বৈশিষ্ট্য। এ সমাজে ব্যক্তির মধ্যে বিভক্তি থাকে। প্রত্যেকের স্বাধীন বিশ্বাস ও আকাঙ্ক্ষা থাকে এবং অনেক পরিস্থিতির মধ্য থেকে তার পছন্দ অনুযায়ী কাজ করে থাকে। এ সংহতিতে আইনের ধরন ছিল Restitutive. ডুর্খেইম মন্তব্য করেন যে, আধুনিক সমাজে মানবজীবন পেশাগত ভূমিকাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। ফলত ব্যক্তি নিজ নিজ কর্মে বা ভূমিকা পালনে অধিক পারদর্শিতা অর্জন করে। সে এককভাবে নিজের সব প্রয়োজনীয় সামগ্রী প্রস্তুত করতে পারে না। কাজেই তাকে অন্যের ওপর নির্ভর এবং অন্যের সাথে সহযোগিতা করতে হয়। এরূপ পারস্পরিক নির্ভরশীলতা জৈবিক সংহতির জন্ম দেয়।
এমিল ডুর্খেইমের সমাজ পরিবর্তনের ব্যাখ্যায় জৈবিক সংহতির
ভূমিকা: জৈবিক সংহতি এমিল ডুর্খেইমের অন্যতম প্রত্যয়। জৈবিক সংহতি একটি সমাজসংশ্লিষ্ট বিষয়। এমিল ডুর্খেইম সামাজিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে জৈবিক সংহতির কতিপয় দিক সম্পর্কে আলোকপাত করেন। নিম্নে এ সম্পর্কে বর্ণনা করা হলো:
১. জনসংখ্যা বৃদ্ধি: জনসংখ্যা বা জনসমষ্টি হচ্ছে সামাজিক
পরিবর্তনের মুখ্য নিয়ামক। সমাজে সামাজিক সংহতির যে চর্চা তা মূলত মানুষের মাধ্যমেই হয়ে থাকে। স্বভাবতই জনসংখ্যা বৃদ্ধি সামাজিক সংহতিকে গতিশীল করে। আর জৈবিক সংহতি সমাজে পরিবর্তনের সূত্রপাত ঘটায়। সামাজিক বিবর্তনের কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে ডুর্খেইম বলেন, জনসংখ্যার বৃদ্ধি সমাজে শ্রমের বিশেষীকরণের মাধ্যমে সামাজিক সংগঠনে পরিবর্তন আনে। তাই তিনি জনসংখ্যার বৃদ্ধিকে সামাজিক বিবর্তন এবং শ্রমবিভাজনের মুখ্য কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন।
২. নগরের প্রসার: নগর হচ্ছে সভ্যতা বিকাশের কেন্দ্র। নগরের প্রসার সময়ের আবর্তনে গুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। এর সাথে সাথে সামাজিক সংহতির ক্ষেত্রও বিস্তৃত হয়েছে। নগরের বিকাশের ফলে মানুষের সামগ্রিক গতিশীলতা বৃদ্ধি পায়। যা সমাজ পরিবর্তনে বিশেষ ভূমিকা রাখে। তিনি বলেন, নগর প্রসারের সাথে সাথে ব্যাপক হারে সমাজে শ্রমবিভাজন বেড়ে যায়। নগর জীবনে বিভিন্ন প্রকার শিল্পপ্রতিষ্ঠান, কলকারখানা গড়ে ওঠার ফলে বিভিন্ন পেশার মানুষ সেখানে কর্মসংস্থান খুঁজে পায়। তখন ব্যক্তির জ্ঞান, কর্মদক্ষতা ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সমাজে বিশেষীকরণ ঘটে যা জৈবিক সংহতির জন্ম দেয়।
৩. যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি: যোগাযোগ ব্যবস্থা সামাজিক
গতিশীলতার অন্যতম নির্ধারক। এর ফলে পারস্পরিক সংহতি ও সামাজিক কল্যাণ বৃদ্ধি পায়। আদিম সমাজে মানুষ নির্দিষ্ট সীমায় আবদ্ধ ছিল। কিন্তু আধুনিক সমাজে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির ফলে মানুষ বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত করে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে সক্ষম হচ্ছে। যেখানে যে কাজে পারিশ্রমিক বেশি সেখানে জনসমাগম বাড়ছে। এভাবে তাদের শ্রমের বা কর্মের বিশেষীকরণ ঘটেছে। ফলশ্রুতিতে সমাজে জৈবিক সংহতি বৃদ্ধি পাচ্ছে।
৪. আন্তঃসম্পর্ক: পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া বা আন্তঃসম্পর্ক সামাজিক সম্পর্কের মূল ভিত্তি। পারস্পরিক সম্পর্ক সামাজিক সংহতির পরিবর্তন সূচিত করে। ব্যক্তির সাথে ব্যক্তির নির্ভরশীলতা, সহযোগিতা, প্রতিযোগিতা, দ্বন্দ্ব-এগুলো সমাজে আন্তঃসম্পর্ক গড়ে তোলে। দ্বন্দ্ব, সহযোগিতা প্রভৃতির জন্য ব্যক্তির আন্তঃসম্পর্ক প্রয়োজন। আধুনিক সমাজে পেশার বিশেষীকরণের ফলে এগুলো লক্ষ করা যায়। ফলশ্রুতিতে সমাজে জৈবিক সংহতি গড়ে ওঠে।
উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে,
সমাজ কাঠামোর পরিবর্তনের সাথে সাথে সামাজিক সংহতির পরিবর্তন ঘটে। আদিম সমাজের চেয়ে আধুনিক পুঁজিবাদী সমাজে শ্রমবিভাজনের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর জ্ঞান, দক্ষতা, বুদ্ধির ভিত্তিতে সমাজে এ শ্রমবিভাজন ঘটে থাকে। ডুর্খেইমের শ্রমবিভাজন তত্ত্বের মাধ্যমে, শ্রমবিভাজনের প্রকার ও শ্রমবিভাজনের কারণ সম্পর্কে জ্ঞানার্জন সম্ভব যা সমাজবিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যয় হিসেবে পরিচিত।