কাব্যতত্ত্ব অবলম্বনে ট্র্যাজেডি সম্পর্কে এরিস্টটলের দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাখ্যা কর

কাব্যতত্ত্ব অবলম্বনে ট্র্যাজেডি সম্পর্কে এরিস্টটলের দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাখ্যা কর
দৈব বা অদৃষ্টের অনিবার্যতায় পীড়িত, গভীর অন্তর্দ্বন্দ্ব ও বহির্দ্বন্দ্বে পরাভূত অথচ নায়কোচিত আত্মা-প্রতিষ্ঠার ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যে মহিমাময় মানবজীবনের করুণরসাত্মক কাহিনিই সাধারণভাবে ট্র্যাজেডিরূপে পরিচিত। দেবতা কিংবা পুরাণকথিত বীরদের কীর্তিকলাপ, দুঃখ-যন্ত্রণা, সংঘাত-বিনাশকে উপজীব্য করে প্রাচীন গ্রিস-এ উদ্ভব ও প্রতিষ্ঠা ঘটেছিল এই বিষাদাত্মক নাট্যরূপের। এথেনীয় রঙ্গমঞ্চে গ্রিক ট্র্যাজেডির স্বর্ণযুগ অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ার অনেক পরে, সাধারণভাবে কাব্যকলা ও বিশেষভাবে এই করুণরসাত্মক নাট্যরূপের এক সতর্ক, নীরক্ত অথচ রসজ্ঞ বিশ্লেষণ পাওয়া গেল আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৩৩০ অব্দে রচিত এরিস্টটলের 'দি পোয়েটিক্স' গ্রন্থে। এক সংযত ও প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ সংজ্ঞায় তিনি ট্র্যাজেডির স্বরূপ ও লক্ষণসমূহ চিহ্নিত করলেন ঐ গ্রন্থের ষষ্ঠ অনুচ্ছেদে :
Tragedy is an imitation of an action that is serious, complete and of a certain magnitude, in language embellished with each kind of artistic ornament, the several kinds being found in separate parts of the play: in the form of action, not of narrative; though pity and fear effecting the proper purgation of these emotions. 
অ্যারিস্টলের এই সুপরিচিত ও কালাতিক্রমী সংজ্ঞাটিকে ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করেই আমরা ট্র্যাজেডির স্বরূপ, বৈশিষ্ট্য তথা উপাদানসমূহের রেখাচিত্রটি চিত্রিত করতে পারি: 

১. ট্র্যাজেডি বা করুণরসাত্মক নাটক মানুষের 'কর্মবৃত্তি' (Action)-র অনুকরণ তথা নির্মাণ যাকে এরিস্টটল বলেছিলেন mimesis। এই প্রসঙ্গে তিনি অনুকরণ শব্দটি পিথাগোরাস ও প্লেটোর কাছ থেকে এক স্বতন্ত্র ও নতুন অর্থে ব্যবহার করেছিলেন। প্লেটোর কাছে ধ্রুব সত্য ছিল ইন্দ্রিয়াতীত, শাশ্বত আদিরূপ (Archetype) সমূহের জগৎ, যা পরিবর্তনশীল বস্তুনিচয়ের ঊর্ধ্বে চির অচঞ্চল। তার মতে, কাব্য ও ললিতকলা অসত্য ও অলীক কারণ তা অনিত্য বাহ্য বস্তুসমূহের অনুকরণ। প্লেটো 'অনুকরণ' শব্দটিকে প্রতিচ্ছায়া (Copy) ও অনূকৃতি (Mimicry) অর্থে প্রয়োগ করেছিলেন এবং উপাদান ও প্রকরণের প্রভেদের কারণে শিল্পকর্মে 'অনুকরণ' যে এক নব সৃষ্টিতে পরিণত হয় তাও তার বিচারদৃষ্টি এড়িয়ে গিয়েছিল। প্লেটো তাই তার আদর্শরাষ্ট্র বা Republic থেকে নির্বাসিত করেছিলেন কবিকে। প্লেটোর স্বনামখ্যাত শিষ্য, প্রয়োগবাদী এরিস্টটল তার 'দিল পোয়েটিক্স' এ কাব্যকলাকে পুনর্বাসিত করলেন বস্তুসমূহকে বাস্তব ও সত্য বলে গ্রহণ করলেন এরিস্টটল; সত্য-অসত্যের সম্বন্ধ নির্ণায়করূপে নয়, প্রকৃতি ও শিল্পকর্মের প্রভেদকরূপে তিনি প্রয়োগ করলেন অনুকরণ শব্দটিকে, যা সৌন্দর্য ও আনন্দের এক আদর্শ জগতের অভিমুখে নির্দেশিত সৃজন প্রক্রিয়ারূপে প্রতিষ্ঠিত হলো।

২. ট্র্যাজেডির সংজ্ঞায় এরিস্টটল 'কর্মবৃত্তি'-র অনুকরণের কথা বলেছেন; ব্যক্তিজীবনের অনুকরণ নয়। আখ্যানবস্তু (Mythos) ও নাট্যক্রিয়া (Praxis) এর মধ্যে প্রভেদ করেননি তিনি। নাট্যক্রিয়াই রূপায়িত আখ্যানবস্তু এবং তা রূপায়িত নাট্যচরিত্রের সঙ্গে সম্পর্কবদ্ধ। দি পোয়েটিক্স এর ত্রয়োদশ অনুচ্ছেদেও অ্যারিস্টট্ল জীবন ও 'কর্মবৃত্তি'র অনুকরণরূপে ট্র্যাজেডিকে চিহ্নিত করেছেন।

৩. ট্র্যাজেডি যে কর্মবৃত্তিকে অনুকরণ করে তাকে এরিস্টটল বলেছেন গুরুগম্ভীর বা Serious; আর এখানেই কমেডি বা হাস্যরসাত্মক নাটকের সঙ্গে করুণরসাত্মক নাটকের পার্থক্য। হামফ্রি হাউস 'Serious' শব্দটিকে ব্যাখ্যা করেছেন 'Weighty' বা 'Important' অর্থে। যেকোনো অর্থই আমরা করি না কেন, হাস্য-পরিহাস চপলতাকে এরিস্টটল ট্র্যাজেডির পক্ষে উপযুক্ত বলে মনে করেননি। শেক্সপিয়র-সহ এলিজাবেথী'য় যুগের নাট্যকারদের ট্র্যাজেডি নাটকে হাস্যরস বা Comic Relief এর যেসব উদাহরণ বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ও আকর্ষণীয় তেমন মিশ্রণ ধ্রুপদি নাটকে চোখে পড়ে না।

৪. ট্র্যাজেডির Action কে হতে হবে স্বয়ংসম্পূর্ণ। আদি-মধ্য- অন্ত্য- এই তিনটি পর্বে বিন্যস্ত হবে একটি সমগ্র ও নিটোল কাঠামো। এরিস্টটল একটি সুপরিকল্পিত ও পূর্ণাঙ্গ নাট্যগঠনের অপরিহার্যতা উল্লেখ করেছিলেন, অবশ্যম্ভাবিতা (Necessity) ও সম্ভাব্যতা (Probability)-র সূত্রে, যা এক চূড়ান্ত ও অনিবার্য পরিণতিতে পৌঁছায়। আর এইভাবেই কাব্যনির্মাণক্রিয়াপ পরিস্ফুট করে সামান্য সত্যকে।

৫. নাটকে রূপায়িত ক্রিয়া বা কর্মবৃত্তির থাকবে একটি মাত্রা বা Magnitude। এর থাকবে একটি মাপ বা দৈর্ঘ্য যাতে করে নাট্যক্রিয়া সংহত ও যুক্তিপূর্ণ বিন্যাসের মধ্য দিয়ে সম্ভাব্য ও অবশ্যম্ভাবী উপসংহার (Catastrophe) এ উপনীত হতে পারে।

৬. ট্র্যাজেডির আলোচ্য সংজ্ঞায় এরিস্টটল অলংকরণের উপাদানরূপে বহুবিধ Embellishments এর উল্লেখ করেছেন। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছন্দ (Verse) ও সুর বা গীত (Song); কথোপকথন অংশে ছন্দ আর কোরাসের গানগুলোতে সুর সংযোজন করে থাকে আলংকারিক সৌন্দর্যের সুষমা।

৭. ট্র্যাজেডির অনুকরণরীতি বর্ণনাত্মক নয়, ঘটনার গতি ও পরিণতি তথা চরিত্র ও ঘটনার কার্যকারণ সম্পর্কবদ্ধতায় নাটকোচিত প্রক্রিয়ায় তাকে উপস্থাপিত করতে হয়। অনুকরণরীতির এই পার্থক্যে মহাকাব্য বা এপিকের সঙ্গে ট্র্যাজেডির প্রভেদ।

৮. আলোচ্য সংজ্ঞায় শেষাংশে এরিস্টটল ট্র্যাজেডির চূড়ান্ত উদ্দেশ্য বা কারণটি বিবৃত করেছেন। 'করুণা' (Pity) ও 'শঙ্কা' (Fear) উদ্রেক এবং উদ্রিক্ত অনুভব বা প্রক্ষোভের মোক্ষণের দ্বারা চিত্তশোধন তথা মানসিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা ট্র্যাজেডির উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য। এই প্রসঙ্গে ব্যবহৃত Catharsis শব্দটি ভাবমোক্ষণ (Purgation of Emotions), শুদ্ধিকরণ (Purification) ইত্যাদি বিভিন্ন অর্থে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। মূল্যত প্রয়োগবাদী ও জীববিজ্ঞানী এরিস্টটল চিকিৎসাশাস্ত্রের পরিধি থেকে আহৃত এই পরিভাষায় করুণা, শঙ্কা ও অনুরূপ অনুভবসমূহের উদ্দীপনা ও নিষ্কাশন দ্বারা চিত্তশোধনকেই বুঝিয়েছিলেন বলে মনে করা হয়। অবশ্য সমালোচক মহলে 'Catharsis' এর ব্যাখ্যা ও তাৎপর্য নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক ও মতান্তর আছে।

ট্র্যাজেডির সংজ্ঞা নির্ণয় করার পর পূর্বোক্ত গ্রন্থর ঐ একই অনুচ্ছেদে এরিস্টটল ট্র্যাজেডির উপকরণসমূহের একটি তালিকা উপস্থিত করেছিলেন যে উপকরণগুলো সবই তার প্রদত্ত সংজ্ঞারই স্বাভাবিক ফলশ্রুতি। করুণরসাত্মক নাটকের সমগ্র অবয়ব নির্মিত হয় যে ছয়টি প্রত্যঙ্গের সার্থক সন্নিবেশে সেগুলো তালিকাবদ্ধ করেছিলেন এরিস্টটল এইভাবে- 'আখ্যান বস্তু' (Fable বা Plot), 'চরিত্র' (Character), 'চিন্তন' (Thought), 'মঞ্চসজ্জা' (Spectacle), 'ভাষা' (Diction) ও 'সুর' (Melody বা Song)। এদের মধ্যে 'আখ্যানবস্তু', 'চরিত্র' ও 'চিন্তন' উপকরণভুক্ত; 'মঞ্চসজ্জা' অনুকরণরীতি সংশ্লিষ্ট, 'ভাষা' ও 'সুর' উপাদান তথা মাধ্যমের অন্তর্ভুক্ত।

মোটের ওপর, ট্র্যাজেডি করুণরসাত্মক ও বিয়োগান্তক নাটক, দুর্জেয় দৈবশক্তির নিষ্ঠুর লীলায় অথবা অন্তর ও বাইরের যুগপৎ দ্বন্দ্বে অধঃপতিত মানবাত্মকার বেদনা যে নাটকে মূর্ত হয়ে ওঠে। অবশ্য ট্র্যাজেডি যে শেষ হবে মৃত্যু ও বিনাশে এমন পরামর্শ বা নির্দেশ এরিস্টটল দেননি। এমনকি ট্র্যাজেডি যে মিলনান্তক হওয়া অসম্ভব নয় এমন ইঙ্গিতই করেছিলেন তিনি। কিন্তু আধুনিক সমালোচকবৃন্দ সাধারণভাবে বিয়োগান্তক পরিণতির পক্ষেই রায় দিয়েছেন। পরিণতি বিয়োগান্তক হোক বা নাই হোক ট্র্যাজেডির সারাৎসার যন্ত্রণা বা Suffering, যাকে এরিস্টটল সংজ্ঞায়িত করেছিলেন 'an action of a destructive or painful nature' রূপে। ট্র্যাজেডির প্লট সেই যন্ত্রণার ইতিবৃত্তটিকে ফুটিয়ে তোলে রঙ্গমঞ্চে দৃশ্যপারম্পর্যে; দর্শকহৃদয়ে উদ্রেক করে ভয় ও সহানুভূতি; ভাবমোক্ষণের মধ্য দিয়ে দর্শকমন অর্জন করে সুস্থিতি, অভিভূত হয় করুণরসের আনন্দে।


আরো যেভাবে প্রশ্ন হতে পারে 

  • এরিস্টটরের কাব্যতত্ত্ব অনুসারে ট্র্যাজেডির স্বরূপ বিচার কর।
  • এরিস্টটলের 'পোয়েটিক্স' অবলম্বনে ট্র্যাজেডির সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা কর।
  • এরিস্টটলের 'কাব্যতত্ত্ব'-এর আলোকে ট্র্যাজেডির স্বরূপ বিশ্লেষণ কর।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন