কৃষিসমাজ বলতে কী বুঝ? এ সমাজের বৈশিষ্ট্যগুলো উদাহরণসহ ব্যাখ্যা কর। অথবা, কৃষি সমাজের সংজ্ঞা দাও। কৃষি সমাজের বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা কর।
নৃবিজ্ঞানীদের মতে, আজ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বছর পূর্বে প্রথম কৃষি সমাজের সূত্রপাত ঘটে। এ পর্যায়ে মহিলারা উদ্যান কৃষি চাষ এবং পুরুষেরা তার চেয়ে বৃহৎ আঙ্গিকে খাদ্য উৎপাদনভিত্তিক কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তোলে। সমাজ ও সংস্কৃতির বিকাশের ধারায় পশুপালন সমাজের পরবর্তী ধাপ বা পর্যায় হলো কৃষি সমাজ। সভ্যতার ইতিহাসে কৃষি সমাজ ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়।
কৃষি সমাজ : পশুপালন সমাজই পশুকে ক্রমান্বয়ে কৃষিতে
ব্যবহার করতে শুরু করে এবং এরই ধারাবাহিকতার ফলস্বরূপ পরবর্তী কৃষি সমাজের আবির্ভাব ঘটে। কৃষি পর্বে এসে মানুষ জীবন জীবিকার প্রধান উপায় হিসেবে কৃষি তথা ভূমি কর্ষণ ও শস্য উৎপাদন বেছে নেয়। লাঙল দিয়ে নিবিড়ভাবে ভূমিকর্ষণ, বীজ বপন বা রোপণ, ফসল পরিচর্যা ও রক্ষা করা, ফসল কর্তন, মাড়াই, সংরক্ষণ, ভোগ ইত্যাদি কর্মকাণ্ডকে কৃষি নামে আখ্যায়িত করা যায়। কৃষির সঙ্গে অবশ্য জীবজন্তু ব্যবহার ও প্রতিপালনের বিষয়টিও জড়িত। উদ্যান কৃষির শেষ পর্যায়ে মানুষ শিকার, সংগ্রহ অপেক্ষা বাগবাগিচা বা ফলমূল চাষের প্রতি ব্যাপকভাবে ঝুঁকে পড়ে। বাগবাগিচা তথা উদ্যান কৃষির চূড়ান্ত ধাপই হলো কৃষি পর্যায়। যদিও উদ্যান কৃষি সমাজ ও কৃষি সমাজের মধ্যবর্তী আর্থসামাজিক স্তর হলো পশুপালন সমাজ। পণ্ডিতদের মতে, উদ্যান কৃষির পরিপূর্ণতাই যেহেতু কৃষি, সেহেতু মহিলারাই কৃষি পদ্ধতির উন্মেষ ঘটায়। এ প্রসঙ্গে Robert Briffault বলেন, "The art of cultivation has developed exclusively in the hands of women." অনেকের মতে, যাযাবর পশুপালক মানুষ তৃণভূমিতে অবস্থান করে ক্রমান্বয়ে কৃষি পদ্ধতি আবিষ্কার করে। মানুষ মূলত পশুপালন ও কৃষি অর্থনীতির গোড়াপত্তন প্রায় একই সাথেই করে ফেলে। মর্গান বলেন যে, বর্বরদশার মধ্যবর্তী পর্যায়ে পশ্চিম গোলার্ধে সেচের সাহায্যে কৃষিকাজ এবং পূর্ব গোলার্ধে পশুপালন কার্যটি শুরু হয়। লাঙলের উদ্ভাবন ও ফলা সংযুক্তি এবং কৃষিকাজে পশুশক্তির ব্যবহারে কৃষিবিপ্লব সংঘটিত হয়।
• কৃষি সমাজের বৈশিষ্ট্য: নিম্নে কৃষি সমাজের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা করা হলো:
১. খাদ্যের অনিশ্চয়তা দূর: প্রাগৈতিহাসিক যুগে হাজার হাজার বছর মানুষ খাদ্যের সন্ধানে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে। বনে বাদাড়ে ঘুরে ঘুরে খাদ্য সংগ্রহ, পশুপাখির পিছনে ছোটাছুটি, নদীতে আহার্যের সন্ধান-কোনো কৌশলই তাদের খাবারের নিরবচ্ছিন্ন চাহিদা পূরণে সক্ষম হয়নি। কিন্তু কৃষিভিত্তিক সমাজে কৃষিজ উৎপাদন মানুষের খাদ্যের অনিশ্চয়তা দূর করে।
২. সভ্যতার বিকাশ: কৃষি সমাজে নদীর অববাহিকায় জলসেচভিত্তিক কৃষি সভ্যতার বিকাশ ঘটে। মেসোপটেমীয়, মিসরীয়, ব্যাবিলনীয়, সিন্ধু ও চৈনিক সভ্যতা এর সাক্ষ্য বহন করে। নদীমাতৃক সভ্যতাকে পুষ্টকরণে কৃষির অবদান অতুলনীয়। উদ্বৃত্ত উৎপাদন একটি অবকাশভোগী শ্রেণির জন্ম দেয় যাদের হাতেই সভ্যতার সূচনা ঘটে।
৩. স্থায়ী আবাস নির্মাণ : শিকার ও সংগ্রহ অর্থনীতি কিংবা পশুপালন
অর্থনীতির বাস্তবতা এমন যে জীবিকার জন্য মানুষকে অন্যত্র গমন করতে হতো। কৃষি অর্থনীতি ঠিক এর বিপরীত। জমি প্রস্তুত ও বীজ বপন থেকে শুরু করে ফসল কর্তন পর্যন্ত কৃষক জমির সাথে বাধা পড়ে যায়। এ কারণে মানুষ জমি ও উৎপাদন ক্ষেত্রের আশপাশেই স্থায়ী বসবাসের পরিবেশ গড়ে তোলে।
৪. জনসংখ্যার প্রকৃতি : ঘনঘন এলাকা পরিবর্তন, খাদ্যে অনিশ্চয়তা, পারিবারিক জীবনের অনুপস্থিতি, শ্বাপদসংকুল পরিবেশে বসবাস, যৌন জীবনে শৃঙ্খলার অভাব ইত্যাদি কারণে প্রাক-কৃষি পর্বে জনসংখ্যা ছিল কম। এ সময়কালে জন্মহার ছিল নিম্ন, কিন্তু মৃত্যুহার ছিল অধিক। কিন্তু কৃষি পর্বে এসে উপরিউক্ত প্রায় সকল ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক পরিবর্তন সূচিত হয়। যার ফলশ্রুতিতে জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে।
৫. সামাজিক অসমতা: কৃষি সমাজে সম্পদ, ক্ষমতা ও মর্যাদার তারতম্যের ভিত্তিতে সামাজিক অসমতা অধিকতর জটিলরূপ ধারণ করে। কৃষিক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান উৎপাদন ও উদ্বৃত্ত প্রভাবশালী ও ক্ষমতাধরদের নানাবিধ সুযোগ সুবিধা প্রদানে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
৬. মুদ্রা অর্থনীতি ও ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার: কৃষিভিত্তিক
সমাজে ব্যবসায়ীরা কৃষি বহির্ভূত পেশায় নিয়োজিত থেকেও যথেষ্ট প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হয়। তাদের সুবিধার্থে এবং বাস্তবতার কারণে দ্রব্য বিনিময় প্রথার পরিবর্তে মুদ্রা অর্থনীতির প্রচলন হয়। উন্নত কৃষিভিত্তিক সমাজে শিল্পবিকাশের ফলে এ ধরনের বাণিজ্য পুঁজির প্রসার ঘটে।
৭. শ্রেণি শোষণ: প্রাক-কৃষি পর্যায়ে শ্রেণি ধারণা কিংবা শ্রেণি
শোষণ ছিল সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। অর্থসম্পদ ও ক্ষমতার তারতম্যে সামাজিক শ্রেণি বিভাজন সৃষ্টি হয়। সম্পদ ও ক্ষমতাকে ব্যবহার করে শক্তিশালী, সুসংগঠিত উচ্চ শ্রেণি দুর্বল জনগোষ্ঠীকে শোষণ করার সুযোগ পায়।
৮. কৃষি প্রযুক্তি: কৃষি সমাজে লাঙলের আবিষ্কার এবং লাঙলের মাথায় ধাতু বা পাথরের সংযুক্তি ছিল গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তিগত অগ্রগতি। তাছাড়া শস্য উৎপাদনে সেচের ব্যবহার এবং মানুষের পেশিশক্তির স্থলে পশুশক্তির ব্যবহার কৃষিকাজকে একটা স্থায়ী ও পূর্ণ উৎপাদন ব্যবস্থায় পরিণত করে।
৯. জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চা : কৃষি সমাজে কৃষিক্ষেত্র ছাড়াও বিভিন্ন ক্ষেত্রে জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চা লক্ষ করা যায়। গোলাবারুদ, ঘড়ি, মুদ্রণযন্ত্র, চরকা, চাকা, বায়ু ও পানি শক্তিচালিত কল, হিসাব সংরক্ষণ পদ্ধতি, চিকিৎসা ব্যবস্থা ইত্যাদি ক্ষেত্রে কৃষিসমাজে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়।
১০. প্রশাসক শ্রেণি গঠন: কৃষিমূলক পর্যায়ে সামরিক বাহিনীর পদস্থ ব্যক্তিবর্গ, প্রশাসক ও যাজকদের নিয়ে একটা প্রশাসক শ্রেণি গড়ে ওঠে। এরা সামরিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন।
১১. পেশাজীবী : কৃষি যুগে কৃষি বহির্ভূত অনেক পেশাজীবী শ্রেণির উদ্ভব ও বিকাশ হয়। এদের মধ্যে রয়েছে ব্যবসায়ী, কারিগর, সৈনিক, করণিক, শিক্ষক, চিকিৎসক, শ্রমিক, সেবাদানকারী, বিচারক প্রভৃতি পেশাজীবী শ্রেণি।
১২. কৃষকের অবস্থা : কৃষিসমাজে কৃষকের অবস্থা আদৌ
ভালো ছিল না। কৃষি সমাজের প্রথম দিকে প্রাপ্ত সমৃদ্ধি ও স্বাচ্ছন্দ্য কৃষক সমাজ দীর্ঘদিন ধরে রাখতে পারেনি। পদস্থ সামরিক কর্মকর্তা, প্রশাসক ও যাজকেরা সম্মিলিতভাবে কৃষক শোষণে লিপ্ত হয়। এ শোষণ এমন এক পর্যায়ে পৌঁছায় যে, তা পরবর্তীকালে নতুন সমাজব্যবস্থার ভিত রচনা করে, যাকে কার্ল মার্কস সামন্ততান্ত্রিক সমাজ হিসেবে অভিহিত করেছেন।
উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে,
লাঙল আবিষ্কারের সাথে সাথে কৃষিভিত্তিক সমাজ ও সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত হয়। অনুকূল জলবায়ু ও বশীভূত পশুশক্তি কৃষিকে অধিক তাৎপর্যমণ্ডিত করে তোলে। বস্তুত কৃষিকে অবলম্বন করেই মানবসভ্যতার যাত্রা শুরু হয় এবং আজকের সভ্যতা বিনির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অনেক মনীষীর মতে, সর্বত্র কৃষিযুগ পশুপালন যুগের আগে সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু এ ব্যাপারে মতদ্বৈধতা আছে। তাই বিশ্বের সর্বত্র কৃষির পূর্বে পশুপালন ধাপ ছিল- এমন দাবি অনেকেই করেন না।