মার্কসবাদী সাহিত্যতত্ত্বের প্রধান বিবেচ্যগুলো উদাহরণসহ বর্ণনা কর। অথবা, মার্কসবাদ সাহিত্যের বৈশিষ্ট্যগুলো কী? আলোচনা কর

মার্কসবাদী সাহিত্যতত্ত্বের প্রধান বিবেচ্যগুলো উদাহরণসহ বর্ণনা কর। অথবা, মার্কসবাদ সাহিত্যের বৈশিষ্ট্যগুলো কী? আলোচনা কর
'মার্কসিজম' (Marksism) এর বাংলা হচ্ছে মার্কসবাদ। জার্মানির সমাজবিজ্ঞানী ও দার্শনিক ড. কার্ল হাইরিশ মার্কস (১৮১৮-১৮৮৩) সমাজ পরিবর্তনের লক্ষে উনিশ শতকের প্রথমার্ধে যুগান্তকারী ও বৈপ্লবিক একটি মত প্রকাশ করেন, যার নাম 'মাকর্সবাদ'। রাজনীতির অঙ্গনে এই মতাদর্শের নাম 'কুমিউনিজম' (Cummunism) বা 'সমাজতন্ত্র' (Socialism)।

১. মার্কসীয় সাহিত্যতত্ত্বের ভিত্তি মার্কসের ইতিহাসতত্ত্ব। যেখানে ইতিহাসকে দেখা হয়েছে বস্তুবাদী এবং দ্বন্দ্বমূলক হিসেবে। এ কারণে মার্কসীয় সাহিত্যতত্ত্ব বস্তুবাদী এবং দ্বন্দ্বমূলক।
২. এই সাহিত্যতত্ত্ব তিনটি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে। যথা: ক. সাহিত্যের সঙ্গে শ্রেণির সম্পর্ক, খ. বাস্তবতা কীভাবে সাহিত্যে রূপায়িত হয় এবং গ. বিচ্ছিন্নতাবাদ কীভাবে সাহিত্যকে রঞ্জিত করে।

৩. মার্কসীয় সাহিত্যতত্ত্ব অর্থনীতির বিকাশকে সাহিত্যের ভিত্তি বলে মনে করে। এই ধারার শিল্পীদের কাছে, শিল্পসাহিত্য অর্থনীতির ভিত্তির ওপর গড়ে ওঠা একটি অধিসৌধ। তাই মাকর্সীয় সাহিত্যে অর্থনীতির বিকাশ ও প্রভাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মার্কস মনে করেন, মানুষ পছন্দমতো সামাজিক সম্পর্ক সৃষ্টি বা গ্রহণ করতে পারে না। মানুষ তার সামাজিক বিকাশের স্তর ও প্রকৃতি অনুযায়ী সামাজিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে ও গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। এমনকি অন্য সকল অনুভূতির মতো মানুষের সৌন্দর্যানুভূতিও নির্ভর করে সমাজে শ্রমের রূপ ও উৎপাদন পদ্ধতির ধরনের ওপর। এখানে মনে রাখতে হবে, মার্কসীয় তত্ত্বে সাহিত্য যদিও উপরিকাঠামো বা উপরিকাঠামোর অঙ্গ তবু তা অর্থনৈতিক ভিত্তির ক্রিয়াহীন কোনো প্রতিফলন নয়। অনেক সাহিত্যরীতি যেমন- রোমান্টিক বা মরমি ভাবাপন্ন শিল্পী ভাবের ঘোরে থাকেন বলে অর্থনীতি বা অন্য অনেক কিছুই তাদেরকে প্রভাবিত করে না, মার্কসীয় ভাবাদর্শের সাহিত্যিকগণ তেমন নন।

৪. মার্কসের লক্ষ্য দরিদ্র মানুষের বঞ্চনামুক্তি। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই মার্কসবাদে উদ্বুদ্ধ কোনো লেখকের উপজীব্য বঞ্চিত-লাঞ্ছিত মানুষ ও তাদের মুক্তির পথনির্দেশ। মার্কসবাদী সাহিত্য জানায়, মানুষের সীমাহীন সম্ভাবনার কথা, মুক্ত ও আনন্দময় জীবনের কথা, এক শ্রেণিহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার বারতা। তবে লেখক একেবারেই কোনো তত্ত্বের প্রচারক হবেন এমনটা মার্কসীয়তত্ত্ব সমর্থন করে না এবং স্লোগানসর্বস্বতাকে শ্রেষ্ঠ সাহিত্যের পরিপন্থি বলেই মনে করা হয়। গবেষকদের কল্যাণে জানা যায়, মার্কস নিজে শিল্পীর আত্মপ্রকাশের প্রবণতার ওপর সহানুভূতিশীল ছিলেন।

৫. এ সাহিত্য তুলে ধরে মানুষের, বিশেষত সর্বহারা মানুষের একতাবদ্ধ হওয়ার কথা, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে অংশ নেওয়ার জন্যে শিক্ষিত হয়ে ওঠার কথা। এই শ্রেণির লেখকদের কাছে মার্কসবাদ শুধু একটি সামাজিক তত্ত্ব নয়, একটি সমাজসৃষ্টির কার্যকর পদ্ধতিও।

৬. এই শ্রেণির লেখকদের কাছে সাহিত্য উদ্দেশ্য নিরপেক্ষ নয়। তারা মানুষের জন্য, মানুষের মুক্তির জন্য সাহিত্য সৃষ্টি করতে চান। তাদের প্রত্যাশা রাজনীতি ও শিল্পকলার মেলবন্ধন, বিষয় ও আঙ্গিকের একতা, বিপ্লবী রাজনৈতিক বক্তব্য ও শিল্পরূপের নিখুঁত সমন্বয়। তবে এই শ্রেণির লেখকগণ উদ্দেশ্যকে প্রাধান্য দিলেও রচনার শিল্পগুণকে গৌণ রূপে দেখতে নারাজ। কাল মার্কস নিজেই তার এক সুহৃদকে লিখেন, সাহিত্য সমালোচনা কেবল রাজনৈতিক বা সামাজিক পটভূমির বিচার নয়; সাহিত্যের রূপ রসেরও বিচার।

৭. সামন্তবাদ বা পুঁজিবাদ 'শিল্পের জন্য শিল্প' বলে যে নীতি প্রচার করে, তার তীব্র সমালোচনা করে মার্কসবাদ। এই শ্রেণির তাত্ত্বিকগণ বলেন, এই তত্ত্বের আড়ালে শাসকদল পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় পণ্য উৎপাদনের মতো লেখক শিল্পীদের সৃষ্টিকর্মকেও পণ্যে পর্যবসিত করতে চান। কোনো কোনো মার্কসবাদী তাত্ত্বিক মনে করেন, 'শিল্পীর স্বাধীনতা' বা 'চিন্তার স্বাধীনতা' ইত্যাদি কথা যে শাসকদল বলে, তা আসলে মিথ্যা। কারণ সমাজে মৌলিক অধিকার না থাকলে বা প্রতিষ্ঠা না পেলে চিন্তা কেন, কোনোকিছুরই স্বাধীনতা থাকার সুযাগে থাকে না। তাই তারা সমাজতন্ত্রে উত্তরণের জন্যে 'জীবনের জন্য শিল্প' তত্ত্বকে দাঁড় করাতে চান।

৮. বস্তুবাদী দর্শন বস্তুকে যেমন প্রাধান্য দেয় তেমনি গৌণ মনে করে ভাব ও ভাববাদকে। ধর্ম ও ধর্মসংশ্লিষ্ট ভাবনা যেমন- পরকাল, স্বর্গ-নরক ইত্যাদিও তাদের কাছে তেমন গুরুত্ব বহন করে না। এ কারণে এই শ্রেণির সাহিত্যে মানবজীবনের অপরিহার্য উপাদান হিসেবে ধর্ম স্থান লাভ করেনি। অধিকন্তু তাদের লেখায় স্থান পেয়েছে ধূর্ত শোষকগণ কীভাবে ঈশ্বরের নামে, ধর্মের নামে মানুষকে বোকা বা নেশাগ্রস্ত করে রেখেছে তার বর্ণনা ও বৃত্তান্ত।

৯. এই শ্রেণির সাহিত্য উদঘাটন করতে চেয়েছে সামন্তবাদ ও পুঁজিবাদের নগ্ন চেহারা আর তাদের শোষণের স্বরূপ। সামন্ততন্ত্রের বা পুঁজিবাদের প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্র তাদের লেখায় অসাধারণ হয়ে ফুটে এসেছে। এই ধারার কালজয়ী লেখকদের অনেকেই শিল্পনন্দন করে তুলে ধরেছেন ধনতান্ত্রিক শোষণ ব্যবস্থার জীবনবিরাধেী অপরাধসমূহ। তারা সুচারুভাবে দেখিয়েছেন, পুঁজিবাদ কীভাবে শিল্পকে পণ্যে পরিণত করে, কীভাবে শিল্পীর স্বাধীনতাকে হরণ করে, রাষ্ট্র ও আমলাতন্ত্র কীভাবে মানুষের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করে। একই সঙ্গে এই ধারার লেখকগণ শ্রেণিসংগ্রামের প্রকৃত রূপকে এবং শোষিত শ্রেণির সংস্কৃতিকেও পৃথক করে তুলে ধরে।

১০. এই শ্রেণির লেখকগণ নিজকে মনে করেন একজন সৈনিক, যার আছে দৃঢ়তা, সাহস আর তীক্ষ্ণ বুদ্ধি। এই কলমসৈনিক নেমে আসবেন কল্পনার আকাশ থেকে মাটির ধুলায়, সাধারণ মানুষের স্তরে, সাধারণ মানুষের অনুভূতিকে বুঝতে এবং ধারণ করতে। তিনি বুকের শক্তি দিয়ে ভাঙবেন অভিজাত বা বুর্জোয়া শ্রেণির বাধার প্রাচীর, নিশ্চিত করবেন কোটি কোটি মেহনতি মানুষের সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্য যারা আগামীকালের ভবিষ্যৎ। তাদের কাছে শিল্পসাহিত্যের মূল কথা- মানুষকে ভালোবাসা, মানবজাতিকে ভালোবাসা, ভালোবাসার স্বার্থে দুনিয়াকে বদলে দেওয়া। এজন্যে তাদের সাহিত্যকর্ম কখনও পণ্য হিসেবে পর্যবসিত হয় না।

১১. মাকর্সবাদীদের লেখায় উঠে এসেছে সাধারণ মানুষের বাস্তব জীবন ও সে জীবনের দুঃখ যন্ত্রণা ও যন্ত্রণার স্বরূপ। তাদের লেখার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অকৃত্রিমতা। অকৃত্রিম বলে তাদের লেখায় সমাজের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব অসাধারণ হয়ে ফুটে উঠেছে। তবে তাদেরকে এজন্য অবশ্যই দুঃখবাদী বলা যাবে না। দুঃখ মোচনের প্রচেষ্টাই তাদের লক্ষ্য।

১২. মার্কসীয় সাহিত্য বাস্তবতাকে ধারণ করে। শিল্পে বাস্তববাদী বলতে নিছক ফটোগ্রাফিকে নির্দেশ করে না। বাস্তববাদ সম্পর্কে মার্কসের বন্ধু ও সহযোদ্ধা এঙ্গেলসের ধ্রুপদী সংজ্ঞার্থ হলো "পুঙ্খানুপুঙ্খের সত্যের পাশাপাশি টিপিক্যাল পরিস্থিতিতে টিপিক্যাল চরিত্রের বস্তুনিষ্ঠ পুনরুৎপাদন।" তাই এই ধারার শিল্পীদের কাছে বাস্তববাদিতা হলো ঘটনা বা বিষয়বস্তুর মর্মমূলে প্রবেশ করা; বাস্তবের বিশ্বস্ত উপস্থাপনার বাইরে গড়পড়তা পরিবেশের প্রতিনিধিত্বমূলক চরিত্রের বিশ্বস্ত উপস্থাপনা।

১৩.মার্কসীয়তত্ত্ব সাহিত্যনির্মাণে আধারের ওপর অধিক গুরুত্ব দেন। মাকর্সবাদী শিল্পীগণ মনে করেন, একটি রচনা শিল্পমূল্য লাভ করে বিষয়বস্তুর গুরুত্বের কারণে। তাদের কেউ কেউ মনে করেন, ভালো রচনার আঙ্গিকও নির্ধারিত হয় আধেয় দ্বারা। ১৪. এই ধারার লেখকগণের কাছে নান্দনিক ও শৈল্পিক উপাদান ততটা গুরুত্ব বহন করে না, যতটা গুরুত্ব বহন করে ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক মতাদর্শ। যুগের মতাদর্শ যেমন মার্কসীয় তত্ত্ব বিবেচনা করে তেমনি মতাদর্শগত দৃষ্টিভঙ্গিকেও উপেক্ষা করে না।

১৫. এই ধারার লেখকগণের মাঝে কমবেশি শ্রেণি মনস্তত্ত্ব প্রতিফলিত। আবার কেউ কেউ সাহিত্যকে শ্রেণি প্রতিভূ না দেখে নিজস্ব ব্যক্তিত্বের অধিকারী হিসেবেও দেখেছেন এবং সাহিত্যে শ্রেণিসত্তার সঙ্গে ব্যক্তিসত্তা সমান জরুরি- এই কথা বলেছেন।

বাস্তববাদ প্রসঙ্গে মার্কসীয় সাহিত্যিকদের বিবেচনার তিনটি দিক লক্ষণীয় : বস্তুজগতের বিশ্বস্ত উপস্থাপন, জীবনসংগ্রামের মাধ্যমে রচিত মানবিক বাস্তব জগতের প্রতিফলন এবং সে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে মানবপ্রকৃতির যে নতুন সত্য উদ্ভাসিত, তার পরিচর্যা নিশ্চিত করা। সোভিয়েট ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার পর সেখানে এ ধারার কবি সাহিত্যিকগণ সমাজতন্ত্র নির্মাণের লক্ষ্যে নতুন একটি সাহিত্যধারার জন্ম দেন। তারা এই ধারাটিকে সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতা নামে অভিহিত করে।
আপনারঅদৃশ্যমন্তব্য
Cancel