নারীবাদী সাহিত্য সমালোচনার প্রধান প্রণালিপদ্ধতি ও ধারাগুলোর পরিচয় দাও।
নারীবাদ একটি মতবাদ যা নারীকে পুরুষের সমান মর্যাদা দানের পক্ষে কথা বলে। এই মতবাদটি শুরু থেকে সাহিত্য সমালোচনার সাথে সম্পৃক্ত ছিল না। শুরুতে এটি একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক মতবাদ হিসেবে পরিচিত ছিল। কিন্তু যুগের পরিবর্তনের ধারায়, বিশ শতকে এসে নারীবাদ নামক মতবাদটি সাহিত্যতত্ত্বে জায়গা নিতে শুরু করে। যা বর্তমানে সাহিত্য সমালোচনা ধারার গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।
প্রথমদিকে নারীবাদ পুরষ লেখকদের লেখায় নারীর অবমূল্যায়িত ও নিগৃহীত চিত্র অনুসন্ধানে ব্যাপৃত ছিল। পরবর্তী সময়ে নারীবাদ সাহিত্যকর্মের অর্থনির্মাণ প্রক্রিয়ার বিভিন্ন মৌলিক বিষয়ে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তার সংযোজনে সফলতা প্রদর্শন করে।
একটি সময়ে নারীরা সমাজে বিভিন্নভাবে অবহেলা আর অত্যাচারের নারীবাদের সাথে সংশ্লিষ্ট হয়ে গেছে। এ সময়ের নারীবাদীদের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন লেখক, সমাজ সংস্কারক নারীদের পক্ষে কথা বা লেখনী শুরু করে। এক্ষেত্রে পুরুষদের ভূমিকা অগ্রগণ্য। আর এ ধারার সাহিত্য সমালোচনার পিছনে রয়েছে দুইশত বছর ধরে নারীর আত্মসচেতনার ইতিহাস এবং পুরুষের সঙ্গে নারীর অধিকার বিষয়ক আন্দোলনের ইতিহাস। এই সাহিত্যতত্ত্বে মূলত সাহিত্যে দীর্ঘকাল ধরে কর্তৃত্ববাদী পুরুষতান্ত্রিক মতাদর্শ এবং পুরুষ কর্তৃক প্রদত্ত ব্যাখ্যাকে প্রশ্নের সম্মুখীন করতে হয়। আসলে এ যাবৎকাল রচিত সাহিত্যে সর্বদাই পুরুষের জয়জয়কার গাওয়া হয়েছে। শুধু বাংলা সাহিত্য নয় সমগ্র পৃথিবীর সাহিত্যেই অর্থাৎ বিশ্বসাহিত্যে পুরুষের প্রাধান্য লক্ষণীয়। এর ফলে সৃষ্টি হয়েছে হ্যামলেট, ইডিপাস প্রভৃতি চরিত্র। এরই প্রতিবাদস্বরূপ নারীবাদী সাহিত্য ও সাহিত্য সমালোচনা গড়ে উঠেছে।
আধুনিক সভ্যতায় নারীবাদের আবির্ভাব রাজনৈতিক উদারতন্ত্রের হাত ধরে। রাজনৈতিক উদারতন্ত্রের বক্তব্য ছিল যে, সরকার ব্যবস্থায় সকল অংশগ্রহণ থাকতে হবে এবং আইনের চোখে সকল নাগরিককে সমান মর্যাদায় আনতে হবে। এ ভাবনার ছায়াতলে দাড়িয়েই ঐতিহাসিক স্বীকৃতি অনুযায়ী নারীবাদের প্রথম উচ্চারণটি করলেন মেরি ওলস্টানক্রাফট (Marry Wollstorecnaft: 1759 1797) ১৭৯৮ সালে প্রকাশিত তার প্রকাশিত A Vindication of the Right of Women গ্রন্থের মাধ্যমে। ১৮৬৯ সালে দার্শনিক জন স্টুয়ার্ট মিলের গ্রন্থ The Subjection of Women উদারতন্ত্রের আশ্রয়ে গড়ে ওঠা নারীবাদী আন্দোলনকে আরও একধাপ এগিয়ে দিল।
এছাড়া Susan B. Anthony এবং Victoria Woodfull এর মতো বেশকিছু সচেতন নারী তাদের নানারকম কাজকর্ম, লেখালেখির ভেতর দিয়ে নারী আন্দোলনের প্রথম ভিত তৈরি করেন।
এসময় নারীর 'অধিকার' নারীর স্বাধীনতা নিয়ে অনেক কথা উঠলেও তা ব্যাপক কোনো আন্দোলনে রূপ লাভ করেনি। বিংশ শতাব্দীর শুরুতেই ভয়াবহ বিশ্বযুদ্ধ এবং তার ফলে জাত তীব্র সংকটগুলোর মধ্যে দেখা যায় নারীদের পণ্যদ্রব্যের ন্যায় ব্যবহার করা হচ্ছে, দিনে দিনে তাদেরকে মূল্যায়নের পরিবর্তে অধিক অবমূল্যায়িত করা হচ্ছিল। তারই ভেতর দিয়ে আসে নারীবাদের দ্বিতীয় তরঙ্গ। তখন নারীবাদ একটি তাত্ত্বিক ভিত্তি পেয়ে একটি আন্দোলনের রূপ লাভ করে। অসময় বিভিন্ন নারীবাদী সংগঠন সৃষ্টি হয়। নানা ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ে। যেমন দেখা যায় নারীবাদী রাজনৈতিক কর্মী কিংবা National Organization of Woman (1966) এর মতো সংগঠন।
এ সময় নারীবাদকে একটি বিশেষ অবস্থানে নিয়ে যান যারা তাদের মধ্যে Simone de Beauvior, Elaine Showalter প্রমুখ বিখ্যাত হয়ে আছেন। আর নারীবাদের তৃতীয় তরঙ্গটির সূচনাটা হয় বিংশ শতাব্দীর প্রায় শেষদিকে ১৯৯০ এর দিকে। যার রেশ আজ পর্যন্ত বলবৎ। মূলত উত্তর কাঠামোবাদ ও উত্তর আধুনিকতাবাদের কাছে থেকে এ সময়ের নারীবাদ তাদের চৈতন্যকে হালনাগাদ করেছে।
বর্ণবাদ বা অর্থনৈতিক শ্রেণি বৈষম্যবাদের মতো বিষয়গুলোর এক্ষেত্রে শিকার হতো ফলে নারীরা নিজেদের স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলেছিল। মধ্যে Alice Walker অন্যতম।
বাঙালি সমাজে নারীবাদের পক্ষে প্রথম কথা বলেছে পুরুষেরা। শুধু কথা বলেই ক্ষান্ত থাকেন নি পুরুষরাই প্রথমে বিভিন্ন সংস্কারের মাধ্যমে, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও লোকবিশ্বাসকে উপেক্ষা করে নারীদের পর্দার অন্তরাল থেকে সমাজের মূল ধারার সাথে সমানে চলার সুযোগ করে দেয়। তাইতো সতীদাহ প্রথা, বিধবাবিবাহ, স্ত্রীশিক্ষা প্রভৃতি সামাজিক শদালনে পুরুষেরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল। ফলশ্রতিতে, নারী অর্জন করতে থাকল তার উচ্চাসন, তার অবস্থান। এরপর উনিশ ও বিশ শতকে স্বর্ণকুমারী দেবী (১৮৫২-১৯৩২), সরলাদেবী চৌধুরানী (১৮৭২-১৯৪৫), বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন (১৮৮০-১৯৩২) নারীমুক্তি আন্দোলনে এগিয়ে আসেন। পিছিয়ে পড়া মুসলমান সমাজের নারীদের নিয়ে সব থেকে বেশি কাজ করেছেন বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন।
এভাবে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জন নারীবাদ নিয়ে কথা বলেছেন। নারীবাদী সাহিত্য সমালোচনা পর্যবেক্ষণ করলে বেশকিছু বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। যেগুলোর ওপর ভিত্তি করে নারীবাদী সাহিত্য সমালোচনা গড়ে উঠেছে। যেমন-
১. নারীর লেখালেখির ঐতিহ্যবাহী ধারাকে আবিষ্কার ও উন্নয়ন।
২. নারীর লেখার প্রতীকী দিকগুলো চিহ্নিত করা যাতে তা পুরুষের দৃষ্টি এড়াতে না পারে এবং টিকে থাকে।
৩. পূর্বের সাহিত্যকর্মকে পুনরায় মূল্যায়ন।
৪. নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে লেখিকা ও তার দৃষ্টিভঙ্গিকে বিশ্লেষণ।
৫. সাহিত্যে যৌনতার ব্যবহারের বিরোধিতা করা।
৬. সাহিত্যের ভাষা ও রীতিতে শৈল্পিক রাজনীতি সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা।
এসব দিক ছাড়াও নারীবাদী সাহিত্য সমালোচনা আরও বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে কাজ করে যার মধ্যে সমাজের বিভিন্ন দিক-শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন, রাজনীতিতে নারীর ভূমিকা, নারীর কর্মসংস্থান ইত্যাদি বিষয়গুলো শীর্ষে রয়েছে।
মানুষ হিসেবে নারীর স্বাধীনতা ও সাম্যের স্বরূপ, মানুষ বা নারীর প্রকৃত স্বভাব, রাষ্ট্রের দায়িত্ব, পারিবারিক সমাজ কাঠামো, পরিবার কাঠামো- এসব বিষয়ে বিভিন্ন নারীবাদীদের মধ্যে দর্শনগত ভিন্নতা রয়েছে। যার ফলে নারীবাদের ধারার মধ্যে যথেষ্ট বৈচিত্র্য রয়েছে। নারীমুক্তি সম্পর্কিত নারীবাদের বিভিন্ন মতবাদ বা ধারাগুলো নিম্নে উল্লেখ করা হলো:
১. রক্ষণশীল মতবাদ
২. উদারনৈতিক বা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী নারীবাদ
৩. মার্কসীয় মতবাদ,
৪. আমূল নারীবাদ,
৫. সমাজতান্ত্রিক নারীবাদ,
৬. অস্তিত্ববাদী নারীবাদ,
৭. পরিবেশবাদী নারীবাদ ও
৮. পোস্ট মডার্ন নারীবাদ।
রক্ষণশীল মতবাদ: এটি পুরোপুরিভাবে নারীমুক্তির বিরোধী। এই মতবাদ অনেকটা পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থাকে সমর্থন, করে। এই মতবাদ বিশ্বাস করে পিতৃতান্ত্রিক অবস্থানেই নারীর সঠিক অবস্থান। নারীদের বা প্রকৃত নারীবাদে বিশ্বাসীদের লড়াই এ মতবাদের বিরুদ্ধে। অর্থাৎ নারী ও পুরুষ একই কাজের উপযুক্ত নয় বরং নারী বর্তমান সমাজব্যবস্থায় যে অসময় অবস্থানে রয়েছে তাই ন্যায় ও শাশ্বত।
উদারনৈতিক বা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী ধারা: বিদ্যমান সমাজ কাঠামোকে অক্ষুণ্ণ রেখে পুরুষের মতো নারীরও সমান অধিকার অর্জনের জন্য সংগ্রাম করা হলো উদারনৈতিক ধারার মূল বৈশিষ্ট্য। এই মতবাদ বিশ্বাসীরা সংস্কারে বিশ্বাসী। তাদের আশা, বিদ্যমান সামাজিক প্রতিষ্ঠান, আইনকানুন, বিধিব্যবস্থা সংস্কার ও সংশোধন করার মাধ্যমে নারী ও পুরুষের মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্য ও অসমতা দূর করা সম্ভব।
Manew ollstone craft, John Stuart Mill, Harriet taylor এই ধারার প্রবক্তা। Betty Friedman মূলত রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এর সমর্থক ছিলেন।
মার্কসীয় নারীবাদ: কার্ল মার্কস ও ফ্রেডারিক এঙ্গেলস মার্কসবাদী মতাদর্শ হলো নারীবাদের ভিত্তি। এই মতবাদের প্রবক্তারা গভীরভাবে বিশ্বাস করেন শ্রেণিবিষম্যই হচ্ছে নারী নির্যাতনের কারণ। Capitalism উচ্ছেদ করে শ্রেণিহীন সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে পারলে নারীমুক্তি সম্ভব বলে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন। নারী মুক্তি আন্দোলনকে তারা পুরুষের বিরুদ্ধে পরিচালিত করার পক্ষে মতামত দেননি। এদের কাছে নারীমুক্তি আন্দোলন মানে পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা ও পুরুষতান্ত্রিক পুঁজিবাদী সামাজিক সম্পর্কের বিরুদ্ধে। মূলত লেনিন, অগাস্ট বেবেল, ক্লারা জেটকিন, আলেকজান্ডার কোলন তাই প্রমুখ এই মার্কসীয় নারীবাদের ভিত্তি নির্মাণ করেন।
আমূল নারীবাদ: এই মতবাদ পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থাকে তীব্রভাবে কটাক্ষ করে। প্রচলিত সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন না করে, অন্তর্ভুক্তি প্রকল্পের দ্বারা কিছু আইন প্রণয়ন করে, নারীর অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব বলে এরা মনে করেন না। এরা নারী পীড়নের সমস্ত ঘটনাকে ব্যাখ্যা করেন লিঙ্গ-পীড়ন দিয়ে। তাদের দৃষ্টিতে সব রকম লিঙ্গ পীড়নের মূলে আছে পিতৃতন্ত্র। এই মতবাদের প্রবক্তাগণ মনে করেন, পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা পরিবর্তন না করলে এই বৈষম্য দূর হবে না। এরা দাবি করেন আত্ম নিয়ন্ত্রণের সম্পূর্ণ অধিকার ও যৌন স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতা ঘটতে পারে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়ন সাধনের মধ্য দিয়ে। নারী তার শরীর ও জরায়ুর ওপর লাভ করবে নিরঙ্কুশ অধিকার, কৃত্রিম উপায়ে সন্তান ধারণ সম্ভব হবে, ফলে পিতৃতান্ত্রিক ভাবাদর্শের মৃত্যু ঘটবে।
এই ধারার নারীবাদীদের প্রধান দাবিগুলো ছিল-
১. সমবেতন,
২. সমান শিক্ষা ও কাজের সুযোগ,
৩. আর্থিক ও আইনি স্বাধীনতা,
৪. চব্বিশ ঘণ্টার অবৈতনিক নার্সারি,
৫. বিনামূল্যে গর্ভ নিয়ন্ত্রণ ও গর্ভপাত,
৬. নারীর নিজস্ব যৌনতা নির্ধারণের অধিকার,
৭. লেসবিয়ান সম্পর্কে বৈষম্যের অবসান ও
৮. যৌন পীড়ন ও ভায়োলেন্স থেকে মুক্তি।
এরা দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন সেই উপায়গুলোর দিকে যেগুলো উদ্ধৃত হয়েছিল পাশ্চাত্য সমাজের বিশেষ গঠনের জন্য। সিমন দ্য বোভেয়ার তার 'Second Sex' গ্রন্থে যুক্তি দিয়েছেন যে পশ্চিমী সংস্কৃতি পুরুষকে স্বাভাবিক আর নারীকে বিচ্যুতি বা অপর হিসেবে দেখছে।
সমাজতান্ত্রিক নারীবাদ : এই মতবাদে বিশ্বাসীরা মনে করেন,
শুধু ধনিকতন্ত্র বা পুঁজিবাদ নারী-পুরুষ বৈষম্যের একমাত্র কারণ নয়। নারীর বৈষম্য বা নারীর নির্যাতনের পিছনে ধনিকতন্ত্রের পাশাপাশি পিতৃতন্ত্রের যোগসংযোজন অনেকাংশে দায়ী। তদের দৃষ্টিতে নারীর পূর্ণ অধিকার ফিরিয়ে দিতে এবং অসমতাকে দূর করতে হলে ধনিকতন্ত্র ও পিতৃতন্ত্র উভয়ের উচ্ছেদ প্রয়োজন। সমাজতান্ত্রিক নারীবাদের প্রবক্তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন- Alison Jaggar, Jaliet Mitchell এবং Tris Young.
অস্তিত্ববাদী নারীবাদ : সিমোন দি বোভেয়ার ছিলেন এই মতবাদের প্রবক্তা। The Second Sex নাম গ্রন্থে অস্তিত্ববাদী থিওরি প্রয়োগ করে তিনি আলোড়ন সৃষ্টি করেন। তার দৃষ্টিতে পুরুষ সব সময় নিজের ভূমিকা পালন করে নিজেকে self এবং নারীকে other মনে করে। তিনি আরও সমাজে নারী যে ভূমিকায় থাকে তা পুরুষের দ্বারা সৃষ্ট। তারা নারীমুক্তির জন্য সর্বপ্রথম নারীর অস্তিত্ব সৃষ্টি জরুরি বলে মনে করে। এদের দৃষ্টিতে নারীর অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য চারটি কৌশল গ্রহণ করা অপরিহার্য। যথা:
১. নারীর কর্মজীবনে প্রবেশ,
২. নারীর বুদ্ধিজীবী হিসেবে আত্মপ্রকাশ,
৩. সমাজে সমাজতন্ত্রের উত্তরণ,
৪. পুরুষের নিয়ন্ত্রণমূল অস্তিত্ব লঙ্ঘন করে নিজ অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠা।
পরিবেশবাদী নারীবাদ : পরিবেশবাদী নারীবাদ হচ্ছে একটি
সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন। যেখানে নেতৃত্ব দিচ্ছে বিভিন্ন স্তরের নারীবাদী এবং পরিবেশবাদীরা। পরিবেশ নারীবাদীরা মনে করেন, নারীর প্রতি সহিংসতার সাথে প্রকৃতি ধ্বংসের একটা নিবিড় সম্পর্ক আছে। নারী দেহের প্রতি আধিপত্য এবং প্রকৃতির প্রতি আধিপত্য একই সূত্রে বাঁধা। জমির প্রতি যেমন পুরুষের মালিকানা তেমনি নারীর প্রতিও পুরুষের মালিকানা থাকে। জমি চাষের জন্য যেরূপ কর্ষণ করা হয়, নারীকেও সে রকম ধর্ষণ করা হয়। নারীকে শস্যক্ষেত্রের মতো অনিরাপদ আর অরক্ষিত মনে করা হয়। তারা মনে করেন, সমাজের বর্তমান অবস্থায় নারী কেবলই ভোগ্য বস্তু এবং সন্তান বা শস্য উৎপাদনের মেশিন।
মানুষ যেভাবে প্রকৃতিকে ধ্বংস করছে, বন ধ্বংস করছে, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করছে। নারীকে যেভাবে প্রকৃতির সাথে তুলনা করে আবার প্রকৃতিকে নারীর সাথে তুলনা করে কার্যত একইভাবে প্রকৃতি এবং নারীকে নির্যাতন করা হচ্ছে।
পৃথিবীতে যুদ্ধ, সাম্রাজ্য, বিজ্ঞান, শিল্পের ইতিহাস হচ্ছে পুরুষের ইতিহাস। শতাব্দী পর শতাব্দী ধরে সভ্যতায় নারীর অবদান অস্বীকার করা হচ্ছে। ইকোফেমিনিস্টরা মনে করেন পৃথিবীর সভ্যতা, সংস্কৃতি নির্মাণে নারীর ভূমিকাকে কেবলই উপেক্ষা করা হয়েছে। সভ্যতার উন্নতির দোহাই দিয়ে একের পর এক পরিবেশ ধ্বংস করা মোটেও যৌক্তিক নয়।
এদের মতে, মাতৃপ্রধান বা পরিবেশকেন্দ্রিক সমাজব্যবস্থায় পরিবেশ যেমন সুরক্ষিত ছিলো, তেমনি নারীরা নিজেই স্বাবলম্বী ছিল। তাই পরিবেশকে বাঁচিয়ে, নারীকে সমান অধিকার দিলেই এই পৃথিবী সমূহ ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পাবে।
পোস্ট মডার্ণ বা উত্তর-আধুনিক নারীবাদ: উত্তর-আধুনিকতা
হলো আধুনিক পরবর্তী কালের দর্শন। অন্যান্য দর্শনের মতো এই দর্শনেও ব্যাখ্যা করা হয়েছে জীবনজগৎ ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে। সমসাময়িক কালের বেশ কয়েকটি ঘটনা উত্তর-আধুনিক দর্শনের অভিমুখ গড়ে তোলে, তার মধ্যে অন্যতম আফ্রিকা-লাতিন আমেরিকা জুড়ে উপনিবেশবাদ ও নয়া উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার লড়াই। উদরআধুনিক দর্শনের প্রধান তিন ব্যক্তিত্ব ফুকো, লাকা ও দেরিদা। ফুকো সমাজ, ইতিহাস, প্রতিষ্ঠান, রাজনীতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে ক্ষমতার ভূমিকা এবং চাপের সর্বগ্রাসী অবয়ব বিশ্লেষণ করে দেখান। লাকা মানবমনকে ভাষাতাত্ত্বিক পদ্ধতিতে পাঠ করতে চান আর দেরিদা ভাষা ও দর্শনের ক্ষেত্রে অবদান রেখেছেন।
উত্তর আধুনিক নারীবাদীরা মনে করেন, আধুনিক চিন্তা অভ্যাসের ফলে যে বৈষম্যগুলো তৈরি হয়েছে তার মধ্যে লিঙ্গ-বৈষম্যই হচ্ছে প্রধান এবং দৃঢ়মূল, তাই তা সহজে দূর হবার নয়। অর্থনৈতিক পরিকাঠামো পাল্টে গেলেও চিন্তাকাঠামোর পরিবর্তন না হওয়ার ফলে লিঙ্গবৈষম্য দূর হয় না। বিভেদ ও বৈষম্যভাবনা হাত ধরাধরি করে চলে, ফলে এক জায়গায় বৈষম্যভাবনা দূর হলে অন্যরূপে অন্য জায়গায় তা হয়।