প্রত্যক্ষবাদ কী? অগাস্ট কোঁতের প্রত্যক্ষবাদ ব্যাখ্যা কর। অথবা, প্রত্যক্ষবাদ বলতে কী বুঝ? আধুনিক সমাজ অধ্যয়নে এর তাৎপর্য ব্যাখ্যা কর।

প্রত্যক্ষবাদ কী? অগাস্ট কোঁতের প্রত্যক্ষবাদ ব্যাখ্যা কর। অথবা, প্রত্যক্ষবাদ বলতে কী বুঝ? আধুনিক সমাজ অধ্যয়নে এর তাৎপর্য ব্যাখ্যা কর।
অগাস্ট কোঁৎকে মূলত পজিটিভিজম বা প্রত্যক্ষবাদের প্রবক্তা বলা হয়। তিনি জ্ঞানের সমগ্র বিকাশের ধারাকে যে তিনটি স্তরে ভাগ করেছেন তার মধ্যে একটি হলো প্রত্যক্ষবাদী স্তর। অর্থাৎ তার মতে, জ্ঞানের বিকাশের তৃতীয় বা শেষ যুগ হচ্ছে পজিটিভিজম বা প্রত্যক্ষবাদের যুগ। কোঁৎ প্রত্যক্ষবাদকে বিজ্ঞানের সাথে মিল করে ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। অর্থাৎ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি হিসেবে প্রত্যক্ষবাদকে অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে তিনি আলোচনা করেছেন।

প্রত্যক্ষবাদ : Positive শব্দ থেকে Positivism শব্দটি এসেছে। Positive শব্দের অর্থ হলো বাস্তব। বাস্তব বলতে আমরা বুঝি যাকে প্রমাণ করা যায়। জাগতিক এবং সামাজিক কোনোকিছুকে ব্যাখ্যা করার জন্য কোঁৎ এ তত্ত্বটি দাঁড় রিয়েছিলেন। এ প্রত্যয়টি তিনি ধার নিয়েছিলেন দার্শনিক কান্ট ও হিউমের কাছ থেকে। এটি একটি দার্শনিক জ্ঞান। সেটি পরীক্ষণ ও পর্যবেক্ষণের ওপর নির্ভরশীল। ফরাসি বিপ্লবোত্তর ফ্রান্সে চিন্তাবিদদের মধ্যে দুটো ধারা প্রচলিত ছিল। একটি ছিল সমাজব্যবস্থা ও প্রথা প্রতিষ্ঠানের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের পক্ষে, অপরটি ছিল সমাজব্যবস্থার ভিতরে প্রগতি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার পক্ষে। কোঁৎ ছিলেন দ্বিতীয় ধারার পক্ষে। তাই কোঁতের দৃষ্টিভঙ্গির এক সুস্পষ্ট প্রতিফলন লক্ষ করা যায় প্রত্যক্ষবাদী তত্ত্বের মধ্যে।

অগাস্ট কোঁতের প্রত্যক্ষবাদ: কোঁতের প্রত্যক্ষবাদ তত্ত্বের দুটি প্রস্তাবনা আছে যার ওপর ভিত্তি করে এ তত্ত্বটি গড়ে ওঠে। নিম্নে এ সম্পর্কে বর্ণনা করা হলো:
প্রথমত, কোঁৎ তার প্রত্যক্ষবাদে যাবতীয় অধিবিদ্যা সম্বন্ধীয় চিন্তা ও দর্শনকে প্রত্যাখ্যান করে ঘোষণা দেন যে, ঐসব উক্তি অর্থপূর্ণ বা তাৎপর্যপূর্ণ হতে পারে সেগুলো ব্যাখ্যা করা যায় অথবা পরীক্ষা দ্বারা প্রমাণ করা যায়।
দ্বিতীয়ত, অপরিবর্তনীয় কিছু প্রাকৃতিক নিয়মের অধীনে গোটা মহাবিশ্ব পরিচালিত হচ্ছে। এ নিয়মগুলো বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে আবিষ্কার করা বা জানা সম্ভব।
অগাস্ট কোঁৎকে মূলত পজিটিভিজম বা প্রত্যক্ষবাদের প্রবক্তা বলা হয়। তার মতে, জ্ঞানের বিকাশের তৃতীয় বা শেষ যুগ হচ্ছে পজিটিভিজম বা প্রত্যক্ষবাদের যুগ। এ যুগে বিজ্ঞানের মাধ্যমে প্রত্যক্ষবাদ বিশ্লেষণ করা হয়েছে এবং প্রকৃতির বাইরে ঈশ্বর বা অন্য কোনো চরম সত্তাকে অস্বীকার করা হয়েছে। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা এবং প্রত্যক্ষবাদ এখানে চরম সত্য এবং একে অতিক্রম করে যাওয়ার কোনো ক্ষমতা মানুষের নেই। তাই কোঁতের প্রত্যক্ষবাদের মূল কথা হলো- এ স্তরে বিজ্ঞান শুধু বাস্তব জগতের দৃষ্ট বিষয়ের বর্ণনা ও বিশ্লেষণ দিবে এবং এর বাইরে অন্য কিছু অনুসন্ধান করবে না। মানুষ প্রত্যক্ষের ভিত্তিতে এবং অভিজ্ঞতার আলোকে সবকিছু উপলব্ধি করবে। অগাস্ট কোঁতের পজিটিভিজমকে তাই অনেকে চরম অভিজ্ঞতাবাদ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।

প্রত্যক্ষবাদের মৌল উপাদান: কোঁৎ প্রত্যক্ষবাদকে বিজ্ঞানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে চিহ্নিত করেছেন। এখানে লক্ষণীয় যে, বিজ্ঞান এবং অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান কখনো এক নয়। কোঁৎ এ দুয়ের মধ্যে পার্থক্য সামনে রেখেই প্রত্যক্ষবাদকে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছেন। প্রত্যক্ষবাদকে আরও সুস্পষ্টভাবে জানার জন্য কয়েকটি মৌল উপাদান চিহ্নিত করা যেতে পারে। নিম্নে এ সম্পর্কে বর্ণনা করা হলো:
প্রথমত, জানা সম্ভব শুধু এমন ঘটনাকে প্রত্যক্ষবাদ ব্যাখ্যা করে, যা কিছু সম্ভব নয়, যার অস্তিত্ব নেই সেটিকে প্রত্যক্ষবাদ বলে না। 
দ্বিতীয়ত, এটি অতিপ্রাকৃত বিষয় নিয়ে আলোচনা করে না (তাই বলে এটি নাস্তিকতা নয়)।
তৃতীয়ত, প্রত্যক্ষবাদ ভাগ্যবাদে বিশ্বাস করে না (এটি বিশ্বাস করে যে, বাহ্যিক সব বিষয় প্রচেষ্টার মাধ্যমে পরিবর্তন করা যায়)।
চতুর্থত, প্রত্যক্ষবাদ মানুষকে খুব বেশি আশাবাদী করে না (কারণ ধর্মতত্ত্বের আশাবাদী ধারণা এখানে নেই)। | 
পঞ্চমত, এটি বস্তুবাদী দর্শন নয়।
ষষ্ঠত, এটি শুধু প্রয়োজনীয় জ্ঞান নিয়ে আলোচনা করে, সব জ্ঞান নিয়ে আলোচনা করে না।
সপ্তমত, প্রত্যক্ষবাদ আপেক্ষিক সত্যে বিশ্বাস করে, চরম সত্যে নয়।
অষ্টমত, এটি একটি চিন্তার পদ্ধতি, যা সর্বজনীনভাবে গ্রহণ করা যেতে পারে।
নবমত, প্রত্যক্ষবাদ মানবতার ধর্ম। প্রত্যক্ষবাদ একটি সর্বজনীন দর্শন, যা বিশ্বের সকল মানুষের দ্বারা গৃহীত হতে পারে।
দশমত, এটি একটি বিজ্ঞানসম্মত মতবাদ, যার উদ্দেশ্য হলো সব সমাজের মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক, নৈতিক এবং বৈষয়িক সকল ধরনের উন্নতি নিশ্চিত করা।
একাদশতম, প্রত্যক্ষবাদ একাধারে একটি বিজ্ঞান এবং অপরদিকে একটি ধর্ম।

প্রত্যক্ষবাদী দৃষ্টিভঙ্গি: প্রত্যক্ষবাদ কোঁতের দৃষ্টিতে একটি বিজ্ঞানসম্মত মতবাদ, যার লক্ষ্য মানবসমাজের বস্তুগত, বুদ্ধিবৃত্তিক এবং নৈতিকতাসংক্রান্ত সমৃদ্ধি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি এবং এ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য কতকগুলো বিশেষ শিক্ষা ও নির্দেশের আশ্রয় গ্রহণ করার কথা তা প্রত্যক্ষবাদে উল্লেখ করা আছে। প্রত্যক্ষবাদকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। নিম্নে এ সম্পর্কে বর্ণনা করা হলো:
১. বিজ্ঞানসমূহের দর্শন: পৃথিবীর সকল বিজ্ঞানই একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। সব বিজ্ঞানই মানবতার কথা বলে। বৈজ্ঞানিক কলাকৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে এবং প্রচেষ্টার দ্বারা মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করা যায়। কোঁতের মতে, সমাজবিজ্ঞান পরবর্তীকালে মানুষকে প্রত্যক্ষবাদী স্তরে পৌঁছে দিবে। এ দর্শনের সমন্বিত রূপ পরিলক্ষিত হয় প্রধানত গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, জীববিদ্যা, রসায়নবিদ্যা এবং সমাজবিজ্ঞানের মাধ্যমে।

২. বিজ্ঞানসম্মত ধর্ম ও নীতিশাস্ত্র: প্রত্যক্ষবাদ ধর্মের মহান দর্শনকে ধারণ করে। প্রত্যক্ষবাদ নিজে ধর্ম না হয়েও ধর্মের কল্যাণের কথা বলে। নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে প্রত্যক্ষবাদের মূল কথা হচ্ছে অন্যের জন্য বাঁচা। প্রত্যক্ষবাদের লক্ষ্যার্জন এক্ষেত্রে দৈহিক বুদ্ধিবৃত্তিক এবং নৈতিক উৎকর্ষতার মধ্য দিয়ে অধিকতর মানবতার সেবায় নিয়োজিত থাকার কথা বলা হয়েছে।

৩. প্রত্যক্ষবাদী রাজনীতি: যুদ্ধবিরোধী এবং যুদ্ধ প্রতিহত করার রাজনীতিই হলো প্রত্যক্ষবাদী রাজনীতির মূল কথা। জোর জবরদস্তি করে মানুষকে রাজনীতিতে আনা যাবে না। এখানে ধ্বংসাত্মক কোনো কর্মকাণ্ড থাকবে না। এখানে কোনো বাধ্যবাধকতা থাকবে না। প্রত্যক্ষবাদী রাজনীতির লক্ষ্য হচ্ছে কীভাবে রাষ্ট্রের এবং সমাজের কল্যাণ করা যায়। যুদ্ধ এখানে একটাই হতে পারে যে যুদ্ধ (তোমার এবং আমার) যাবতীয় অকল্যাণকর এবং সমাজের জন্য হুমকিস্বরূপ এমন কিছুর বিরুদ্ধে। কোঁতের প্রত্যক্ষবাদ সমাজকে পুনর্গঠন করার উদ্দেশ্যে তৈরি। কিন্তু সমাজ পুনর্গঠনে এ প্রত্যক্ষবাদের ব্যবহারে তিনি সর্বপ্রকার বল অথবা তীব্র পদ্ধতি প্রয়োগের বিরুদ্ধে। কোঁৎ বলেন, মানুষকে যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে প্রত্যক্ষবাদে আসক্ত করতে হবে, জোর করে নয়।

সমালোচনা: অগাস্ট কোঁতের প্রত্যক্ষবাদ সম্পর্কিত সমালোচনাগুলো নিম্নে উপস্থাপন করা হলো: অগাস্ট কোঁৎ সমাজ বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষবাদী পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন। তিনি বলেন, প্রত্যক্ষবাদ হচ্ছে বিদ্যমান সমাজব্যবস্থার শৃঙ্খলা আনয়নে প্রগতির চর্চা। এক্ষেত্রে তিনি সমাজবিজ্ঞান চর্চার কৌশল হিসেবে পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষণ, তুলনামূলক এবং ঐতিহাসিক পদ্ধতির কথা বর্ণনা করেন। যা ঐতিহাসিকভাবে প্রয়োগযোগ্য নয়। তিনি প্রত্যক্ষবাদ সম্পর্কে অনেক বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন এবং সেগুলোকে সামাজিক শৃঙ্খলা বলে চালিয়ে দিতে গিয়ে রক্ষণশীলতার পরিচয় দিয়েছেন।

উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, অগাস্ট কোঁতের প্রত্যক্ষবাদের মূল বক্তব্য হলো ভালোবাসার নীতি, শৃঙ্খলাই ভিত্তি, প্রগতিই উদ্দেশ্য এবং নৈতিক প্রত্যক্ষবাদের সারকথা হলো অন্যের জন্য বাঁচা। তার প্রত্যক্ষবাদে বিশ্বাস করা হয় যে, মানুষ তার কাজের মাধ্যমে তার ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটাতে পারে। প্রত্যক্ষবাদ প্রত্যয়টির আলোকে অগাস্ট কোঁৎ সমাজ বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে যে মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
আপনারঅদৃশ্যমন্তব্য
Cancel