রোম্যান্টিসিজমের সংজ্ঞার্থসহ এর সাহিত্য বিচারসূত্র ব্যাখ্যা কর। অথবা, রোমান্টিকতবাদের স্বরূপ সম্পর্কে আলোচনা কর।
শিল্পসাহিত্যে রোমান্টিসিজম বা রোমান্টিকতাবাদ একটি বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি, রূপ বা ধারা যেখানে শিল্পী তার অসাধারণ কল্পনাশক্তিকে কাজে লাগিয়ে, আপন মনের গভীর অনুভূতিসঞ্জাত ভাবাবেগকে, জীবনের বাস্তবতা ও প্রাত্যহিকতাকে, তার চারপাশের ও অন্তর্দৃষ্টির বিষয়বস্তুকে বাস্তবাতীত প্রজ্ঞাস্পর্শধন্য এক অপূর্ব বস্তুতে রূপায়িত করেন তার নামই রোমান্টিকতা। রোমান্টিক কবির ভালোবাসার জগতটি অনেক বড়। কবির অনুভবের ভাবলোক সতত আবেগমণ্ডিত, মায়াময়; কখনও ঘোর লাগায় চোখে, কখনওবা বিস্ময়ে আহত করে।
'রোমান্টিক' বিশেষণ পদটি থেকে 'রোমান্টিসিজম' কথাটির সৃষ্টি। 'রোমান্টিক' শব্দটি মূলত ফরাসি 'রোমাঞ্জ' (Romanz) থেকে এসেছে; যার অর্থ 'অভিনব' (Novel)। কিন্তু ১৬৫৪ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডে শব্দটির ব্যবহার হতে থাকে, যার অর্থ 'উদ্ভট' বা 'অবাস্তব'। অষ্টাদশ শতকে ঐ অর্থের সঙ্গে রোমান্টিক শব্দটি কখনও কখনও একটা বিষণ্ণতার ভাবকেও ফুটিয়ে তুলতে ব্যবহৃত হয়েছে। আবার ১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সে এর ব্যবহার হয়েছে দু-একজনের হাতে; কিন্তু ১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দে রুশোর ব্যবহারের পরে শব্দটির প্রয়োগ খুব প্রিয় হয়ে পড়ে এবং ১৭৯৮ খ্রিস্টাব্দে 'অ্যাকাডেমি' কর্তৃক শব্দটি স্বীকৃত হয়। ম্যাডাম ডি. স্টেইল ও এ. ডাবলিউ শ্লেগেলের প্রচেষ্টায় 'Romantigue' শব্দটি সাহিত্যিক প্রবণতা বুঝাতে বহুলভাবে প্রযুক্ত হতে থাকে।
রোমান্টিসিজম হলো সৌন্দর্যের সঙ্গে অজানার যোগ সাধনের পদ্ধতির নাম। শিল্পসাহিত্যের একটা বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি এবং রূপকেই রোমান্টিক বলা হয়। কল্পনার আলোয় জীবনকে বাস্তবাতীত করে দেখার ব্যাপারটাকেই রোমান্টিসিজম বলা চলে। জীবনের আসল রূপের ওপর কল্পনার আরোপে বিচিত্র ও রহস্যময় কোনো এক চেতনার অনুসন্ধান থাকে রোমান্টিসিজমে। রোমান্টিক শব্দটি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে শ্রোতার মন একটি বিশেষ ভাবলোকে আলোড়িত হয়ে ওঠে। কতকগুলো নীহারিকাকল্প অনুভূতির সংকেত হৃদয়মনকে আবেগ আপ্লুত করে তোলে। রোমান্টিকতা সৌন্দর্যের সঙ্গে অজানার যোগ সাধন করে। শিল্পসাহিত্যের একটা বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি এবং রূপের নাম রোমান্টিকতা। জীবনের বাস্তব রূপের ওপর কল্পনার আরোপ চিত্রিতকর রহস্যময় কোনো চেতনার অনুসন্ধানের মাধ্যমে কল্পনার আলোয় জীবনকে বাস্তবাতীত করে দেখার ব্যাপারটাই রোমান্টিসিজম। শিল্প ও সাহিত্যের জগতে সবচেয়ে বড় ভাববাদী আন্দোলন হলো রোমান্টিক ভাব আন্দোলন বা রোমান্টিসিজম। আমেরিকার স্বাধীনতার যুদ্ধ ও ফরাসি বিপ্লব রোমান্টিকতার ঐতিহাসিক ভিত্তিভূমি।
ইংরেজি সাহিত্যে রোমান্টিক সময়পর্ব ১৭৮৯ থেকে ১৮৩০। এসময়ে অনেক কবি ও লেখক নানান ভাবনাচিন্তায় আপ্লুত ছিলেন। কিন্তু সবার রচনার মধ্যে সাধারণভাবে যে জিনিসটি ছিল তা হলো রোমান্টিকতা (Romanticism)। ঔপন্যাসিকদের মধ্যে নামকরা ছিলেন স্যার ওয়াল্টার স্কট ও জেনে অস্টিন, গদ্য লেখকদের মধ্যে ছিলেন ল্যাম্ব, হ্যাজলিট ও দে কুইনসে। রোমান্টিক কবিদের দুটি প্রজন্ম ছিল। প্রথম প্রজন্মের মধ্যে ছিলেন ব্লেক, ওয়ার্ডওয়ার্থ, কোলরিজ ও সাউথে; দ্বিতীয় প্রজন্মের মধ্যে ছিলেন বায়রন, শেলি, কীটস, যারা অল্প বয়সে মারা গিয়েছিলেন। রোমান্টিক যুগের বৈশিষ্ট্য রোমান্টিক পর্বের অনেক আগে থেকেই দেখা দিয়েছিল। এরা মানুষের আবেগ ও অনুভূতিকে যুক্তির ওপরে স্থান দিয়েছিলেন। যুক্তিবাদী চিন্তা, বুঝাপড়া, যা বিজ্ঞানসম্মত, পৃথিবীকে বুঝার জন্য অনুসন্ধানী, গবেষণাধর্মী চিন্তা পরিত্যাগ করে কবিতা লেখার ব্যাপারে এরা জোর দেন স্বাভাবিক প্রেরণা ও তাৎক্ষণিক অনুভূতির সহজাত উপলব্ধির ওপর। তারা কারও সংস্পর্শে এসে মানুষের মনের গভীর অনুভূতিকে আবিষ্কার করতে চেয়েছেন।
ওয়ার্ডসওয়ার্থের আত্মজীবনীমূলক প্রেলুড (১৭৯৮ থেকে লেখা, যা ১৮৫০ এ প্রকাশিত হয়) রোমান্টিকতার একটি প্রধান পাঠকৃতি বা বয়ান, যা আধুনিক মনস্তাত্ত্বিকতার দিকে নির্দিষ্ট নিশানা দেয়। নিজেকে বুঝার জন্য এরা প্রকৃতির সাহায্য নেয়। রোমান্টিকদের প্রকৃতিবিষয়ক অনেক কবিতা গবেষণার বিষয় হয়ে ওঠে। ব্যক্তির অনুভূতির মাধ্যমে তারা বস্তু, অনুভূতি ও ধারণাসমূহের বিশ্বে কবিতার সঞ্চারপথ তৈরি করতে চেয়েছেন। নিসর্গ দৃশ্যের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধগুলোর সম্পর্ক স্থাপন করতে চেয়েছেন ওয়ার্ডসওয়ার্থ, শেলি। রোমান্টিকতাকে বুঝার একটি প্রধান শব্দ হয়ে ওঠে কল্পনা। কল্পনাই মানুষের অসংলগ্ন আবেগ, অনুভূতি, স্মৃতিকে একসূত্রে গেঁথে নেয়। শব্দে গাঁথা কবিতা হয়ে ওঠে কল্পনাকে প্রকাশ করার প্রধান হাতিয়ার।
১৭৭০ খ্রিস্টাব্দের দিকে জার্মানিতে Stural and Drang (storm and strees) নামক সাহিত্যান্দোলন শুরু হয়। এ দলের নেতা ছিলেন হার্ডার, গ্যয়ঠে এবং শিলার। তারা সাহিত্য সমালোচনা, শিল্পকলা, সমাজজীবন সর্বত্র নবজীবনের জয়বার্তা শুনতে পেয়েছিলেন। যেখানে তারা ত্রুটি দেখেছেন সেখানেই তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেছেন। এদের মধ্যে গ্যয়ঠের রচনাতেই উত্তেজনার স্বল্পতা পরিলক্ষিত হয়। তারা বিদেশি সাহিত্যাদর্শের (তা সে গ্রিক অথবা ফরাসি যাহোক) হাত থেকে জার্মান সাহিত্যকে মুক্ত করার জন্য বিশেষ প্রয়াস করেছিলেন। ১৮শ শতাব্দীর শেষভাগে Schlegel এবং তার অনুজ August Wilhelm দুজনে মিলে Athenocum (১৭৯৮-১৮০০) নামক পত্রিকায় সোচ্চারে প্রচার করেন যে, "ক্লাসিক আদর্শই একমাত্র আদর্শ নয়, আধুনিক সমালোচক ও শিল্পীর সৃষ্টি ও বক্তব্য প্রাচীন ধ্রুপদী আদর্শের চেয়ে কোনো দিক দিয়েই নিন্দনীয় নয়।" তারা দুজনে জার্মান সাহিত্য ও সমালোচনাকে নিয়মকানুনের অন্ধ আনুগত্য থেকে উদ্ধার করে রোমান্টিকতার উদার আলোকে প্রতিষ্ঠিত করেন।
জার্মান সমালোচক ও নাট্যকার শ্লেগেল ক্লাসিক শব্দটির বিপরীত শব্দরূপে রোমান্টিক শব্দের প্রয়াগে করেছেন। তিনি ক্লাসিক সাহিত্যিকে যেমন ভাস্কর্যের সঙ্গে তুলনা করেছেন তেমনি রোমান্টিক সাহিত্যকে তুলিত করেছেন চিত্রকলার সঙ্গে। কোনো একটি চিত্রে আমরা যা দেখি, তা স্পষ্ট বা নির্দিষ্ট নয় চিত্রে চিত্রকর তার চারপাশের নিকট ও দূরের জিনিসগুলোকেও দেখিয়ে থাকেন। নানা রঙ ও রেখার সাহায্যে অনেক সূক্ষ্মভাবের ব্যঞ্জনা থাকে ঐ চিত্রের মধ্যে। সেরকম রোমান্টিক সাহিত্যের মধ্যেও নানা ভাববৈচিত্র্যের ব্যঞ্জনা থাকে। এখানেও সবটা স্পষ্ট নয়, অনেকখানিই কল্পনার ওপর নির্ভর করতে হয়। মোটকথা যা নভেল (অভিনব), যা রোমান্সের মতো তাই যখন মূলত রোমান্টিক তখন রোমান্সের সব লক্ষণ রোমান্টিক শব্দেও মিলবে। এজন্য রোমান্সের কল্পনা, ভাবাবিষ্টতা, বিষণ্ণতা, বিস্ময়, রহস্য প্রভৃতি বৈশিষ্ট্যগুলোও রোমান্টিক সাহিত্যের মধ্যেও লক্ষ করা যাবে। ওয়াল্টার পেটার রোমান্টিসিজমের লক্ষণ নির্ণয়ে বলেছিলেন, 'Curiosity and the love of beauty. অধ্যাপক হারফোর্ড বলেছেন, 'strangeness added to beauty'. দেখা যাচ্ছে, পেটার ও হারফোর্ড কৌতূহল, বিস্ময় ও সৌন্দর্যকেও রোমান্টিসিজমের ধর্ম বলেছেন।
উনিশ শতকের একেবারে শুরুতে ইংরেজি সাহিত্যে যে রোমান্টিক আন্দোলনের যুগক্রান্তি তার পেছনে জার্মান রোমান্টিকতার, বিশেষত শিলিং ও শ্লেগেলের ভাব উপাদানগুলোর অবদান অনস্বীকার্য। কোলরিজের সাহিত্যভাবনায় এর ছাপ স্পষ্ট। এছাড়া ছিল ফরাসি বিপ্লবের ঝড়ো প্রভাব এবং মধ্যযুগের রোমান্সের রহস্যাচ্ছন্ন স্বপ্নকুহক, স্মৃতিমেদুরতা। ফরাসি বিপ্লবের প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষ করা গিয়েছিল ওয়ার্ডওয়ার্থ, শেলি ও বায়রনের কাব্যে। সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার আহ্বানমন্ত্র আর রুশো, ভলতেয়ারের ভাবনাচিন্তা শতাব্দীর এক সন্ধিক্ষণে ইংল্যান্ডের নবীন কবিপ্রজন্মের মানসমণ্ডলে এক তোলপাড় ঘটিয়েছিল। রোমান্টিক চেতনার উন্মেষ ও রোমান্টিক - সাহিত্যের বিকাশে আর এক প্রধান প্রেরণা ছিল মধ্যযুগ। এ মধ্যযুগই ছিল নানা ধরনের রোমান্সের সূতিকাগৃহ; অ্যাডভেঞ্চার ও বীরত্ব, কল্পনামধুর প্রেমকাহিনি, অদ্ভুত ও অবাস্তব ঘটনা নিয়ে লেখা রোমান্টিক কাহিনি-কাব্য সমৃদ্ধ করেছিল ইংরেজি, ফরাসি, স্পেনীয় সাহিত্যকে।
মধ্যযুগীয় রোমান্সের রহস্যমধুর জীবনধারার প্রভাব পড়েছিল রোমান্টিক কবি-লেখকদের ওপর; কোলরিজের 'kubla khan' কিংবা কীটসের 'The Eve of st. Agnes' এর মতো কবিতা, ওয়াল্টার স্কটের ঐতিহাসিক, উপন্যাসগুলো, জার্মান কবি হাইনে ও ফরাসি লেখক Chateaubriand প্রমুখের রচনায়। হোরেস ওয়ালপোলের The Castle o otranto ও তার সতীর্থ লেখকদের গাথিক উপন্যাসে মধ্যযুগের পুনঃনির্মাণে শিহরণ সৃষ্টি হয়েছিল অতীতের ছায়াঘন স্মৃতি আর অতিপ্রাকৃত রহস্য। বাংলা সাহিত্যের ব্যক্তি চেতনার প্রধান কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত 'আত্মবিলাপ' কবিতায় যে ব্যক্তিচেতনা ও আত্মচেতনার পরিচয় দিয়েছেন তাতে বাংলা সাহিত্যের আধুনিক রোমান্টিক কবিতার আভাস পাওয়া যায়। বিহারীলাল চক্রবর্তীর কবিতায়, রবীন্দ্রনাথে এসে যার আত্মপ্রচার ঘটে আন্তর্জাতিকতায়।
রোমান্টিক সাহিত্যেই প্রথম দেখা যায় সাধারণ ও আদিম মানুষ, সভ্যতার আলোক বঞ্চিত ভালো মানুষ, চাষি এবং সমাজ যাদের নিচুতলার ঘোষণা করেছে তারা আর শিশুরা যারা সমাজের বিধিনিষেধের বেড়াজালে থাকতে বাধ্য হচ্ছে। ভূত-পেত্নি পৌরাণিক কাহিনি-উপকথা, মিথ ও স্বপ্নে দেখা ঘটনা বা বস্তু আর অহম বা আমি-র সঙ্গে জগৎসংসারের সম্পর্ক হয়ে ওঠে রোমান্টিকদের বিষয়।