সমাজবিজ্ঞান কী? সমাজবিজ্ঞানের বৈশিষ্ট্য ও পরিধি বর্ণনা কর।

সমাজবিজ্ঞান কী? সমাজবিজ্ঞানের বৈশিষ্ট্য ও পরিধি বর্ণনা কর।

"সমাজবিজ্ঞান এমনই এক বিজ্ঞান, যেখানে মানুষের যৌথ আচরণ আলোচিত হয়।"-এ উক্তির আলোকে সমাজবিজ্ঞানের সংজ্ঞার্থ ও পরিধি আলোচনা কর।

সমাজবিজ্ঞান হলো সমাজের বিজ্ঞানভিত্তিক অধ্যয়ন বা পাঠ। সমাজে সংঘবদ্ধ মানুষের জীবনযাপন প্রণালি, গতিপ্রকৃতি, মানব আচরণ, সামাজিক সম্পর্ক, নানাবিধ সংঘ, অনুষ্ঠান, প্রতিষ্ঠান, পরিবর্তন, ব্যাপ্তি ইত্যাদিসহ সমাজের সার্বিক বিষয়ে আলোচনা করে সমাজবিজ্ঞান। সমাজবিজ্ঞানের প্রকৃতি, পরিধি ইত্যাদি সম্পর্কে জ্ঞানার্জন অত্যন্ত জরুরি। সমাজবিজ্ঞানের প্রকৃতি ও পরিধিগত জ্ঞানলাভই কেবল সমাজবিজ্ঞানকে সঠিকভাবে জানতে সাহায্য করবে। 

সমাজবিজ্ঞান: সমাজবিজ্ঞানের ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো 'Sociology'। এটি ল্যাটিন শব্দ 'Socious' এবং গ্রিক শব্দ 'logos' থেকে উদ্ভব হয়েছে। 'Socious' শব্দের অর্থ সমাজ এবং 'logos' শব্দের অর্থ বিশেষ জ্ঞান বা বিজ্ঞান। অতএব 'Sociology' এর বাংলা অর্থ দাঁড়ায় সমাজ সম্পর্কিত জ্ঞান বা সমাজবিজ্ঞান। ১৮৩৯ সালে ফরাসি সমাজবিজ্ঞানী অগাস্ট কোঁৎ তার 'Positive Philosophy' গ্রন্থে প্রথম 'Sociology' শব্দটি ব্যবহার করেন। সাধারণভাবে বলা যায়, যে বিজ্ঞান সমাজের গঠনপ্রণালি ও পরিবর্তনশীল সমাজকাঠামো সম্পর্কে কার্যকারণ সম্পর্কভিত্তিক পাঠ তথা বিজ্ঞানভিত্তিক বিশ্লেষণ করে তাই সমাজবিজ্ঞান। 

প্রামাণ্য সংজ্ঞা: আমেরিকান সমাজবিজ্ঞানী ডেভিড পোপেনো তার 'Sociology' গ্রন্থে বলেন, "Sociology is the systematic and objective study of society and social behaviour." অর্থাৎ, সমাজবিজ্ঞান হলো সামাজিক আচরণের এবং সমাজের সুশৃঙ্খল ও বস্তুনিষ্ঠ অধ্যয়ন।
সমাজবিজ্ঞানের সংজ্ঞায় এল. এফ. ওয়ার্ড ও ডব্লিউ. জি. সামনার বলেন, "সমাজবিজ্ঞান হচ্ছে সমাজের বিজ্ঞান।" বিখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েবার তার 'The Methodology of the Social Science' গ্রন্থে বলেন, "সমাজবিজ্ঞান হচ্ছে সামাজিক ক্রিয়া এবং সামাজিক সম্পর্কের বিজ্ঞান।"
বিখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী ম্যাকাইভার তার 'Society: Its Structure and Changes' গ্রন্থে বলেন, "সমাজবিজ্ঞানই একমাত্র বিজ্ঞান যা সমাজ এবং সামাজিক সম্পর্ক অধ্যয়ন করে।"
সমাজবিজ্ঞানী এমিল ডুর্খেইম বলেন, "সমাজবিজ্ঞান হচ্ছে সামাজিক প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞান।" 
সমাজবিজ্ঞানী স্মলের মতে, “সমাজবিজ্ঞান সামাজিক প্রক্রিয়া সম্পর্কে অধ্যয়ন করে"। 
সমাজবিজ্ঞানের বৈশিষ্ট্য বা প্রকৃতি : সমাজবিজ্ঞানকে জানার জন্য সমাজবিজ্ঞানের প্রকৃতি সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করতে হবে। নিম্নে সমাজবিজ্ঞানের প্রকৃতি উপস্থাপন করা হলো:

১. সমাজবিজ্ঞান হচ্ছে সমাজের বিজ্ঞান: সমাজবিজ্ঞান মূলত একটি সামাজিক বিজ্ঞান। সমাজকে কেন্দ্র করেই এর উৎপত্তি ও আবর্তন। প্রাকৃতিক কোনো বিষয় নিয়ে সমাজবিজ্ঞানের কোনো আগ্রহ নেই। অর্থাৎ সমাজবিজ্ঞান শুধু সামাজিক বিজ্ঞান, প্রাকৃতিক বিজ্ঞান নয়। সমাজবিজ্ঞান বিভিন্ন সামাজিক বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করে, কোনো প্রাকৃতিক বিষয়কে নয়।

২. বস্তুনিষ্ঠ বিজ্ঞান: সমাজে কোনো প্রচলিত বিষয়ে সঠিক ও বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা করে সমাজবিজ্ঞান। আবেগতাড়িত মূল্যবোধ কিংবা পক্ষপাতিত্বপূর্ণ মান নির্ধারণ সমাজবিজ্ঞানে গ্রহণযোগ্য নয়। সামাজিক কোনো ঘটনা ঠিক যেভাবে আছে ঠিক সেভাবে উপস্থাপনই সমাজবিজ্ঞানের কাজ। অর্থাৎ সামাজিক ঘটনার বস্তুনিষ্ঠ উপস্থাপনই সমাজবিজ্ঞানের কাজ।

৩. তাত্ত্বিক বিজ্ঞান, ফলিত বিজ্ঞান নয়: সমাজবিজ্ঞান তুলনামূলকভাবে একটি তাত্ত্বিক বিজ্ঞান। কোনো বস্তু বা ঘটনার ফলাফল নিয়ে সমাজবিজ্ঞান উদ্গ্রীব নয়। ফলাফল অপেক্ষা ঘটনার ধরন, প্রকৃতি, গতিশীলতা ইত্যাদিকে সমাজবিজ্ঞানে অধিক প্রাধান্য দেওয়া হয়। 

৪. সমাজবিজ্ঞান সাধারণ বিজ্ঞান, বিশেষ বিজ্ঞান নয়: সমাজবিজ্ঞান একটি সাধারণ বিজ্ঞান, কোনো বিশেষ বিজ্ঞান নয়। কারণ, সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাপক ও সর্বজনীন। এখানে সমাজের সর্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়।

৫. সমাজতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ: সমাজ সম্পর্কিত সব বিষয়কে সমাজবিজ্ঞানীগণ সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের চেষ্টা করেন। সমাজবিজ্ঞানের প্রত্যয় বিনির্মাণে এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়াবলি ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। সামাজিক আন্তঃক্রিয়াকে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ও বৈয়াকরণের ন্যায় সমাজবিজ্ঞানীদের কাজ হলো নানা প্রকার সামাজিক কার্যক্রম ও আন্তঃক্রিয়া বিশ্লেষণ যা সম্পূর্ণ সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে নিরূপিত হয়।

৬. সমাজের বিজ্ঞান: সমাজবিজ্ঞান প্রকৃত অর্থে একটি সামাজিক -বিজ্ঞান। সমাজকে কেন্দ্র করেই এর উৎপত্তি ও আবর্তন। প্রাকৃতিক কোনো বিষয় সম্পর্কে সমাজবিজ্ঞানের কোনো আগ্রহ নেই। সমাজ, সামাজিক দল, প্রতিষ্ঠান, সম্পর্ক, সমস্যা ইত্যাদিকে ঘিরেই সমাজবিজ্ঞানের আলোচ্যসূচি করা হয়। অপরদিকে, প্রাকৃতিক বিভাগের জন্য রয়েছে পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, জীববিদ্যা, ভূবিদ্যা প্রভৃতি প্রাকৃতিক বিজ্ঞান।

৭. বস্তুনিষ্ঠ বিজ্ঞান, মান নির্ধারক বিজ্ঞান নয়: সমাজবিজ্ঞান সমাজে প্রচলিত কোনো বিষয়ে সঠিক ও বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা করে। সামাজিক কোনো ঘটনা ঠিক যা যেভাবে আছে সেভাবেই তুলে ধরা হয় সমাজবিজ্ঞানে। কেন ঘটনাটি ঘটল সে বিষয়ে সমাজবিজ্ঞানের আগ্রহ কম। এজন্যই বলা হয় সামাজিক ঘটনা সম্পর্কে 'কী' প্রশ্নের উত্তর দেয় সমাজবিজ্ঞান, কেন বা কীভাবে প্রশ্নের উত্তর এখানে অনেকটাই উপেক্ষিত হয়। যদিও বর্তমানে কল্যাণমুখী বিজ্ঞান হিসেবে বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা ও ঘটনার স্থলে কেন/কীভাবে প্রশ্নের প্রতি সমাজবিজ্ঞান ক্রমেই আগ্রহী হয়ে পড়েছে।

৮. সমাজ কাঠামো অধ্যয়ন: সমাজ কীভাবে কাঠামোবদ্ধ রূপ নেয় তা সমাজবিজ্ঞানের প্রধান আলোচ্য বিষয়। মানব সম্পর্ক আবর্তিত হয় ব্যক্তির সাথে ব্যক্তির সম্পর্ক, ব্যক্তির সাথে গোষ্ঠীর সম্পর্ক, সমাজ বা কোনো সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সম্পর্ক, সমাজ বা কোনো সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সম্পর্ক সর্বোপরি সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি, পেশাদার গোষ্ঠী, মর্যাদা গোষ্ঠী, ধর্ম ও জ্ঞাতিভিত্তিক সম্প্রদায় ইত্যাদির মধ্যকার সম্পর্কের মাঝে। এজন্য সমাজ কাঠামোকে সমাজবিজ্ঞানের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করা হয়।

৯. সাধারণ বিজ্ঞান, বিশেষ বিজ্ঞান নয়: সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাপক ও সর্বজনীন। সামাজিক প্রক্রিয়ার সবকিছুকে এর আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত করে সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে সাধারণ ও সুশৃঙ্খল ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করাই হচ্ছে সমাজবিজ্ঞানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এখানে সমাজের সর্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়। কোনো ব্যক্তিবিশেষ কিংবা একক দৃষ্টিভঙ্গিতে সামাজিক ঘটনা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ সমাজবিজ্ঞানের বৈশিষ্ট্যের পরিপন্থি।

১০. প্রায়োগিক শাস্ত্র: সমাজবিজ্ঞান একটি প্রায়োগিক শাস্ত্র যা আধুনিক সমাজবিজ্ঞানের তাত্ত্বিক আলোচনার পাশাপাশি প্রয়োগভিত্তিক, ব্যবহারিক আলোচনার গুরুত্ব দেয়। বর্তমান সূচক সংখ্যার মাধ্যমেও সংখ্যাতাত্ত্বিক উপায়ে সামাজিক ঘটনাবলির প্রকৃতি নির্ধারণ করা থাকে।

সমাজবিজ্ঞানের পরিধি: যেহেতু সমাজবিজ্ঞান হচ্ছে সমাজের পূর্ণাঙ্গ বিজ্ঞানভিত্তিক পাঠ তাই সমাজবিজ্ঞানের পরিধিও অত্যন্ত ব্যাপক। নিম্নে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:
১. সমাজতাত্ত্বিক মতবাদ: সমাজবিজ্ঞান সমাজতাত্ত্বিক মতবাদ সম্পর্কে আলোচনা করে। যেমন- সমাজবিজ্ঞান পদ, প্রত্যয়, নীতি এবং সাধারণীকরণ সম্পর্কে বিচারবিশ্লেষণ করে। সর্বোপরি বিভিন্ন Theory বা তত্ত্ব নিয়ে সমাজবিজ্ঞান আলোচনা করে থাকে।
২. ঐতিহাসিক সমাজবিজ্ঞান: ঐতিহাসিক সমাজবিজ্ঞান প্রাচীন সমাজের উদ্ভব, বিকাশ ও জীবনযাত্রা সম্পর্কে গবেষণা করে এবং বর্তমান সম্পর্কে দিকনির্দেশনা প্রদান করে। সমাজকে সঠিকভাবে জানতে হলে অবশ্যই সমাজের পূর্ব ইতিহাসকে জানতে হবে। তাই সমাজবিজ্ঞান একটি ঐতিহাসিক সমাজদর্শন।
৩. পরিবার সমাজতত্ত্ব: সমাজবিজ্ঞান পরিবারের সমাজতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করে। সমাজবিজ্ঞান এমনই এক বিজ্ঞান, যেখানে মানুষের যৌথ আচরণ আলোচিত হয়। যেমন- মানবসমাজে কীভাবে পরিবারের উৎপত্তি হয়েছে, কীভাবে এর বিকাশ ঘটেছে এসব নিয়ে এটি আলোচনা করে থাকে। যেহেতু পরিবার হলো সমাজের একটি মৌলিক ক্ষুদ্রতম একক। তাই সমাজবিজ্ঞান এটি নিয়ে আলোচনা করে থাকে।
৪. সামাজিক জনবিজ্ঞান: সমাজবিজ্ঞান সামাজিক জনবিজ্ঞান নিয়ে আলোচনা করে থাকে। যেমন- জনসংখ্যাতত্ত্ব, জনসংখ্যার কাঠামো, জনসংখ্যা বৃদ্ধি ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করে। জনবিজ্ঞানের আলোচনার মাধ্যমে সমাজবিজ্ঞান পূর্ণতা লাভ করে।
৫. গ্রামীণ ও নগর সমাজতত্ত্ব: সমাজবিজ্ঞান গ্রামীণ ও নগর সমাজতত্ত্বে গ্রামীণ জীবন ও নগর জীবন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করে। কারণ গ্রামীণ সমাজ ও শহুরে সমাজ কাঠামো এক নয়। গ্রামীণ সমাজব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য এবং শহুরে সমাজব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য ভিন্ন ভিন্ন। যে কারণে উভয় সমাজকে বুঝতে হলে আলাদা আলাদা আলোচনা আবশ্যক।
আপনারঅদৃশ্যমন্তব্য
Cancel