সৃষ্টি ও বিবর্তনের মধ্যে পার্থক্য দেখাও। হেনরি বার্গসোঁর সৃজনমূলক বিবর্তনবাদ ব্যাখ্যা কর।
দর্শনের যেসব আলোচনা করা হয় তার মধ্যে সৃষ্টিবাদ ও বিবর্তনবাদ অন্যতম। সৃষ্টিবাদ মনে করে জগৎ সৃষ্ট। আর বিবর্তনবাদ মনে করে জগৎ সৃষ্ট নয়; বরং তা ক্রমবিবর্তনের মাধ্যমে বর্তমান অবস্থায় এসেছে। যার কারণে উভয় মতবাদের মধ্যে পার্থক্য সূচিত হয়েছে। সৃষ্টিবাদ ও বিবর্তনবাদ মতবাদ দুটি বিপরীতধর্মী মতবাদ। বার্গসোঁর সৃজনমূলক বিবর্তনবাদ মূলত যান্ত্রিক ও উদ্দেশ্যমূলক বিবর্তনবাদের সমালোচনার মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে। বার্গসোঁ তার সৃজনমূলক বিবর্তনবাদে বলেন, জগৎ এক পরিবর্তনের রাজ্য, গতি বা পরিবর্তনই জগতের রীতি এবং জগতের একমাত্র সত্য।
সৃষ্টিবাদ ও বিবর্তনবাদের মধ্যে পার্থক্য: সৃষ্টিবাদ ও বিবর্তনবাদের
মধ্যে পার্থক্য জানার আগে আমাদের সৃষ্টিবাদ ও বিবর্তনবাদের সম্পর্কে জানতে হবে।
সৃষ্টিবাদ: "According to the theory of special creation,
the world with all its different kinds of beings was created all at once by the supreme being, God." [Dr. Abdul Matin : An Outline of Philosophy. P- 147] যে মতবাদ মোতাবেক স্রষ্টা কোনো এক সময়ে নিজের এক বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের নিমিত্তে জগৎ সৃষ্টি করেছেন তাকে সৃষ্টিবাদ বলে। সৃষ্টিবাদীরা ঈশ্বরকে অনাদি, অনন্ত, সর্বশক্তিমান, সর্বজ্ঞ ও. সর্বগুণে গুণান্বিত মনে করেন। তাদের মতে, ঈশ্বরের কোনো অভাব অভিযোগ বা কোনো ধরনের সীমাবদ্ধতা নেই। তবুও কোনো এক বিশেষ মুহূর্তে স্বীয় ইচ্ছার বশবর্তী হয়ে নিজ ক্ষমতাবলেই তিনি এ জগৎ সৃষ্টি করেছেন। গ্রহ, উপগ্রহ, নক্ষত্র, বিভিন্ন ধরনের উদ্ভিদ এবং প্রাণীতে পূর্ণ পৃথিবী প্রথমে যেভাবে সৃষ্টি হয়েছিল আজও ঠিক একইভাবে আছে।
বিবর্তনবাদ: "According to the theory of evolution, the world with its various types of beings has come out of an originally simpler condition through long process of gradual transformation." বিবর্তনবাদ জগতের উৎপত্তি ও বিকাশসম্পর্কীয় একটি মতবাদ। বিবর্তন শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ 'Evolution'। ইংরেজি 'Evolve' শব্দটি ল্যাটিন শব্দ 'Evolvere' থেকে গৃহীত। বিবর্তন অর্থ উন্মোচন করা, বিকশিত করা, প্রকাশিত করা বা মেলে ধরা। বিবর্তনবাদ বলতে বিশ্বের ক্রমবিকাশ বা পরিবর্তনকে বুঝায়। বিশ্বজগৎ পরিবর্তনশীল। বিবর্তনবাদ এমন একটি মতবাদ, যার মাধ্যমে জগৎ এবং অন্যান্য যাবতীয় প্রাণী ও বস্তু অভ্যন্তরীণ শক্তির সাহায্যে সহজ ও সরল অবস্থা থেকে ক্রমপরিবর্তনের ধারায় বর্তমান জটিল অবস্থায় উপনীত হয়েছে। এ পরিবর্তন হলো সহজ থেকে জটিল, সাদৃশ্য ও সমজাতীয় অবস্থা থেকে বৈসাদৃশ্য ও ভিন্ন জাতীয় সুসংবদ্ধ অবস্থায় পরিবর্তন।
নিম্নে সৃষ্টিবাদ ও বিবর্তনবাদের মধ্যে পার্থক্য আলোচনা করা হলো:
প্রথমত, সৃষ্টিবাদের পিছনে কোনো বৈজ্ঞানিক যুক্তি বা প্রমাণ নেই। সৃষ্টিবাদের ভিত্তি হলো বিশ্বাস। অন্যদিকে, বিবর্তনবাদ বৈজ্ঞানিক মতবাদ। বিবর্তনবাদ বিভিন্ন বিজ্ঞান থেকে মতের সপক্ষে যুক্তি এবং প্রমাণের অবতারণা করেছে।
দ্বিতীয়ত, সৃষ্টিবাদের পরিধি সংকীর্ণ। এটি একটি রক্ষণশীল মতবাদ। পক্ষান্তরে, বিবর্তনবাদের পরিধি ব্যাপক। এটি একটি প্রগতিশীল মতবাদ।
তৃতীয়ত, সৃষ্টিবাদে নিরপেক্ষ ও সাপেক্ষ এ দুটি রূপ আছে। অপরদিকে, বিবর্তনবাদে যান্ত্রিক, উদ্দেশ্যমূলক, সৃজনমূলক ও উন্মেষমূলক এ চারটি রূপ আছে।
চতুর্থত, ধর্মীয় গ্রন্থসমূহ সৃষ্টিবাদকে সমর্থন করে। সৃষ্টিবাদে ঈশ্বরের প্রকৃতি প্রকাশ পায়। অপরপক্ষে, বিজ্ঞান ও দর্শনে বিবর্তনবাদের অধিক সমর্থন রয়েছে। বিবর্তনবাদে বস্তুর প্রকৃতি প্রকাশ পায়।
হেনরি বার্গসোঁর সৃজনমূলক বিবর্তনবাদ: হেনরি বার্গসোঁর বিবর্তনবাদ যান্ত্রিক ও উদ্দেশ্যমূলক বিবর্তনের সমালোচনার মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে। বার্গসোঁর মতে, বিবর্তন প্রক্রিয়া যান্ত্রিকও নয় উদ্দেশ্যমূলকও নয়; বরং স্বাধীন ও সৃজনধর্মী। বার্গসোঁর মতে, জগৎ এক পরিবর্তনের রাজ্য, অন্যকথায় জগৎ মানেই পরিবর্তন। এই পরিবর্তনকে তিনি গতির সাথে তুলনা করেছেন। তার মতে, জগৎ হচ্ছে গতি এবং গতি হচ্ছে জগৎ। কেননা গতিই জগতের একমাত্র মূল বৈশিষ্ট্য। আর তিনি এই গতির নাম দিয়েছেন 'প্রাণপ্রবাহ' বা 'কালপ্রবাহ'।
গতি বা কাল হচ্ছে জগতের প্রকৃত রূপ এবং দেশ বা স্থিতি হচ্ছে সত্তা সম্পর্কে আমাদের অজ্ঞানতার ফল। প্রাণ যেমন চঞ্চল ও গতিশীল, কালও তেমনি গতিশীল। প্রাণ ও কাল স্বরূপত এক এবং এই প্রাণ বা কাল প্রবাহের অস্তিত্ব রয়েছে। এই প্রবাহ বা গতিই জগতের প্রধান বৈশিষ্ট্য। প্রাণপ্রবাহ হলো জগতের পরমতত্ত্ব। এই প্রাণপ্রবাহ একান্তই বাধাবন্ধনহীন। এ কোনো নিয়ন্ত্রণ বা পরিকল্পনার ধার ধারে না; কেবল চলার পথে নিত্যনূতন জিনিসের সৃষ্টি করাই বিবর্তনের প্রধান বৈশিষ্ট্য। সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবে এখানেই যান্ত্রিক ও উদ্দেশ্যমূলক বিবর্তনের সাথে তার বিরোধ নিম্নে হেনরী বার্গসোঁর সৃজনমূলক মতবাদ সম্পর্ক বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:
যান্ত্রিক বা আধ্যাত্মিক জগৎ সত্তার আজ্ঞাধীন নয়: সৃজনমূলক বিবর্তনবাদ
অনুসারে বিবর্তন প্রক্রিয়া এক অনিয়ন্ত্রিত অভবিষ্যদ্বাণীসূচক ও সৃজনধর্মী প্রক্রিয়া। এই মতানুসারে যেহেতু বিবর্তন প্রক্রিয়া মুক্ত ও স্বাধীন, সেহেতু এই প্রক্রিয়া কোনো যান্ত্রিক নিয়ম বা আধ্যাত্মিক জগৎ সত্তার আজ্ঞাধীন হতে পারে না। এই মতবাদ মনে করে যে, যান্ত্রিক বিবর্তনবাদ ও উদ্দেশ্যমূলক বিবর্তনবাদ হচ্ছে অযৌক্তিক মতবাদ। বার্গসোঁর মতে, যান্ত্রিকবাদ ও উদ্দেশ্যবাদ দুই-ই বিবর্তনের স্বাধীন ও সৃজনধর্মী প্রক্রিয়ার ওপর আরোপ করে এক অযাচিত নিয়ন্ত্রণ। যান্ত্রিক মতবাদ মনে করে যে বিবর্তন প্রক্রিয়ায় কোনো বস্তুর পরিবর্তন তার আগেই কোনো ঘটনার ওপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ বিবর্তন প্রক্রিয়ায় পরবর্তী স্তর পূর্ববর্তী স্তরের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।
বিবর্তন প্রক্রিয়া স্বাধীন ও সৃজনমূলক: এই সমস্যা সমাধানের জন্য
বার্গসোঁ তার সৃজনমূলক বিবর্তনবাদ প্রবর্তন করেছিলেন। যার প্রাণ হচ্ছে এক প্রাণপ্রবাহ। এই প্রাণপ্রবাহের গতিকে কেউ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। জৈবিক বিবর্তনের ক্ষেত্রে পূর্ব থেকে জীবের ক্রিয়া সম্পর্কে কিছু বলা সম্ভব নয়। তার মতে, বিবর্তন প্রক্রিয়া পুনরাবৃত্তিমূলক নয়, কেননা পরবর্তী স্তর পূর্ববর্তী স্তরের নিছক পুনরাবৃত্তি নয়। অর্থাৎ পরবর্তী স্তর পূর্ববর্তী স্তরের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়; বরং এটি স্বাধীন ও সৃজনমূলক। একই প্রাণপ্রবাহ থেকে সৃষ্টি হচ্ছে জড়বস্তু, প্রাণ, মন ইত্যাদি বস্তু। প্রাণপ্রবাহ নিয়ত পরিবর্তিত হয়ে নতুন নতুন জিনিসের সৃষ্টির দ্বারা নিজেকে সমৃদ্ধিশালী করে। নব নব সৃষ্টির পথে প্রাণপ্রবাহ থেকে এক বিপরীত শক্তির সৃষ্টি হয় এবং এই বিপরীত শক্তি থেকেই জড়ের সৃষ্টি হয়ে থাকে। বস্তুত প্রাণ হচ্ছে গতি, জড় হচ্ছে বিপরীত গতি।
বিবর্তন অপূর্বনির্ধারিত ও অভবিষ্যদ্বাণী সূচক: জগতের সৃষ্টির
পশ্চাতে এই যে প্রাণপ্রবাহ, তা হচ্ছে এক আধ্যাত্মিক সত্তা কেননা প্রাণের সৃষ্ট মুহূর্তগুলোকে আলোকিত করার জন্য চেতনা হচ্ছে একটা স্বয়ং আলোক। এই আধ্যাত্মিক সত্তার স্বরূপ বুদ্ধির মাধ্যমে জানা যায় না। একমাত্র স্বজ্ঞার মাধ্যমে জানতে হয়। এই প্রাণপ্রবাহ কেবল সৃষ্টি করে যায় কিন্তু সৃষ্টির আগের মুহূর্তেও এ জানে না যে, এ কী সৃষ্টি করতে চায়। যেমন- চক্ষুহীন প্রাণীর চোখ উন্মোচিত হওয়ার পূর্ব মুহূর্তেও এ বুঝতে পারে না এর কীসের প্রকৃত অভাব। যখন চোখ উন্মোচিত হয় তখনই এ বুঝতে পারে, এর কী অভাব ছিল। আর সেজন্যই বিবর্তন অপূর্বনির্ধারিত ও অভবিষ্যদ্বাণী সূচক।
উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে,
হেনরি বার্গসোঁর সৃজনমূলক বিবর্তনবাদ বিবর্তন প্রক্রিয়ার যথার্থ ব্যাখ্যা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। তিনি তার মতবাত। বুদ্ধির পরিবর্তে স্বজ্ঞাকে প্রাধান্য দিয়েছেন। কিন্তু বিজ্ঞান ও দর্শনে বুদ্ধির প্রাধান্যই যথার্থ। তবে তাই বলে বিবর্তন সম্পর্কে বার্গসোঁর মতবাদ একেবারে নিরর্থক নয়। দর্শনে বার্গসোঁর সৃজনমূলক বিবর্তনবাদের একটি বিশেষ স্থান রয়েছে। তার এ সৃজনমূলক বিবর্তনবাদ বিবর্তনের ইতিহাসে এক অপূর্ব ও অভিনব সংযোজন।