তুলনামূলক সাহিত্যবিচারের বৈশিষ্ট্যসহ এ পদ্ধতির গুরুত্ব পর্যালোচনা কর। অথবা, তুলনামূলক সাহিত্য সমালোচনা পদ্ধতির বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা কর।
তুলনামূলক সমালোচনা একটি আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি জাত পদ্ধতি। এক দেশের সাহিত্যের সঙ্গে অন্য দেশের সাহিত্যের তুলনা করে সাহিত্যকর্মে যে বিচার করা হয় তাই তুলনামূলক সমালোচনা পদ্ধতি নামে অভিহিত। এখানে রচনা বিচারের ক্ষেত্রে প্রাচ্য সাহিত্যের, পাশ্চাত্য সাহিত্যের কিংবা প্রাচ্য বা প্রতীচ্য সাহিত্যের প্রভাবের পরিমাণ তুলনার দ্বারা স্পষ্ট করে দেখানো হয়। Objectivity এখানে থাকলেও আবাসন ব্যাপারটি যুক্ত না করলে এ পদ্ধতি যান্ত্রিক হয়ে ওঠার সম্ভাবনা। তাছাড়া দেশকাল ইতিহাস সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পরিচয়ও এখানে থাকা প্রয়োজন।
তুলনামূলক সমালোচনা অপেক্ষাকৃত আধুনিক বিচারপদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে দেশীয় সাহিত্যের সঙ্গে পাশ্চাত্য সাহিত্যের অথবা একালের সঙ্গে প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যের তুলনার দ্বারা আলোচ্য রচনাকে স্বতন্ত্র ও স্পষ্ট করে তোলা এবং আলোচ্য রচনায় প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য অথবা পাশ্চাত্য সাহিত্যের প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ প্রভাব কোথায় রয়েছে তার অনুসন্ধান করে বের করা হয়। মিনতি কুমার রায় বলেছেন, এ পদ্ধতিতে দেশকালের সীমা সংকুচিত হয়ে এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের নৈকট্য বাড়ছে। মানব হৃদয়ের আদানপ্রদানের দ্বারা সৌহার্দের সৃষ্টি হচ্ছে। সোমা মুখোপাধ্যায় বলেছেন, তুলনামূলক সাহিত্য পঠন পদ্ধতি একটি বিশেষ ভাষা সাহিত্যের মধ্যে বিভিন্ন ধারাকে করে তুলেছে নিয়মবদ্ধ। যে নিয়ম আমাদের বুঝতে সাহায্য করছে।
তুলনামূলক সমালোচনা পদ্ধতির একটি ভিন্ন দিক নির্দেশ করেছিলেন ম্যাথু আর্নল্ড। তিনি বিভিন্ন লেখক ও কবির শব্দ সম্পদ ও পঙ্ক্তির তুলনামূলক বিচারে উভয়ের শ্রেষ্ঠত্ব বা কৃতিত্ব নির্ণয়ের চেষ্টা করেছেন। একথা অবশ্যই সত্য যে, তেমন রসবোধ থাকলে এভাবে কিছু সমসমতাসম্পন্ন পঙ্ক্তি পাশাপাশি নিয়ে তুলনামূলক বিচার করা সম্ভব। কিন্তু প্রথমত, আর্নল্ড এরকম তুলনীয় পঙ্ক্তি নির্বাচনের কোনো সুস্পষ্ট পথনির্দেশ দিতে পারেননি। দ্বিতীয়ত এবং সবচেয়ে বড় কথা, কোনো মহৎ কাব্যের একটি দুটি পঙ্ক্তি উদ্ধার করে তার সঙ্গে অন্য কোনো মহৎ কাব্যের মিল দেখানো অর্থহীন, কারণ দুটি চারটি পঙ্ক্তির সাহায্যে একটি প্রথম শ্রেণির সৃষ্টির প্রায় কোনো পরিচয়ই পাওয়া যায় না। সামগ্রিকভাবে তুলনা করলে তবু কিছুটা বুঝা সম্ভব। অথচ ম্যাথু আর্নল্ডের এ পদ্ধতি বাংলা সমালোচনা সাহিত্যে মোটামুটিভাবে গৃহীত হয়েছে। মধুসূদনের 'মেঘনাদবধ কাব্য' এর ওপর বিদেশি প্রভাব বা বিদেশি কাব্যের সঙ্গে এর সাদৃশ্য দেখানোর জন্য কাহিনি পরিকল্পনা, কবিদের মানসিকতা অপেক্ষা আমাদের অনেক বেশি পছন্দ সমজাতীয় পঙ্ক্তি ভাষায় মিল থাকলে সমালোচক হিসেবে আমরা আরও বেশি আত্মতৃপ্তি বোধ করি। তুলনামূলক সমালোচনা পদ্ধতির বৈশিষ্ট্যসমূহ হলো:
১. তুলনামূলক আলোচনায় সমালোচকদের প্রবণতা অনুসারে দুই দেশের গ্রন্থের মধ্যে সাদৃশ্য বা বৈসাদৃশ্য বিচারবিশ্লেষণ হয়। তুলনামূলক আলোচনার সূত্রে একটির সাহায্যে অপরটিকে বুঝা যায়, এক দেশের সঙ্গে অপর দেশের চরিত্রগত সাদৃশ্য বা বৈপরীত্যও লক্ষ করা যায়।
২. তুলনামূলক সমালোচনা পদ্ধতিতে সাহিত্যবিচারে দেশীয় সাহিত্যের সঙ্গে পাশ্চাত্য সাহিত্যের অথবা একালের সঙ্গে প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যের তুলনা দ্বারা আলোচ্য রচনাকে স্বতন্ত্র ও স্পষ্ট করে তোলা হয় এবং আলোচ্য রচনায় প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য অথবা পাশ্চাত্য সাহিত্যের প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ প্রভাব কোথায় রয়েছে তার অনুসন্ধান করে বের করা হয়।
৩. তুলনাপ্রবণ সাহিত্য আলোচনার একটি আদরণীয় বিপদের দাহ টের পেয়েছিলেন বুদ্ধদেব বসু। কোনো সুরম্য দৃশ্য চোখের সামনে দেখতে পেয়েও জানিয়েছিলেন বুদ্ধদেব, তার মনে পড়ে যেত বিশ্বসাহিত্যের কোনো অংশ, যেখানে সে দৃশ্যটির সহমর্মী উচ্চারণ রয়েছে। সেই বিশেষ দৃশ্যের নিজস্ব সৌন্দর্য অনুভবের সুযোগ আহত হতো। এটিই তুলনামনস্ক সাহিত্য পাঠের সুফল। কিন্তু সাধারণত যেভাবে দুটি ভিন্ন ভাষার সাহিত্য পাশাপাশি রেখে দাগ দিয়ে দিয়ে তুলনা দেখানো হয়, সেটি বিদ্যাচর্চার এ ধারাটি সম্পর্কে অনেককেই সংশয়ী করে তুলেছে।
৪. যেকোনো জাতির শিল্প ও সাহিত্য যদি তাদের জীবনের প্রতিচ্ছবি হয় তাহলে তুলনামূলক সাহিত্যকে বলতে হবে সারা বিশ্বের জাতিগোষ্ঠীর মন মানস, জীবনাচরণ, চিন্তা দর্শন ও তাদের জীবনযাপন পদ্ধতির নিখুঁত দর্পণ। যেখানে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর অবস্থা, তাদের উন্নয়ন, সমৃদ্ধি অর্জন এবং সাহিত্যের সুনিপুণ একটি চিত্র রূপায়িত ও প্রতিবিম্বিত হয়।
৫. তুলনামূলক সমালোচনা পদ্ধতিতে বিভিন্ন দেশের সাহিত্য সংস্কৃতির পারস্পরিক যোগাযোগ এ সমালোচনা পদ্ধতির পথ করে দিয়েছে।
৬. নিজের জাতীয় সাহিত্যকে যথাযথভাবে জানতে, চিনতে হলে ও বিশ্বসাহিত্য থেকে রসাস্বাদন করতে হলে তুলনামূলক সাহিত্য অধ্যয়নের বিকল্প নেই। তুলনামূলক সাহিত্য অধ্যয়নের মাধ্যমেই জানা যাবে আমাদের জাতীয় সাহিত্যের প্রকৃত অবস্থা। তেমনিভাবে জানা যাবে পৃথিবীর বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সাহিত্যের প্রকৃত অবস্থাও।
৭. আধুনিক সাহিত্য অঙ্গনের অতি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ তুলনামূলক সাহিত্য পৃথিবীর বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সাহিত্যের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি অর্জনের ক্ষেত্রে অন্য সাহিত্য দ্বারা কতটুকু প্রভাবিত হয়েছে, কতটুকু অন্য সাহিত্য থেকে নিয়েছে এবং নিজেদের জাতীয় সাহিত্য পৃথিবীর অন্যান্য জাতির সাহিত্যের উন্নয়নে কতটুকু অবদান ও ভূমিকা রেখেছে সে ব্যাপারে অবগত হওয়ার ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা রাখে।
৮. ফরাসি সাহিত্য সমালোচক 'ফিল্মান' তুলনামূলক সাহিত্যকে বলেছেন, প্রত্যেক দেশ অন্য দেশের সাহিত্য থেকে চৌর্যবৃত্তির মাধ্যমে যা গ্রহণ করেছে তারই অনুসন্ধান। অর্থাৎ সাহিত্যের যে শাখায় সাহিত্যের বিষয়বস্তু ও উপাদানসমূহ পরস্পরের মাঝে আদানপ্রদান ও দেওয়া নেওয়া সম্বন্ধে আলোচনা করা হয় তাই হলো তুলনামূলক সাহিত্য।
৯. ফ্রান্সে তুলনামূলক সমালোচনা পদ্ধতি নিজের জায়গা করে নেয় রক্ষণশীল ও প্রগতিবাদী দলের এবং অনুকরণ ও মৌলিকতার দ্বন্দ্ব ও বিতর্কের মধ্য দিয়ে।
১০. জাতি এবং মানবপ্রকৃতির মনস্তত্ত্বের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হলো তুলনামূলক সাহিত্যের কাজ।
১১. তুলনামূলক সমালোচনা পদ্ধতি তথ্য (আলোচনা, অনুবাদ, প্রভাব) সংগ্রহের ঊর্ধ্বে গিয়ে বিশেষ সময়ে বিশেষ লেখকের উপস্থিতি সাহিত্যিক প্রেরণা ও প্রতি গ্রহণের বিভিন্ন উপাদান ও তাদের উপস্থিতির কারণকে নিজের বিচার্য বিষয় করে তোলে।
১২. এক ভাষিক পরিস্থিতি থেকে যখন বহুভাষিক পরিস্থিতির মুখোমুখি হই, তখন তুলনামূলক সমালোচনা পদ্ধতি হয়ে ওঠে অনিবার্য।
১৩. লিখিত ও মৌখিক সাহিত্যের পারস্পরিক সম্পর্ক, আদানপ্রদান, শৈলী, বর্গগত অবস্থান আলোচিত হয় তুলনামূলক সমালোচনা পদ্ধতিতে। কেবল বিষয়গত সাদৃশ্য নয়, বর্গ, শৈলীগত তুলনাও এ সমালোচনার বিবেচ্য বিষয়।
১৪. কেবল সামাজিক, মনস্তাত্ত্বিক পরিকাঠামোর মধ্যে নয়, আদানপ্রদান ও প্রতি গ্রহণের জটিল কিন্তু সদা চলনশীল কার্যকারণের ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে সাহিত্যের সারস্বত চিরন্তনতার বদলে এক বহুধা বিভক্ত আত্মতাকে বুঝার চেষ্টা করে তুলনামূলক সমালোচনা পদ্ধতি।
১৫. তুলনামূলক সাহিত্য সমালোচনা পদ্ধতি একটি বিশেষ ভাষা সাহিত্যের মধ্যে বিভিন্ন ধারাকে করে তুলে নিয়মবদ্ধ। যে নিয়ম আমাদের বুঝতে সাহায্য করছে কেন বিশেষ এক সাহিত্যকার প্রাচীন বা নবীন, দেশি বা বিদেশি সাহিত্যিক ঐতিহ্য থেকে কোনো কাহিনিকে করে তুলেছেন তার সাহিত্যের বিষয়।
১৬. তুলনামূলক সমালোচনা পদ্ধতিতে দেশকালের সীমা সংকুচিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন দেশকালের সাহিত্যে অখণ্ড মানবসত্যকে খুঁজে বের করার চেষ্টাতে এগিয়ে এসেছে।
১৭. তুলনামূলক সমালোচনা পদ্ধতিতে তুলনার মাধ্যমে তুলনীয় সাহিত্যগুলোর চরিত্র বৈশিষ্ট্য এবং রীতিপদ্ধতিও স্পষ্ট হয়ে এসেছে।
১৮. তুলনামূলক সমালোচনা পদ্ধতিতে ধারণা বা Concept ভিত্তিক, সাহিত্য শাখাভিত্তিক, ঐতিহাসিকভিত্তিক, সামাজিকভিত্তিক, রূপভিত্তিক বা রাজনীতিভিত্তিক যেকোনো পদ্ধতিতেই তুলনামূলক বিচার সম্ভব। সেদিক থেকে সব পদ্ধতিরই একটি করে তুলনামূলক আলোচনার শাখা থাকতে পারে।
১৯. তুলনামূলক সমালোচনা পদ্ধতিতে শিল্পের একটি শাখা সাহিত্য অন্য শাখা চিত্রকলার সঙ্গে তুলনীয় হতে পারে। কাব্য ও সংগীত পারস্পরিক তুলনায় নিজেদের চরিত্র বৈশিষ্ট্য ফুটিয়ে তুলতে পারে।
তুলনামূলক আলোচনার মাধ্যমে নানা দেশের সাহিত্য ও রচনাকারের অপরিচয়ের ব্যবধান ঘোচানো সম্ভব হয়, তাতে সন্দেহ নেই। মানসিক সংকীর্ণতা দূর করার জন্য আধুনিককালে তুলনামূলক সমালোচনার প্রভাব বর্ধিত হচ্ছে। এর ফলে এক দেশের পাঠক অন্য দেশের ভাষা শিখতে প্রলুব্ধ হবে, অপরের প্রতি প্রতিকূল মনোভাব হ্রাস পাবে। তাই আজকাল তুলনামূলক সাহিত্য পাঠ ও মূল্য বিচার মার্জিত বুচির লক্ষণ বলে পরিগণিত হয়।