তুলনামূলক সমালোচনার পদ্ধতি, প্রবণতা ও পরিধির পরিচয় দাও। অথবা, তুলনামূলক সাহিত্য সমালোচনা পদ্ধতির পরিধি আলোচনা কর।

তুলনামূলক সমালোচনার পদ্ধতি, প্রবণতা ও পরিধির পরিচয় দাও। অথবা, তুলনামূলক সাহিত্য সমালোচনা পদ্ধতির পরিধি আলোচনা কর।
তুলনামূলক সমালোচনা একটি আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি জাত পদ্ধতি। এক দেশের সাহিত্যের 0সঙ্গে অন্য দেশের সাহিত্যের তুলনা করে সাহিত্যকর্মে যে বিচার করা হয় তাই তুলনামূলক সমালোচনা পদ্ধতি নামে অভিহিত। এখানে রচনা বিচারের ক্ষেত্রে প্রাচ্য সাহিত্যের, পাশ্চাত্য সাহিত্যের কিংবা প্রাচ্য বা প্রতীচ্য সাহিত্যের প্রভাবের পরিমাণ তুলনার দ্বারা স্পষ্ট করে দেখানো হয়। Objectivity এখানে থাকলেও আবাসন ব্যাপারটি যুক্ত না করলে এ পদ্ধতি যান্ত্রিক হয়ে ওঠার সম্ভাবনা। তাছাড়া দেশকাল ইতিহাস সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পরিচয়ও এখানে থাকা প্রয়োজন।

দেশীয় সাহিত্যের সঙ্গে বিদেশি সাহিত্যের অথবা আধুনিক সাহিত্যের সঙ্গে প্রাচীন সাহিত্যের তুলনার মাধ্যমে সাহিত্যকর্মের মূল্যায়ন এবং একটি সাহিত্যকর্মে দেশীয় অথবা বিদেশি সাহিত্যের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাব কোথায়, কীভাবে পড়েছে তার অনুসন্ধান তুলনামূলক সমালোচনা পদ্ধতির লক্ষ্য। তুলনামূলক সাহিত্য সমালোচনার প্রবর্তক জন ড্রাইডেন। এরপরে ম্যাথু আর্নল্ড এ পদ্ধতিকে আরও যুক্তিনির্ভর করে তোলেন। তার মতে, একজন সমালোচককে আধুনিক ও প্রাচীনকালের ভাবনা ও প্রকাশ সম্পর্কে অবহিত থাকতে হবে; অবহিত হতে হবে তার নিজের ভাষা ও প্রতিবেশের বাইরে অন্যান্য ভাষা ও প্রতিবেশ সম্পর্কেও এবং এর পরিধি যত বিস্তৃত করা যায় ততই মঙ্গল। একই সঙ্গে একাধিক সাহিত্য সৃষ্টির তুলনামূলক বিচারবিশ্লেষণ ও মূল্যায়নই তুলনামূলক সাহিত্য সমালোচনা।

তুলনামূলক সাহিত্য সমালোচনা পদ্ধতির সাহিত্যবিচার একই ভাষায় রচিত সমধর্মী সাহিত্য সৃষ্টি নিয়ে হতে পারে, আবার বিভিন্ন ভাষার সাহিত্যও এর অবলম্বন হতে পারে। শুধু সাহিত্যের মানগুণ নয়, একাধিক সাহিত্য, একই ভাষায় অথবা বিভিন্ন ভাষায় রচিত, সৃষ্টির বর্ণিত যুগ, কাল বা প্রতিবেশও এ পদ্ধতির সাহিত্যবিচারের বিষয় হতে পারে। তুলনাশ্রয়ী সাহিত্যবিচার পাঠকের সাহিত্য রসাস্বাদনের ক্ষমতাকে সজাগ ও তীক্ষ্ণ করে এবং তার অনুভূতির ক্ষেত্র সম্প্রসারিত ও সমৃদ্ধতর করে তোলে।

উনিশ শতকে বাংলা সমালোচনা সাহিত্যের ধারায় পাশ্চাত্য প্রভাব স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। প্রকৃতপক্ষে তখন থেকেই তুলনামূলক পদ্ধতির সাহায্যে সাহিত্যবিচারের সার্থক সূত্রপাত। এ জাতীয় সমালোচনা পদ্ধতি মূলত দুটি উদ্দেশ্যের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতো। প্রথমত, সমালোচক দেশীয় সাহিত্যের সঙ্গে পাশ্চাত্য সাহিত্য অথবা একালের সঙ্গে প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যের তুলনার মাধ্যমে মূল রচনার বিষয়বস্তু ও লেখকের মনোভাব স্বচ্ছ করে তুলতেন। দ্বিতীয়ত, কোনো একটি বিশেষ রচনায় প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য অথবা পাশ্চাত্য রচনার প্রভাব কীভাবে প্রতিফলিত হয়েছে, তা নিয়েও বিস্তৃত অনুসন্ধানে নিয়োজিত হতেন সমালোচক। 

প্রথম উদ্দেশ্য দ্বারা চালিত হয়েছিলেন স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্র। আলংকারিকদের বিশ্লেষণী দৃষ্টিভঙ্গি বর্জন করে তিনি সাহিত্যের সামগ্রিকতার মধ্যে নান্দনিকতার সন্ধান পেতে চেয়েছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্র এ প্রেরণার বশবর্তী হয়েই 'উত্তরচরিত' থেকে স্বদেশি পন্থা বর্জন করে পাশ্চাত্য সমালোচনারীতির অনুসরণ করতে শুরু করেছিলেন। জয়দেবের সঙ্গে বিদ্যাপতি, কালিদাসের 'কুমারসম্ভব' কাব্যের সঙ্গে মিল্টনের 'প্যারাডাইস লস্ট', কিংবা শেকসপিয়রের নায়িকা মিরন্দা-দেসদিমোনার সঙ্গে শকুন্তলা চরিত্রের তুলনায় উৎসাহী হয়েছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র। বস্তুত 'প্রাচীন সাহিত্য' গ্রন্থের একাধিক নিবন্ধে বঙ্কিমের জোরালো সমালোচনা রবীন্দ্রনাথকেও প্রভাবিত করেছে। অন্যদিকে, কবি মধুসূদন বাংলা সাহিত্যে তার রচনাধারার অভিনবত্ব বুঝাতে চিঠিপত্রে হোমারের ইলিয়াড, মিল্টন এবং শেকসপিয়রের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন। এ প্রসঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্রের বিদ্যাপতি ও জয়দেবের তুলনামূলক বিচারের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। যেমন: "বঙ্গীয় গীতিকাব্য লেখকদিগকে দুই দলে বিভক্ত করা যাইতে পারে। একদল, প্রাকৃতিক শোভার মধ্যে মনুষ্যকে স্থাপিত করিয়া তৎপ্রতি দৃষ্টি করেন; আর একদল, বাহ্য প্রকৃতিকে দূরে রাখিয়া কেবল মনুষ্যহৃদয়কেই দৃষ্টি করেন। ... প্রথম শ্রেণির প্রধান জয়দেব, দ্বিতীয় শ্রেণির মুখপাত্র বিদ্যাপতিকে ধরিয়া লওয়া যাউক। ... জয়দেবাদিতে বহিঃপ্রকৃতির প্রাধান্য, বিদ্যাপতি প্রভৃতিতে অন্তঃপ্রকৃতির রাজ্য। ... জয়দেব যে প্রণয়গীত করিয়াছেন, তাহা বহিরিন্দ্রিয়ের অনুগামী। বিদ্যাপতি প্রভৃতির কবিতা, বিশেষতঃ চন্ডীদাসের কবিতা বহিরিন্দ্রিয়ের অতীত।" (বিদ্যাপতি ও জয়দেব)।

একালের গবেষকেরা অবশ্য প্রধানত দ্বিতীয় উদ্দেশ্যের দ্বারাই চালিত। হয়েছেন। তাদের মধ্যে পথিকৃৎ হলেন শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত, সুকুমার সেন, শশিভূষণ দাশগুপ্ত প্রমুখ চিন্তাবিদ। শশিভূষণ দাশগুপ্ত 'ত্রয়ী' এবং বিষ্ণুপদ ভট্টাচার্য 'কালিদাস ও রবীন্দ্রনাথ' গ্রন্থে মুখ্যত তুলনামূলক পদ্ধতিই অবলম্বন করেছেন। অন্যদিকে, বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক অপূর্বকুমার রায় শৈলীবিজ্ঞানের আলোকে উনিশ শতকের বাংলা গদ্যসাহিত্যে ইংরেজি প্রভাবসংক্রান্ত গবেষণা করেছেন। বিভিন্ন দেশের সাহিত্য সংস্কৃতির পারস্পরিক যোগাযোগ এ সমালোচনা পদ্ধতির পথ করে দিয়েছে।

সাহিত্যের ক্ষেত্রে দুচারজন বহুভাষাবিদ স্রষ্টা ও মনীষী এ তুলনামূলক আলোচনাকে সহজ করে দিয়েছিলেন। দেশকালের সীমা সংকুচিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন দেশকালের সাহিত্যে অখন্ড মানবসত্যকে খুঁজে বের করার চেষ্টাতেও এ সমালোচনা সাহিত্য এগিয়ে এসেছে। তুলনার মাধ্যমে তুলনীয় সাহিত্যগুলোর চরিত্র বৈশিষ্ট্য এবং রীতিপদ্ধতিও স্পষ্ট হয়ে এসেছে। আরব্য উপন্যাস ও পঞ্চত, ডেকামেরন ও দশ কুমার চরিত, গ্রিক নাটক ও সংস্কৃত নাটক, সংস্কৃত নাটক ও শেকসপিয়রের নাটক, ইংরেজি মিস্ট্রি-মর‍্যালিটি প্লে ও যাত্রাভিনয়, বাল্মীকি ব্যাস ও হোমার ভার্জিল, পোয়েটিকস ও নাট্যশাস্ত্র, শকুন্তলা ও মিরান্দা, গ্যেটে ও রবীন্দ্রনাথ, ফলস্টাফ ও শকার তুলনার অন্তর্ভুক্ত হয়ে বিভিন্ন দেশের সাহিত্যধর্ম, প্রতিভার বহুমুখিতা ও সীমাবদ্ধতা, দেশ-দেশান্তরে লোককথার বিচিত্র মোটিফের বহুরূপী প্রকাশ, দেশ-দেশান্তরের সমাজ ধর্ম ও নীতি আদর্শকে স্পষ্ট করে বুঝেছে।

প্রায় একশত বছর আগে 'বিশ্বসাহিত্য' প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ এ তুলনামূলক সাহিত্যবিচারের মূল উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন, বিশ্বসাহিত্য ('তুলনামূলক সাহিত্যবিচার' অর্থেই তিনি একথাটি প্রয়োগ করেছিলেন) বিশ্বমানবকেই অন্বেষণ করে। কাজেই বিশ্বসাহিত্যের আলোচনা বিশ্বমানব সন্ধানেরই চেষ্টা। এসব সমালোচনা পদ্ধতির মধ্যে অনেক পদ্ধতিতেই তুলনামূলক বিচার হতে পারে। যেমন: ধারণা বা Concept ভিত্তিক, সাহিত্য শাখাভিত্তিক, ঐতিহাসিকভিত্তিক, সামাজিকভিত্তিক, রূপভিত্তিক বা রাজনীতিভিত্তিক যেকোনো পদ্ধতিতেই তুলনামূলক বিচার সম্ভব। সেদিক থেকে হয়তো সব পদ্ধতিরই একটি করে তুলনামূলক আলোচনার শাখা থাকতে পারে। তবু তুলনামূলক আলোচনার একটি নিজস্ব ক্ষেত্রও আছে যেখানে জাতীয় সাহিত্যের সীমারেখা ছাড়িয়ে শেকসপিয়র, লোপ দি ভেগা, গ্যেটে ও রবীন্দ্রনাথ তুলনার ক্ষেত্রে আসতে পারেন।

শিল্পের এক শাখা সাহিত্য অন্য শাখা চিত্রকলার সঙ্গে তুলনীয় হতে পারে। কাব্য ও সংগীত পারস্পরিক তুলনায় নিজেদের চরিত্র বৈশিষ্ট্য ফুটিয়ে তুলতে পারে। কাব্য ও সংগীতের ওপর তুলনামূলক আলোচনা রবীন্দ্রনাথ থেকে অল্পবিস্তর শুরু হলেও চিত্রকলার সঙ্গে সাহিত্যের তুলনাত্মক আলোচনা বাংলায় বিশেষ নেই বললেই চলে। স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের সঙ্গে তুলনা তো কথাই নেই। এক্ষেত্রে তুলনামূলক সমালোচনা পদ্ধতির সীমাবদ্ধতার কথাও মনে রাখতে হয়। তুলনার মধ্যে বস্তুনিষ্ঠতার কোনো অভাব হয়তো থাকে না। কিন্তু রচনার আস্বাদনের ব্যাপারটি অনেক সময়ই অবহেলিত থাকে বলে আলোচনা হয়ে ওঠে যান্ত্রিক। তাছাড়া দেশকাল ইতিহাসের স্বচ্ছ ধারণাও প্রায়শ অস্পষ্ট থেকে যায়।

তুলনামূলক আলোচনার দ্বারা নানা দেশের সাহিত্য ও রচনাকারের অপরিচয়ের ব্যবধান ঘোচানো যায়, তাতে সন্দেহ নেই। মানসিক সংকীর্ণতা দূর করার জন্য আধুনিককালে তুলনামূলক সমালোচনার প্রভাব বর্ধিত হচ্ছে। এর ফলে এক দেশের পাঠক অন্য দেশের ভাষা শিখতে প্রলুব্ধ হবে, অপরের প্রতি প্রতিকূল মনোভাব হ্রাস পাবে। তাই আজকাল তুলনামূলক সাহিত্যপাঠ ও মূল্য বিচার মার্জিত রুচির লক্ষণ বলে নির্দিষ্ট হবে।
আপনারঅদৃশ্যমন্তব্য
Cancel